লক্ষ, লক্ষ্য, লক্ষ্যণীয়
এই শব্দগুলোর বানান লিখতে গিয়ে আমাদের প্রায়ই ভুল হয়ে যায়। ‘লক্ষ’ লিখতে গিয়ে ‘লক্ষ্য’ লিখে ফেলি আবার এর উল্টোটাও কখনও কখনও হয়ে যায়। এছাড়াও আমরা অনেক সময়ই ‘লক্ষণীয়’ শব্দে একটা বাড়তি য-ফলা লাগিয়ে ‘লক্ষ্যণীয়’ লিখে ফেলি। আসুন, আমরা সঠিক বানানগুলো এবং সেগুলোর সঠিক ব্যবহার শিখে নিই।
লক্ষ – লক্ষ শব্দটা যেখানে একটা সংখ্যা (শত সহস্র) তখন তার বানান আমরা লিখব ‘লক্ষ’। সাধারণত এই বানানটা লিখতে আমাদের খুব একটা ভুল হয় না।
লক্ষ – লক্ষ যেখানে একটা ক্রিয়াপদ সেই বানানে আমরা প্রায়ই ভুল করে ‘লক্ষ্য’ লিখে ফেলি। লক্ষ রাখতে হবে যে লক্ষ করা বা লক্ষ রাখা এই ধরনের ক্রিয়াপদ লিখতে গিয়ে আমরা যেন কখনই বাড়তি য-ফলা না দিয়ে দিই।
লক্ষ্য – লক্ষ্য শব্দটা যেখানে বিশেষণ সেখানে য-ফলা দিতেই হবে। কারণ ‘লক্ষ্’ ধাতুর সঙ্গে য লাগিয়েই শব্দটাকে বিশেষণে পরিণত করা হয়েছে। যেমন, আমার ‘লক্ষ্য’ শুদ্ধ বানান শেখা। অর্জুনের লক্ষ্য মাছের চোখ। কিন্তু ‘ অর্জুন মাছের চোখের দিকে লক্ষ করল।’
লক্ষণীয় – ‘লক্ষ্+অনীয় = লক্ষণীয়। এই বানানে য-ফলা নেই।
“লক্ষণীয় বিষয় হল যে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিদ্যালয়গুলো লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করে। যদিও প্রকৃত শিক্ষাদানই বিদ্যালয়গুলোর লক্ষ্য হওয়া উচিত।”
প্রাণী ও প্রাণি
‘প্রাণী’ শব্দটির বানান নিয়ে আমরা অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে যাই। এটি একটি তৎসম শব্দ তাই ণত্ববিধি অনুযায়ী ‘ণ’ লিখতে হবে তা আমরা জানি। কিন্তু প্রশ্ন হল, শব্দটি ‘ঈ-কারান্ত’ না ‘ই-কারান্ত’?
‘শ্রেণি’ শব্দটির অনুষঙ্গে আমরা অনেক সময় ‘প্রাণি’ লিখে ফেলি বটে কিন্তু ‘প্রাণী’ শব্দটির বানান ঈ-কারান্ত। এই শব্দটি ‘ইন্’ প্রত্যয়যুক্ত। প্রাণ আছে যার সে-ই প্রাণী (প্রাণ+ইন্) = প্রাণী। আমাদের ভুল লেখার আর একটি কারণ আছে। সমাসবদ্ধ শব্দের পূর্বপদ যদি ‘ইন্’ প্রত্যয়ান্ত হয় তবে পূর্বপদের শেষের দীর্ঘ স্বরটি হ্রস্ব স্বর হয়ে যায়। যেমন, ‘প্রাণিজ’, ‘প্রাণিবিদ্যা’ ইত্যাদি। তুলনীয়, মন্ত্রী কিন্তু ‘মন্ত্রিসভা’। তবে মনে রাখতে হবে সমাসবদ্ধ শব্দের পরপদে দীর্ঘ স্বর থাকলে তার পরিবর্তন হবে না। যেমন, প্রধানমন্ত্রী।
খেতে, যেতে ও গেতে, চেতে
অনেকেই প্রশ্ন করেন, যদি খা থেকে ‘খেতে’, যা থেকে ‘যেতে’ বা পা থেকে ‘পেতে’ হয় তবে গা থেকে ‘গেতে’ বা চা থেকে ‘চেতে’ হবে না কেন? শেষের দুটোকে আমরা ‘গাইতে’ বা ‘চাইতে’ বলি কেন?
মূল ধাতুগুলো লক্ষ করলেই আমরা এর কারণ বুঝতে পারব। ওপরে দেওয়া উদাহরণগুলোর ধাতুমূল ‘খা’, ‘যা’ বা ‘পা’ হলেও পরের দুটো ক্রিয়ার ধাতু কিন্তু যথাক্রমে ‘গাহ্’ এবং ‘চাহ্’। আর তাই খা > খাইতে > খেতে , যা > যাইতে > যেতে বা পা > পাইতে > পেতে হলেও গাহ্ > গাহিতে > গাইতে বা চাহ্ > চাহিতে > চাইতে হচ্ছে। অর্থাৎ মূল ধাতুর হ্-এর প্রভাবই এর কারণ।
মুখস্থ বনাম মুখস্ত
এই বানানটা লিখতে গিয়ে আমরা প্রায়ই সংশয়ে ভুগি। কী লিখব? ‘মুখস্থ’ না ‘মুখস্ত’? আমরা যদি শব্দের মানেটা ঠিক বুঝতে পারি তাহলেই আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব। আগে দেখে নেওয়া যাক ‘মুখস্থ’ শব্দটির অর্থ কী? মুখস্থ মানে মুখে স্থিত। ‘স্থিত’ বা ‘স্থ’ মানে আছে, বর্তমান বা প্রতিষ্ঠিত। ‘স্থ’ শব্দটি একটি বিশেষণ। মুখে আছে তাই মুখস্থ। ঠিক তেমনি নগরস্থ, নিম্নস্থ, অধীনস্থ, কলকাতাস্থ, ঢাকাস্থ, পদস্থ, কণ্ঠস্থ, দুঃস্থ, পার্শ্বস্থ ইত্যাদি।
তাহলে আমাদের ভুল হয় কেন? কারণ আর একটি শব্দ আছে ‘গ্রস্ত’, এটিও বিশেষণ। এর অর্থ গ্রাস করেছে এমন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিকারগ্রস্ত, রোগগ্রস্ত, শোকগ্রস্ত ইত্যাদি। এই শব্দগুলোতে আমরা বুঝতে পারছি বিকার, রোগ বা শোক গ্রাস করেছে এমন ব্যক্তি।
‘স্থ’ না ‘স্ত’ কোনটা লিখব এ বিষয়ে একটা সহজ নিয়মের কথা বলি। প্রথমেই’ স্থ’ অথবা ‘স্ত’ বাদ দিন। এবার দেখুন শব্দটার কোন মানে আছে কি? যদি থাকে ‘স্থ’ বসিয়ে দিন আর না থাকলে ‘স্ত’ বসান। যেমন, মুখস্থ শব্দ থেকে ‘স্থ’ বাদ দিলে থাকবে ‘মুখ’ যা একটি অর্থপূর্ণ শব্দ। কিন্তু বিকারগ্রস্ত শব্দ থেকে ‘স্ত’ সরিয়ে নিলে পড়ে থাকে ‘বিকারগ্র’ যার কোন মানে নেই। তাই এখানে হবে ‘স্ত’। আরও মনে রাখা দরকার যে ‘স্থ’ একটি অর্থপূর্ণ শব্দ হলেও ‘স্ত’ শব্দটির আলাদা কোন অর্থ নেই।
তবে আবার দেখতে হবে ‘দুরস্ত’ আর ‘দূরস্থ’ গুলিয়ে না যায়। দুরস্ত শব্দের মানে পরিপাটি, সুশৃঙ্খল। যেমন, কেতাদুরস্ত। আর দূরস্থ মানে দূরে আছে।