৫
এর আগে লিখেছিলাম যে শুরুতে ‘অ’ উপসর্গ থাকলে আর পরে যদি ‘ই’, ‘ঈ’, ‘উ’, বা ‘ঊ’ বা ‘ই’কারান্ত, ‘ঈ’কারান্ত, ‘উ’ বা ‘ঊ’কারান্ত বর্ণও থাকে তাহলেও ‘অ’ এর উচ্চারণ অপরিবর্তিত থাকে। ঠিক তেমনি শব্দের শুরুতে ‘স’ উপসর্গ থাকে আর পরে ‘ই’কারান্ত, ‘ঈ’কারান্ত, ‘উ’কারান্ত বা ‘ঊ’কারান্ত বর্ণ থাকে তাহলে ‘স’ এর উচ্চারণ পরিবর্তিত হয় না। কয়েকটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। যেমন – সই, সহিস, সহিত, সঙিন, সঙ্গী, সতী, সন্ধি, সন্দিহান, সবিতা, সবুর, সবুজ, সমীপ, সমিতি, সমীকরণ, সমুদ্র, সরু, সলিল, ইত্যাদি শব্দে ‘স’ এর উচ্চারণ ‘সো’ হয়ে গেছে অথচ সঠিক, সটিক, সদিচ্ছা, সপিণ্ড, সরূপ, স্বরূপ, সলীল প্রভৃতি শব্দে ‘স’ এচ্চারণে কোন বিকৃতি হয় না। কারণ এই ‘স’ হলো উপসর্গ। তাই সলিল ( জল ) উচ্চারণে ‘সোলিল’ আবার ‘সলীল (লীলা সহ) শব্দের উচ্চারণ ‘সলীল’ কারণ এই ‘স’ একটি উপসর্গ।
৬
শব্দের শুরুতে ‘অ’ বা ‘অ’কারান্ত বর্ণের উচ্চারণে কেন বিকৃতি হয় তার একটা কারণ বলেছি। আরও অনেক জায়গায় ঐ বিকৃতি লক্ষ্য করা যাবে। এই যে ‘লক্ষ্য’ শব্দটা লিখলাম তা কিন্তু উচ্চারণে ‘লোখ্খো’। এখানে ‘ল’ এর উচ্চারণ ‘লো’ হয়ে গেল কেন? কারণ ‘ল’ এর ঠিক পরেই একটা ‘য’-ফলা যুক্ত বর্ণ (এ ক্ষেত্রে যুক্ত ব্যঞ্জন) আছে। আর ‘য’ মানে হলো আসলে ‘ইয়’ আর ওই ‘ই’ এর প্রভাবে ‘ল’ এর উচ্চারণ ‘লো’ হয়ে গেছে। আরও কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক :— যেমন, ‘পদ’, ‘পদ্য’, ‘পদ্ম’। পদ শব্দে ‘প’ উচ্চারণে কোন বিকৃতি নেই, ‘পদ্ম’ শব্দেও তাই, কিন্তু ‘পদ্য’ শব্দে ‘অ’কারান্ত ‘প’ এর পর একটি ‘য’-ফলা যুক্ত বর্ণ আছে আর তারই প্রভাবে উচ্চারণ হয়ে গিয়েছে (পোদ্ দো)। ঠিক সেভাবেই ‘অন্ন’ (‘অন্নো’), ‘অন্য’ (ওন্নো’)। বন্ধনীর মধ্যে সঠিক উচ্চারণ দেবার চেষ্টা করলাম। ‘সত্ত্ব’ (সত্তো’), ‘সত্য’ (সোত্তো’)। ‘সন্ধান’ (সন্ধান), কিন্তু সন্ধ্যা (সোন্ধা)। ‘বন্ধ’ (বন্ধো) বা বর্ণ (বর্নো) কিন্তু ‘বন্য’ (বোন্নো)। কল্কা (কল্কা), কিন্তু ‘কল্যাণ’ (কোল্লান)। পর্ণ (পর্নো), কিন্তু পণ্য (পোন্নো)। তত্ত্ব (তত্তো), কিন্তু ‘তথ্য’ (তোথ্থো)। সর্ব (সরবো), কিন্তু ‘সভ্য’ (সোভ্ভো)। ‘গর্ব’ (গরবো) কিন্তু ‘গব্য’ (গোব্বো)। অন্তত (অন্ততো), কিন্তু অত্যন্ত (ওত্তোন্তো)। ‘কথ্থক’ (কথ্থক) কিন্তু কথ্য (কোথ্থো)। ‘গণ্ড’ (গন্ডো), গন্ধ (গন্ধো) কিন্তু গণ্য (গোন্নো)।
এই ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে নিলে আমরা অনেক শব্দই সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারবো। যেমন, ‘গদ্য’ (গোদ্দো), ‘কল্য’ (কোল্লো), ‘শল্য’ (শোল্লো), ‘অদ্য’ (ওদ্দো), ‘জন্যে’ (জোন্নে), ‘কণ্যা’ (কোন্না), ‘নব্য’ (নোব্বো) এই শব্দগুলি (বা এই ধরণের আরও অনেক শব্দই যেগুলিতে ‘অ’ বা ‘অ’কারান্ত বর্ণের পর একটি ‘য’-ফলা যুক্ত বর্ণ আছে) যিনি যেমনভাবেই উচ্চারণ করুন না কেন আমরা কিন্তু এই নিয়ম অনুযায়ী গোড়ার ‘অ’কারান্ত বর্ণটিকে ‘ও’কারান্তই উচ্চারণ করবো।
এবার একটা শব্দের কথা বলি, তা হলো ‘গন্তব্য’। এই শব্দটাকে আমরা অনেক সময় ভুল করে (গোন্তোব্বো) উচ্চারণ করি। সঠিক উচ্চারণ (গন্তব্বো)। আর একটি শব্দ ‘কর্তব্য’। একই নিয়মে তার উচ্চারণ (কর্তব্বো), (কোরতব্বো) কিছুতেই নয়।
আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। তবে আমার মনে হয় সেগুলি যদি আপনারা খুঁজে বের করে লিখে ফেলেন তাহলে ওই শব্দগুলো উচ্চারণে কখনও ভুল হবে না। দু’একটি ব্যতিক্রম বা অন্য কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে পরে আলোচনা করবো।
৭
এবারে আগে বলা নিয়মের কয়েকটা ব্যতিক্রম আর অন্য একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমেই বলি ব্যতিক্রম কি না জানি না, তবে একটা শব্দ নিয়ে আমি একটু সমস্যায় পড়েছি। শব্দটা ‘কণ্ঠ’ অর্থাৎ গলা। এর উচ্চারণ স্বাভাবিক ভাবেই (কন্ঠো)। কিন্তু এই শব্দটার শেষে যদি একটা ‘য’-ফলা লাগিয়ে দেওয়া যায়? ‘কণ্ঠ্য’ অর্থাৎ গলা সম্বন্ধীয়। তাহলেও দেখা যাচ্ছে ‘ক’ এর উচ্চারণে কোন বিকৃতি হচ্ছে না। কেন? অবশ্য এর একটা কারণ অ-কারান্ত বর্ণটির পরেই কিন্তু ই-কার আসছে না। আরও দুটি শব্দ বলি, ‘সত্তর’ আর ‘নব্বই’। কেন জানি না ‘স’ আর ‘ন’ দুটোই ‘ও’-কারান্ত হয়ে গেছে। কারণটা অনেক ভেবেও বের করতে পারি নি। আপনারা কেউ যদি এই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারেন, তবু খুবই উপকৃত হব।
অনেক সময়েই দেখা যাবে যে, ‘অ’ এর পর ‘য’-ফলা যুক্ত কোন বর্ণ থাকলেও ‘অ’ এর উচ্চারণ ‘ও’ হয়ে যাচ্ছে না। কেন? সেই ব্যাখ্যাই আজ দেবার চেষ্টা করব।
কয়েকটা শব্দ নেওয়া যাক, ‘অত্যাধিক’ (ওত্ তাধিক), ‘অত্যাচার’ (ওত্ তাচার), ‘অধ্যাপক’ (ওধ্ ধাপক), ‘অধ্যবসায়’ (ওধ্ ধোবসায়), ‘অধ্যায়’ (ওধ্ ধায়), ‘অধ্যুষিত’ (ওধ্ ধুসিত), ‘অব্যবহিত’ (ওব্ বোবোহিত), ‘অব্যাহতি’ (ওব্ বাহতি), ‘অভ্যুদ্যয়’ (ওভ্ ভুদ্ দয়), ‘অত্যুচ্য’ (ওত্ তুচ্ চো)।
আবার ‘অন্যায়’ (অন্ নায়), ‘অন্যূন’ (অনুন্ নো), ‘অব্যবস্থা’ (অব্ ববোস্ থা), ‘অব্যবহার্য’ (অব্ ববোহার্ জো), ‘অব্যয়’ (অব্ বয়), ‘অব্যর্থ’ (অব্ বর্ থো)।
লক্ষ্য করে দেখুন প্রথম সারির শব্দগুলিতে ‘অ’ এর উচ্চারণ ‘ও’ হলেও দ্বিতীয় সারিতে কিন্তু ‘অ’ উচ্চারণে কোন বিকৃতি হয় নি। কেন? এর পিছনে কোন যুক্তি আছে কি? আছে। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই তা বোঝা যাবে। দ্বিতীয় সারির শব্দগুলিতে ‘অ’ উপসর্গ হিসেবে ব্যববহৃত হয়েছে। আর তাই সেই উচ্চারণে কোন বিকৃতি হয় নি। আর এটা বোঝার একটা সহজ পদ্ধতি আছে, তা হলো শব্দটা থেকে ‘অ’ সরিয়ে নিলেও দেখবেন তার একটা অর্থ আছে আর তার আগের ‘অ’-টি একটি নেতিবাচক উপসর্গ হিসেবে বসানো হয়েছে। আজ এই পর্যন্তই। এরপর আরও অনেক উচ্চারণ নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রইলো।
ক্রমশঃ