৮
‘ই’ আর ‘উ’ এর প্রভাবে ‘অ’কারান্ত শব্দের উচ্চারণে বিকৃতির কথা বলেছি। ‘য’-ফলার কথাও বলেছি। এবার অন্য দুটি বর্ণের কথা বলব, যাদের প্রভাবেও ‘অ’ এর উচ্চারণ ‘ও’ হয়ে যায়। প্রথমটি স্বরবর্ণ ‘ঋ’। অর্থাৎ ‘ঋ’-কার। আমরা সাধারণভাবে বলে থাকি ‘ঋ’-ফলা। তবে যেহেতু ‘ঋ’ একটি স্বরবর্ণ, তাই ‘ঋ’-ফলা না বলে বলব ‘ঋ’-কার। কারণ স্বরচিহ্নগুলিকে আমরা ‘কার’ আখ্যা দিয়ে থাকি। যেমন, ‘আ’-কার, ‘ই’-কার, ‘উ’-কার, ইত্যাদি
আর ব্যঞ্জনের ক্ষেত্রে আমরা বলি ‘ফলা’, যেমন, ‘ব’-ফলা, ‘য’-ফলা, ‘ম’-ফলা, ‘ত’-ফলা, ইত্যাদি।
এবার কয়েকটি শব্দ নেওয়া যাক। কর্তা (কর্ তা), কিন্তু ‘কর্তৃক’ (কোর তৃক্), আবার ‘কর্তব্য’ (কর্ তব্ বো), কিন্তু ‘কর্তৃত্ব’ (কোর্ তৃত্ তো)। এখানে একটা কথা বলা বোধহয় খুবই দরকার আর তা হল কোন শব্দে ৃ-কার থাকলে তা খুবই স্পষ্ট করে উচ্চারণ করা দরকার যাতে তা কোন ভাবেই ‘র’-ফলার মত না হয়ে যায়।
যাই হোক, এই যে ‘কর্তৃক’ আর ‘কর্তৃত্ব’ শব্দে ‘ক’ এর উচ্চারণ ‘কো’ হয়ে গেল, তার কারণ কী? ঠিকই ধরেছেন। কারণ ওই ‘ঋ’-কার। বাংলায় ‘ঋ’ এর উচ্চারণ অনেকটা ‘রি’। যদিও অন্যান্য অনেক ভারতীয় ভাষায় এর উচ্চারণ ‘রু’। যেমন, ওড়িয়া, মারাঠি, ইত্যাদি ভাষায় ‘ঋ’ ‘রু’এর মত উচ্চারণ হয়। আর বাংলায় এটি যেহেতু ‘রি’, তাই ওই ‘ই’এর প্রভাবে ঠিক তার আগের ‘অ’কারান্ত বর্ণটি ‘ও’কারান্ত হয়ে যায়। আরও কয়েকটি শব্দের কথা লিখি, যেমন, মসৃণ (মোস্ রিন), ‘সমৃদ্ধ’ (সোম্ রিদ্ ধো)। তবে ‘ঋ’-কারের ক্ষেত্রেও কিন্তু উপসর্গের নিয়মটা একই। অর্থাৎ ‘অ’, ‘স’ বা ‘ত’ উপসর্গ হিসেবে আগে থাকলে ওই বর্ণগুলির উচ্চারণে বিকৃতি আসে না। যেমন, ‘অদৃশ’, ‘অমৃত’, ‘তদৃশ’, ‘সতৃষ্ণ’, ইত্যাদি শব্দে ‘অ’ ‘ত’ বা ‘স’ এগুলি উপসর্গ হওয়ায়, পরে ঋ থাকলেও এগুলির উচ্চারণে কোন বিকৃতি ঘটছে না। ব্যতিক্রম শুধু দেখছি ‘যকৃত’ শব্দতে। যদিও ‘য’ এখানে উপসর্গ নয়।
৯
এবার আর একটি বর্ণের কথা বলি। বর্ণটি হল ‘ক্ষ’। অবশ্য এটিকে বর্ণ বলা যায় কি না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। অনেকেই বলবেন যে এটি একটি যুক্ত ব্যঞ্জন। ‘ক + ষ’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এটিকে বর্ণের মর্যাদা দিয়ে গিয়েছেন। সহজ পাঠের ওই ছড়াটার কথা মনে আছে তো? ওই যে ‘শাল মুড়ি দিয়ে ‘হ”ক্ষ’ ……. ‘। যাই হোক এ আলোচনা এখানে অবান্তর। এখানে যেটা বলতে চাই তা হল এই ‘ক্ষ’ বর্ণটির আগে ‘অ’-কারান্ত কোন বর্ণ থাকলে, তার উচ্চারণ পরিবর্তিত হয়ে ‘ও’-কারান্ত হয়ে যায়। যেমন ‘যক্ষ’ (জোখ্খো), ‘রক্ষক’ (রোখ্খোক্) ‘ভক্ষক’ (ভোখ্খোক্), ‘দক্ষ’ (দোখ্খো), ‘অক্ষর’ (ওখ্খোর), ‘কক্ষ’ (কোখ্খো), ‘চক্ষে’ (চোখ্খে), ‘তক্ষক’ (তোখ্খোক্) ইত্যাদি। কিন্তু এর কারণ কি? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আমরা ‘ক্ষ’ বর্ণটিকে বলি ‘খিঁয়’। তাই ওই ‘ই’ এর প্রভাবেই হয়তো এমন উচ্চারণে বদল হচ্ছে।
তবে এক্ষেত্রেও কিন্তু ‘অ’ অথবা ‘স’ উপসর্গের কথা মনে রাখতে হবে। অর্থাৎ ওই উপসর্গগুলি আগে থাকলে ‘অ’ এর উচ্চারণ বদলে ‘ও’ কখনই হবে না। যেমন, ‘অক্ষম’, ‘সক্ষম’, ‘অক্ষত’, ‘অক্ষয়’, ইত্যাদি।
১০
এর আগে আমরা শব্দের গোড়ায় ‘অ’ এবং ‘অ’-কারান্ত বর্ণের উচ্চারণ নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার ‘এ’ এবং ‘এ’-কারান্ত বর্ণ শব্দের গোড়ায় থাকলে তার উচ্চারণ কেমন ভাবে করব সে বিষয়ে আলোচনা করব। আপনাদের মনে হতে পারে ‘অ’ এর পরই কেন ‘এ’। তার কারণ ‘আ’, ‘ই’, বা ‘উ’ উচ্চারণে বিকৃতি কম বা প্রায় নেই বললেই চলে। সামান্য যেটুকু আছে তা নিয়ে পরে কোন এক সময় আলোচনা করার ইচ্ছে আছে। তবে একটা কথা এখানে বলে রাখি তা হল বাংলায় ‘ঈ’ বা ‘ঊ’ এর কোন আলাদা উচ্চারণ নেই। আর ‘ঋ’ এর উচ্চারণে একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে।
বিভিন্ন নাটকের দল এবং অভিনয় শিক্ষার স্কুলে উচ্চারণের ক্লাস নেবার সময় আমার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার মধ্যে একটি অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের বলি। এই ধরণের একটি ক্লাসে হঠাৎ একটি ছেলে আর একটি ছেলেকে দেখিয়ে বলল, “স্যার, ও ‘লেখাপড়া’কে উচ্চারণ করছে ‘ল্যাখাপড়া’। কোনটা ঠিক?”
আমি বললাম, “তোমার উচ্চারণটাই ঠিক। কিন্তু বলতে পার কেন শব্দটির উচ্চারণ ‘ল্যাখাপড়া’ নয়?
ছেলেটি বলল, ‘তাহলে তো ‘ল’ এ ‘য’-ফলা আকার দেওয়া থাকত।
আমি বোর্ডে ‘দেখা’ শব্দটি লিখে সকলকে পড়তে বললাম। সকলেই পড়ল ‘দ্যাখা’। অর্থাৎ ‘দ’ এ ‘য’-ফলা ‘আ’-কার দেওয়া না থাকলেও শব্দটির উচ্চারণ ‘দ্যাখা’। এবার আমি বোর্ডে একটা বাক্য লিখলাম। ‘দেখতে দেখতে দেখার সময় পার হল।’ প্রথম দুটো উচ্চারণ ‘দে’ আর পরেরটা ‘দ্যা’। কেন এমন হল?
এই আলোচনা করার আগে একটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা করার দরকার। বাংলায় ‘অ্যা’ একটি স্বরধ্বনি থাকা সত্ত্বেও এর জন্য কোন আলাদা বর্ণ বা চিহ্ন নেই। আমরা ‘এ’ আর ‘অ্যা’ সাধারণত ‘এ’কার দিয়েই লিখি। মারাঠী ভাষায় কিন্তু ‘অ্যা’ ধ্বনিটির জন্য একটি আলাদা চিহ্ন আছে। ফলে উচ্চারণে ভুল হওয়ার কোন সুযোগ নেই। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘অ্যা’ উচ্চারণের জন্য একটা আলাদা চিহ্ন আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু তা এতই সূক্ষ্ম যে খুব খুঁটিয়ে না দেখলে ধরাই যায় না। রবীন্দ্রনাথের একটা সুবিধে ছিল। তাঁর একটা নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা ছিল (এখনও আছে)— বিশ্বভারতী। অন্য সকলের তো সে সুবিধে ছিল না। সঙ্গের ছবিটা লক্ষ করুন, দেখবেন ‘কেন’ শব্দটিতে ‘এ’-কারের উপর দিকে একটা ছোট্ট হাইফেনের মত দাগ আছে যা ‘কে’ শব্দটির ‘এ’-কারে নেই। এ ভাবেই রবীন্দ্রনাথ দুটি আলাদা উচ্চারণ বুঝিয়েছেন।
১১
‘অ’-এর উচ্চারণ কখন ‘ও’ হয়ে যায় এই আলোচনা শেষে ‘এ’ কারের উচ্চারণ নিয়ে দু’চার কথা বলেছি। কিন্তু পরে লক্ষ্য করেছি যে ‘অ’ এর উচ্চারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা এড়িয়ে গেছি। তাই অন্য কোন বিষয়ে যাওয়ার আগে এটা বলা দরকার যে সাধারণত ‘র’-ফলা যুক্ত কোন ‘অ’-কারান্ত কোন বর্ণ যদি শব্দের গোড়ায় থাকে তবে তার উচ্চারণ ‘ও’-কারান্ত হয়ে যায়। যেমন, ‘ক্রমশ’ (ক্রোমোশ), ‘ক্রমাগত’ (ক্রোমাগত), ‘গ্রহণ’ (গ্রোহোন), ‘গ্রন্থ’ (গ্রোন্ থো), ‘দ্রষ্টব্য’ (দ্রোশ্ টোব্ বো), ‘দ্রষ্টা’ (দ্রোশ্ টা), ‘প্রথা’ (প্রোথা), ‘প্রণব’ (প্রোনোব), ‘ভ্রম’ (ভ্রোম), ‘ভ্রমণ’ (ভ্রোমোন), ‘প্রশংসা’ (প্রোশোংশা), ‘প্রকট’ (প্রোকোট), ‘প্রকার’ (প্রোকার), প্রকাশ’ (প্রোকাশ), ‘প্রকোপ’ (প্রোকোপ), ‘প্রক্ষেপণ’ (প্রোখ্খেপন), ‘প্রখ্যাত’ (প্রোখ্খাতো), ‘প্রগলভ’ (প্রোগোলভো), ‘প্রগাঢ়’ (প্রোগাঢ়), ‘প্রজ্ঞা’ (প্রোগ্ গা), ‘প্রচলন’ (প্রোচলন), ‘প্রচার’ (প্রোচার), ‘প্রচ্ছন্ন’ (প্রোছ্ছন্ নো), ‘প্রজা’ (প্রোজা), ইত্যাদি। এ ছাড়াও ব্রত, ব্রজ, ব্রহ্মা (উচ্চারণে ব্রোম্হা), শ্রম, শ্রমণ, শ্রদ্ধা, স্রষ্টা (স্রোশ্টা) শব্দগুলিতেও গোড়ার যুক্তবর্ণটি উচ্চারণে ‘ও’-কারান্ত। সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রমও আছে। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, ‘ক্রন্দন’ (ক্রন্ দন্), ‘ত্রস্ত’ (ত্রস্ তো), ‘ক্রয়’ (ক্রয়), ‘ত্রয়’ (ত্রয়), কিন্তু ‘ত্রয়োদশ’ (ত্রোয়োদশ), হ্রদ’ (হ্রদ), ‘হ্রস্ব’ (হ্রশ্শো), ইত্যাদি। অবশ্য সাধারণ ভাবে সব অ-কারান্ত যুক্তবর্ণই ও-কারান্ত উচ্চারিত হয় যদিও শব্দের গোড়ায় থাকলে তার ব্যতিক্রম অনেক সময়ই দেখা যায়। এই বিষয়ে পরে আলোচনা করব।
আর একটি কথা এই সুযোগে বলে নিই। এই যে নিয়মগুলির কথা আমরা আলোচনা করছি তা কিন্তু বিদেশি শব্দ, যেগুলি বাংলায় এসে গেছে, তার বেলায় খাটবে না। যেমন, ‘অফিসে এই লেখাটার একটা কপি পাঠাতে হবে। তার আগে এককাপ কফি খেয়ে নেওয়া যাক।’ এই বাক্য দুটিতে আগেকার বলা সমস্ত নিয়ম অনুযায়ী ‘অফিস’, ‘কপি’ ও ‘কফি’ এই শব্দগুলির প্রথম বর্ণ ‘ও-কারান্ত হবার কথা। কিন্তু যেহেতু শব্দগুলি বিদেশি শব্দ তাই গোড়ার বর্ণগুলির উচ্চারণে কোন পরিবর্তন হবে না। আবার যদি বলি ‘কপি’তে (কোপিতে) ‘কফির’ (কোফির) খেত নষ্ট করে দিয়েছে। লক্ষ্য করে দেখবেন ‘কপি’ ও ‘কফি’ শব্দ দুটিতে ‘ক’ ‘ও’-কারান্ত হয়ে গেছে। কারণ এই শব্দ দুটি বাংলা শব্দ।
ক্রমশঃ