বাংলা এমন একটা ভাষা যা আদৌ ফোনেটিক নয়। ছেলেবেলায় পি ইউ টি পুট আর বি ইউ টি বাট নিয়ে বন্ধুদের সাথে কত মজা করতাম। বড় হয়ে জেনেছি যে শুধু ইংরাজিতেই নয় বাংলা উচ্চারণেও যে কত অসঙ্গতি তার ইয়ত্তা নেই। আসলে আমরা বাংলাভাষী বলেই হয়তো সেগুলো চট করে আমাদের চোখে পড়ে না। আমার মতে এর আর একটা কারণ আছে। আপনি যত কম দাম দিয়েই একটা ইংরাজি অভিধান কিনুন দেখবেন সেখানে অবশ্যই শব্দের শেষে বন্ধনীতে তার উচ্চারণটি দেওয়া আছে। আবার যত দাম দিয়েই একটা বাংলা থেকে বাংলা অথবা বাংলা থেকে ইংরাজি অভিধান কিনুন কোথাও কিন্তু শব্দটির উচ্চারণ দেওয়া নেই। একমাত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’টি ছাড়া আর কোথাও আমি উচ্চারণ দেখতে পাইনি। আর ঐ উচ্চারণের নির্দেশও আছে সামান্য কয়েকটা শব্দেই।
এবার ‘ফোনেটিক’ প্রসঙ্গে আসি। বাংলা ভাষায় আমরা যা বলি তা লিখি না আবার যা লিখি তা বলি না। ব্যপারটা কি অনেকটা ধাঁধাঁর মত শোনাচ্ছে? ধরুন ‘কলকাতা’ শব্দটির কথা। বলবার সময় আমরা বলবো ‘কোলকাতা’। (আমি অবশ্য কোলকাতা লিখতেই বেশি পছন্দ করি)। বাংলায় অনেকগুলি বর্ণ আছে যেগুলির উচ্চারণ আর নেই আবার কয়েকটি উচ্চারণ আছে তা প্রকাশ করার মতো কোন বর্ণ নেই। সে প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে।
আজ কয়েকটি শব্দ দিয়ে শুরু করা যাক। ‘কল’, ‘কলা’, ‘কলি’, ‘কলু’। তফাতটা লক্ষ্য করেছেন কি? প্রথম দুটো শব্দে ‘ক’ এর উচ্চারণ ‘ক’ আর পরের দুটি শব্দে ‘ক’ এর উচ্চারণ ‘কো’। পরের দুটি শব্দে ‘ক’ এর উচ্চারণ যে ‘কো’ সেটা কে স্থির করে দিল? মান্য উচ্চারণ অনুযায়ী ওই ‘ক’ দুটিকে ‘কো’ উচ্চারণ করতে হবে। মান্য উচ্চারণ কাকে বলে আর ঐ শব্দ দুটিতে ‘কো’ উচ্চারণ হবে কেন, তা আগামী দিনে বলবো। আজ এই পর্যন্ত।
২
এর আগে দুটো প্রশ্ন দিয়ে লেখা শেষ করেছিলাম। (১) মান্য ভাষা আমরা কাকে বলব? আর (২) ‘কল’, ‘কলা’, ‘কলি’, ‘কলু’ এই শব্দগুলির প্রথম দুটি ‘ক’ আমরা ‘ক’ উচ্চারণ করলেও পরের শব্দ দুটিতে ‘ক’ ‘কো’ এর মতো উচ্চারণ করি কেন?
কথ্য বাংলা ভাষা চালু আছে ঝাড়খণ্ড, পশ্চিম বঙ্গ, উত্তর বঙ্গ, পূর্ব বঙ্গ ও অসমে। এই সমস্ত জায়গায় কি আমরা একই উচ্চারণে কথা বলি। উত্তরে সকলেই একবাক্যে বলবেন যে, না। কেউ বলেন, যেতে লারব, খেতে লারব। কেউ বলেন যাব নাই, খাব নাই। কেউ বলেন, যাব না, খাব না। কেউ বলেন যাব নি, খাব নি। কেউ বলেন যামু না, খামু না আবার কেউ বলেন নাই যাব, নাই খাব। তাহলে কোন উচ্চারণকে আমরা মান্য উচ্চারণ বলব? মান্য উচ্চারণ হল সেই উচ্চারণ যা সকলেই সঠিক উচ্চারণ বলে মেনে নিয়েছেন। অনেক ভাষাবিদ মনে করেন যে কলকাতা অঞ্চলের কথ্য ভাষাই মান্য ভাষা। আমি অবশ্য তাঁদের সঙ্গে একমত নই। আমার মতে নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর ও শান্তিপুর এই ত্রিভূজের মধ্যে ব্যবহৃত কথ্য ভাষাই মান্য বাংলা ভাষা। কলকাতার আদি ভাষায় যে গেলুম, খেলুম বা নেবু, নুচি, নঙ্কা, অক্ত ইত্যাদি ব্যবহার হয় তা নিশ্চয়ই মান্য বলে গ্রহণ করা যায় না। আজ অবশ্য কলকাতাতেও সাধারণভাবে মান্য বাংলাই বলা হয়ে থাকে। এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নে। ‘অ’ বা ‘অ’কারান্ত বর্ণের পর ‘ই’ (ঈ), অথবা ‘উ’ (ঊ) বা ‘ই’কারান্ত (‘ঈ’কারান্ত) বা ‘উ’কারান্ত (‘ঊ’কারান্ত) বর্ণ থাকলে শব্দের শুরুতে ‘অ’ বা ‘অ’কারান্ত বর্ণটি উচ্চারণে ‘ও’ বা ‘ও’কারান্ত হয়ে যায় স্বরসঙ্গতির প্রভাবে। আর তাইতো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ই’ আর ‘উ’ হল যত নষ্টের গোড়া। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন, কড়াকড়ি। লক্ষ্য করে দেখুন যে এই শব্দটি আমরা উচ্চারণ করি ‘কড়াকোড়ি’। শব্দের গোড়ায় ‘ক’ বর্ণের পর একটি ‘আ’কারান্ত শব্দ থাকায় ঐ ‘ক’ ‘অ’কারান্তই উচ্চারণ করা হবে কিন্তু দ্বিতীয় ‘ক’ এর পর ‘ই’কারান্ত বর্ণ থাকায় ঐ ‘ক’-এর উচ্চারণ বদলে ‘ও’কারান্ত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আরও অনেক কিছু বলার ইচ্ছে আছে যা নিয়ে পরে আলোচনা করব। আর সব ক্ষেত্রেই কি এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে? না, তাও না। কোথায় কোথায় হবে না তাও আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।
৩
এর আগে ‘অ’ এর পর ‘ই’ বা ‘উ’ থাকলে ‘অ’ এর উচ্চারণ ‘ও’ হয়ে যায় বোঝাতে গিয়ে ‘কড়াকড়ি’ শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম। এই ধরণের আরও শব্দের উদাহরণ দেওয়া যায় :— যেমন, সরাসরি, দরাদরি, বলাবলি, ইত্যাদি। এই শব্দগুলি ছাড়াও আরও অনেক শব্দে যেমন :— করি (কোরি), ধরি (ধোরি), মরি (মোরি), কবি (কোবি), পরী (পোরি), গরু (গোরু), জরু (জোরু), লঘু (লোঘু) অনেক শব্দের উল্লেখ করা যায়। এবার প্রশ্ন, তাহলে অবিনাশ, অলিখিত, অনিন্দিতা, অনিমেষ, অবিস্মরণীয়, অসুখ ইত্যাদি শব্দে ‘অ’ এর উচ্চারণ ‘ও’ হয়ে গেলনা কেন? এখানে অন্য একটা নিয়ম কাজ করে। আর তা হলো কোন শব্দের আগে যদি নঙ্ অর্থক অর্থাৎ না-বাচক ‘অ’ বসে সেক্ষেত্রে ‘অ’ এর উচ্চারণ বদলে যায় না। ওপরের শব্দগুলি লক্ষ্য করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। আরও লক্ষ্য করুন যে অভিনয়, অতিকায়, অমুক (নাম না জানা লোক বোঝাতে আমরা যে শব্দ ব্যবহার করি) ইত্যাদি শব্দে যেহেতু ‘অ’ কোন না-বাচক বর্ণ নয় তাই এই ‘অ’ গুলির উচ্চারণ ‘ও’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ উচ্চারণে ‘ওভিনয়’, ‘ওতিকায়’, ওমুক’ হয়ে গেছে।
এবার দেখা যাক— ‘আমি করি,’ এই ‘ক’ উচ্চারণে ‘কো’ হয়ে গেছে কারণ ‘অ’কারান্ত বর্ণের পর একটা ‘ই’কারান্ত বর্ণ আছে। কিন্তু ‘আমি করছি’, এই শব্দে ‘ক’ , ‘কো’ হয়ে গেল কেন? এখানেতো ‘অ” এর পর ‘ই’ বা ‘উ’ নেই। বলব, তবে আজ নয় অন্য একদিন।
৪
আগে লিখেছিলাম , ‘তুমি কর’, ‘আমি করি’, ‘আমি করছি’। এই তিনটি বাক্যের প্রথমটি ‘তুমি কর’— এখানে ‘ক’ উচ্চারণে কোন বিকৃতি নেই। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্য ‘আমি করি’ — এখানে ‘ক’ উচ্চারণ বদলে ‘কো’ হয়েছে। কারণটা বলব, তবে তার আগে বোধহয় আর একটা কথা বলা দরকার। সেটা হল, ‘অতীন’, ‘অনিল’, ‘অতুল’ এই শব্দগুলির উচ্চারণ কী হওয়া উচিত? ‘অতীন’ অথবা ‘অনিল’ শব্দে যে ‘অ’, তা কিন্তু নঙ্ অর্থক নয়। তাই ওগুলোর উচ্চারণ ‘ওতিন’ বা ‘ওনিল’ হওয়া উচিত। চার অধ্যায় নাটকে শম্ভু মিত্র ‘ওতিন’ চরিত্রেই অভিনয় করতেন। আর একজন বিখ্যাত মানুষ ‘অনিল’ নামটাই লিখতেন ‘ওনিল’ ( ও সি গাঙ্গুলি ) যাতে উচ্চারণ ঠিক থাকে। আর ভ্রমবশত আমরা অনেকে ‘ওতুল’ উচ্চারণ করলেও শব্দটা ‘অতুল’ কারণ এই ‘অ’ কিন্তু নঙ্ অর্থক। আবার মজা হল ‘অতুলনীয়’ বললে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে।
এবার আগের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ‘আমি করছি’ এই বাক্যে ‘ক’ উচ্চারণ ‘কো’ হয়ে গেছে কারণ এখানে ‘ক’ এর পর একটা লুকোন ‘ই’ আছে। ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক। ‘করছি’ শব্দটার মূলে আছে ‘করিতেছি’ আর ‘ক’ এর পর ঐ লুকোন ‘ই’ র প্রভাবে ‘ক’ উচ্চারণে ‘কো’ হয়ে গেছে। সেইরকম, পড়ছি, পরছি, বলছি, ধরছি, মরছি, টলছি, ইত্যাদি শব্দে আমরা লুকোন ‘ই’ র প্রভাব লক্ষ্য করব। এই যে শব্দটা লিখলাম ‘করব’ এখানেও কিন্তু তাই হয়েছে। মূল শব্দ ‘করিব’ তাই উচ্চারণে ‘কোরবো’ হয়ে গেছে। আর ঠিক সেভাবেই ধরব, চলব, বলব ইত্যাদি শব্দেও আমরা এই বদলগুলো লক্ষ্য করব। এ ছাড়াও আরও একটা ব্যাপার আছে তা হল অ-কারান্ত ‘ক’ এর পর এবং ই-কারান্ত যে বর্ণটি আছে তা কিন্তু স্বরান্ত নয়।
আরও কিছু বিষয় পরবর্তী পর্বে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল।
ক্রমশঃ