বণিক ও ইফরিতের গল্প
শাহরাজাদ বলেছিলেন:
আমি শুনেছি, হে সুখী রাজা, এক ছিলেন ধনী বণিক, দেশজুড়ে ছিল তার বিভিন্ন ব্যবসায়, একদিন তিনি অশ্বারোহণে কোন একটি ব্যবসায় দেখাশোনার জন্য বের হয়েছিলেন। খুব গরম পড়ছিল, অতঃপর তিনি একটি বৃক্ষতলে বিশ্রামের জন্য বসলেন এবং জিনঝুলিতে হাত দিয়ে একটুকরো রুটি ও একটি শুকনো খেঁজুর বের করলেন। খাওয়া শেষে তিনি খেঁজুর দানাটি দূরে ছুঁড়ে ফেললেন। তখন বিশালাকৃতির একটি ইফরিত দৈত্য বের হয়ে এল, তার হাতে নাঙ্গা তলোয়ার। ইফরিত বণিকের নিকটে এল, বলল, ‘উঠে দাঁড়াও যাতে আমি তোমাকে হত্যা করতে পারি, যেমন করে তুমি আমার ছেলেকে হত্যা করেছ।’
‘আমি তোমার ছেলেকে কী করে হত্যা করেছি?’ বণিক জানতে চাইলেন।
ইফরিত তাকে বলল, ‘তুমি খেঁজুর খেয়ে যখন দানা নিক্ষেপ করেছিলে তখন সেটি আমার ছেলের বুকে লেগেছিল, তৎক্ষণাৎ সে মারা যায়, সে এখানে হাঁটছিল।’
‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ,’ পাঠ করলেন বণিক এবং যোগ করলেন, ‘লা হাওলা ওলা ক়ুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিইল আযীম । যদি আমিই তাকে হত্যা করে থাকি, তবে এটা নির্ঘাত দুর্ঘটনা, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দাও।’
‘আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব,’ চিৎকার করে উঠল ইফরিত। সে বণিককে টেনে হিঁচড়ে মাটিতে ফেলে দিল এবং তাকে হত্যা করার জন্য তলোয়ার উত্তোলন করল।
অশ্রুসিক্ত নয়নে বণিক চিৎকার করে বললেন, ‘ফাওয়িদু আমরি ইলাল্লাহি, ইন্নাল্লাহা বাসিরুম বিলইবাদ।’ অতঃপর আবৃত্তি করতে লাগলেন—
সুখের এবং অসুখের দুদিন মাত্র সময়
জীবনও তাই, আলোকোজ্জ্বল, মেঘময়।
সময় যা করে তার তরে নিন্দা যে করে,
তারে বল, সময় কি ছাড়ে মহাপুরুষেরে?
তুমি কি দেখ নি, প্রলয়-ঝড়ের আঘাত
বড় বড় বৃক্ষেরে যে করে ভূমিসাৎ?
মৃতরাই শুধু ভেসে উঠে সমুদ্রের জলে
মণিমুক্তা লুকিয়ে রয় গহীন সাগরতলে।
হয়ত সময় নিয়ে যাবে ভুল পথে
সরতে দিবে না ক্রমাগত ক্ষতি হতে।
আকাশ জুড়ে কত শত কোটি তারা আছে
তবু, গ্রহণ কেবল চাঁদ-সুরুজকেই গ্রাসে।
সবুজ এবং শুকনো গাছে পৃথিবী ভরা,
ঢিল কি ছুড়ে কেউ ফলবান বৃক্ষ ছাড়া?
মন ভাল করো, তোমারও ছিল সুসময়
ভাগ্যের খেলা মন্দরে পেও না ভয়।
আবৃত্তি শেষ হলে ইফরিত বলল, ‘বকবক বন্ধ কর, আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই সুনিশ্চিতভাবেই তোমাকে হত্যা করতে যাচ্ছি।’
‘ইফরিত,’ বললেন বণিক, ‘আমি একজন ধনী মানুষ, আমার স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি আছে; আমার কিছু দায়-দেনা আছে, কিছু আমানত আছে। আমাকে বাড়ি যেতে দাও, আমি প্রত্যেকের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে নতুন বছরের শুরুতে তোমার কাছে চলে আসব। আমি দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করছি, আল্লাহ কসম, আমি অবশ্যই তোমার কাছে ফিরে আসবো, তখন তুমি আমার সাথে যা খুশি করতে পারবে। এই বিষয়ে আমি আল্লাহকে আমার জামিনদার রাখছি।’
ইফরিত তাকে বিশ্বাস করল এবং তাকে বাড়ি যেতে যেতে দিল। বাড়ি ফেরার পর তিনি তার সমস্ত সম্পদের বন্দোবস্ত করলেন, প্রত্যেককে তার পাওনা পরিশোধ করে দিলেন। তিনি তার স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে যা ঘটেছিল সব বললেন। তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ-নিষেধ প্রদান করলেন এবং বছর শেষ হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে অবস্থান করলেন। এরপর তিনি উঠে গিয়ে ওযু করলেন, বগলে কাপনের কাপড় নিলেন, তার পরিবার, সমস্ত আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদেরকে বিদায় জানালেন এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও রওয়ানা হয়ে গেলেন। তখন সকলে বিলাপ করতে লাগল।
নববর্ষের দিনে তিনি সেই বৃক্ষের নিচে এলেন এবং তার দুর্ভাগ্যের জন্য বসে কাঁদতে লাগলেন। এমন সময় একজন বৃদ্ধ মানুষ তার সামনে এলেন, তার হাতে ছিল শিকলে বাঁধা একটা হরিণী। আগুন্তুক তাকে সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেন, এই জায়গাটা তো জিনের আস্তানায়, তবু কেন তিনি একা বসে আছেন। বণিক ইফরিতের সাথে তার ঘটে যাওয়া ঘটনা বললেন। বৃদ্ধ চিৎকার করে বললেন, আল্লাহর কসম, ভাই, আপনি একজন ধার্মিক মানুষ। আপনার কাহিনী এতই বিস্ময়কর যে, মানুষের চোখের কোণে সুঁচ দিয়ে লেখা হয়ে থাকবে, যারা উপদেশ গ্রহণ করতে চায় তাদের জন্য একটি শিক্ষনীয় হবে।’
তিনি বণিকের পাশে বসলেন, প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, তার সাথে ইফ্রিত কী করবে তা না দেখে তিনি চলে যাবেন না। যখন তারা দু’জনে সেখানে বসে কথা বলছিলেন, বণিক ক্রমবর্ধমান মর্মপীড়া ও আতঙ্কের সাথে দুঃশ্চিন্তায় কাবু হয়ে গেলেন। এই মুহুর্তে দ্বিতীয় একজন বৃদ্ধ এলেন, তার সাথে ছিল দুটি কালো সালুকি কুকুর। দু’জনকে সালাম দেওয়ার পর তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন কেন তারা জ়িনের আড্ডায় বসে আছেন তখন তারা তাকে শুরু থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা বললেন। তিনি তাদের সাথে বসার সাথে সাথেই তৃতীয় একজন বৃদ্ধ এসে পৌঁছলেন, তার হাতে ছিল একটি খচ্চর। তিনি তাদের সালাম জানালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তারা এখানে বসে আছেন কেন? তখন তারা ঘটনার বিস্তারিত বললে তিনি বললেন, তাহলে তো এই স্থান ত্যাগ করে যাওয়ার কোন মানেই হয় না—দেখি কী ঘটনা ঘটে?
আগুন্তুক বসার সাথে সাথেই মরুভূমির মাঝখানে একটি বিশাল ঘূর্ণিবায়ু দেখা দিল, ক্রমে সেটি কাছে এসে পৌঁছল—নাঙ্গা তলোয়ার হাতে ইফ্রিতকে দেখা গেল, তার চক্ষু থেকে যেন স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে! সে তিন জনের মাঝখান থেকে বণিককে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিল, বলল, ‘প্রস্তুত হও, যাতে আমি তোমাকে হত্যা করতে পারি যেমন তুমি আমার প্রিয় পুত্রকে হত্যা করেছিলে।’
বণিক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন, তখন বৃদ্ধ তিনজনও অশ্রু ধরে রাখতে পারলেন না, তারাও বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন। তারপর তাদের মধ্যে প্রথম আগত বৃদ্ধটি, যার সাথে একটি হরিণী আছে, তিনি অন্যদের ছেড়ে ইফ্রিতের কাছে গেলেন, তার হস্তচুম্বন করে বললেন, ‘হে জ়ীনদের রাজা, আমি যদি তোমাকে এই হরিণীর সাথে আমার সম্পর্কের গল্প বলি, তুমি কি আমাকে এই বণিকের রক্তের এক তৃতীয়াংশ দান করবে?’
ইফ্রিত বৃদ্ধের কথায় রাজি হল, যদি সে গল্পটিকে চমৎকার মনে করে। বৃদ্ধ লোকটি তার গল্প বলতে শুরু করলেন—
বৃদ্ধ ও হরিণীর গল্প
জেনে রেখ, ইফ্রিত, এই যে হরিণীটি দেখছ, এটি আমার চাচাত বোন, আমার নিজের রক্ত-মাংস। আমি তাকে বিয়ে করেছি যখন তার যৌবন ছিল, আমি তার সাথে ত্রিশ বছর যাবৎ একসাথে আছি, কিন্তু সে আমাকে কোন সন্তান দিতে পারেনি। সুতরাং আমি একটি উপপত্নী গ্রহণ করলাম, সে আমাকে একটি পুত্র সন্তান দিল, যার চোখ ও ভ্রুয়ের সৌন্দর্যে তাকে মনে হল পূর্ণিমার চাঁদ। সে বেড়ে উঠতে লাগল। যখন তার বয়স পনের বছর, তখন আমি প্রচুর পরিমাণ পণ্য নিয়ে ভিন দেশে বাণিজ্যে গিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী—এই হরিণীটি, যৌবনে যাদু বিদ্যার চর্চা শিখেছিল, সে আমার ছেলেকে একটি বাছুর আর তার মাকে একটি গাভীতে পরিবর্তন করে দিল। এরপর তাদেরকে রাখালের কাছে দিয়ে দিল। অনেক দিনের অনুপস্থির পর যখন আমি ভ্রমণ থেকে ফিরে এলাম, আমি তাদের দু’জনের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। আমার স্ত্রী আমাকে বলল, মহিলাটি মারা গেছে আর ছেলেটি কোথাও পালিয়ে গেছে সে তা জানে না।
এক বছর কাল অন্তরে নিদারুণ বেদনা ও নয়নে অশ্রু নিয়ে কাটালাম। এরপর এল ঈদুল আযহার দিন। আমি রাখালকে বলে পাঠালাম একটি স্বাস্থ্যবান গরু নিয়ে আসার জন্য। সে আমার জন্য আমার সে দাসী—যাকে আমি উপপত্নী করেছিলাম এবং আমার স্ত্রী মন্ত্র দিয়ে গাভী বানিয়ে রেখেছিল তাকে নিয়ে এল। আমি আস্তিন গুটালাম, ছোরাটি হাতে নিলাম এবং তাকে জবাই করতে গেলাম, তখন সে চিৎকার করে কাঁদছিল আর অশ্রু ফেলছিল। এতে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম এবং তার প্রতি আমার করুণা হল। আমি রাখালকে নির্দেশ দিলাম তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য গরু নিয়ে আসতে। আমার স্ত্রী তখন চিৎকার করে বলল, ‘এটাকেই জবাই করো, আমার কাছে এর চেয়ে ভাল আর মোটাতাজা গরু আর নেই।’
আমি তাকে আবারও জবাই করতে গেলাম, সেও পুনরায় পূর্ববত কাঁদতে লাগল, তখন আমি রাখালকে বললাম তুমি তাকে জবাই করো এবং চামড়া ছাড়িয়ে ফেল। সে তাই করল, আর দেখল, তার দেহে কোন মাংস বা চর্বি নেই, যা আছে তা চামড়া আর হাড্ডি। আমি যা করেছি তার জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলাম যখন আফসোস কোন কাজে আসেনি। আমি গাভীটি রাখালকে দিয়ে দিলাম, বললাম আমার জন্য একটা মোটাতাজা বাছুর নিয়ে এস। সে আমার কাছে আমার ছেলেকে নিয়ে এল। যখনই এই ‘বাছুর’ আমাকে দেখল, তখন সে তার বাঁধন ছিঁড়ে আমার সামনে ধুলায় গড়িয়ে পড়ল। সে আর্তনাদ করছিল আর অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল। আমি এবারও করুণা বোধ করলাম। রাখালকে বললাম, বাছুরটি ছেড়ে দাও, এবং আরেকটি গরু নিয়ে এস। পুনরায় আমার স্ত্রী—এখনকার হরিণী—আমাকে ডেকে চিৎকার করে বলতে লাগল আমি যেন আজ এই বাছুরটিকে কোরবানি করি। ‘আজকের দিন পবিত্র ও বরকতময়,’ তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘কোরবানি অবশ্যই ভাল হতে হবে এবং আমাদের এই বাছুরের চেয়ে মোটাসোটা আর ভাল কিছু নেই।’
‘তাকিয়ে দেখ গাভীটির দিকে, তুমি তো তাকে কোরবানি করতে বলেছিলে। এটি খুবই হতাশাজনক, আমরা এটি থেকে মোটেই লাভবান হইনি, বরং এটিকে জবাই করার জন্য আমার মন অনুশোচনায় পূর্ণ হয়ে গেছে। আমি আর তোমার কথা শুনব না, এই বাছুরটিকে আমি কোরবানি করব না।’
‘সর্বশক্তিমান, দয়ালু ও করুণাময় আল্লাহর কসম, আজকের পবিত্র দিনে তুমি কাজটি অবশ্যই করবে, যদি তুমি তা না কর, তবে তুমি আর আমার স্বামী নও, আমিও তোমার স্ত্রী নই।’
তার এইসব অত্যুগ্র কথাবার্তা শুনে, কিন্তু সে কী করতে চাইছে তা বুঝতে না পেরে আমি আমার ছুরি হাতে বাছুরের কাছে গেলাম।
ভোর হয়ে গেছে এবং শাহরাজাদকে যা বলার অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল সে তা বলা বন্ধ করল। ‘কী ভাল, চমৎকার, আনন্দায়ক ও মনোহর গল্প এটি!’ দুনিয়াজাদ বলে উঠল। শাহরাজাদ তাকে বলল, ‘রাজা যদি আমাকে রেহাই দেন আর আমি বেঁচে থাকি, আগামীকাল রাতে যে গল্প শোনাব তার তুলনায় এটি কি একটি গল্প হল?’
‘আল্লাহ কসম’, রাজা নিজে নিজে বললেন, ‘এই গল্পের বাকি অংশ না শোনা পর্যন্ত আমি তাকে হত্যা করতে যাব না।’
এই কারণে সূর্য পুরোপুরি উদিত না হওয়া পর্যন্ত বাকি সময় তারা সঙ্গমে কাটিয়ে দিল। অতঃপর রাজা তার দরবারে গেলেন যেখানে মন্ত্রী বগলদাবা করে কাফন নিয়ে এসেছিলেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি বিচার-সালিশে রায় দিলেন, কিছু কর্মকর্তাকে নিয়োগ করলেন এবং অন্যদের বরখাস্ত করলেন। কিন্তু মন্ত্রী খুব আশ্চর্য হলেন, রাজা তার মেয়ে সম্পর্কে কোন নির্দেশ প্রদান করেননি। এরপর দরবার বরখাস্ত করা হল, রাজা শাহরিয়ার তার প্রাসাদে ফিরে এলেন।