যখন দ্বিতীয় রাত হল, দুনিয়াজাদ শাহরাজাদকে বললেন, ‘আপু, আমাদের জন্য তোমার বণিক ও ইফ্রিতের গল্প শেষ কর।’
‘সানন্দে,’ জবাব দিল শাহরাজাদ, ‘যদি রাজা অনুমতি প্রদান করেন।’
রাজা অনুমতি প্রদান করলেন আর শাহরাজাদ তার গল্প বলা শুরু করলেন— আমি শুনেছি, হে সৌভাগ্যবান ও ন্যায়পরায়ণ রাজা, বণিক যখন বাছুরটিকে জবাই করতে যাচ্ছিল, তখন তিনি করুণার বশবর্তী হয়ে রাখালকে বলেছিল যে বাছুরটিকে অন্য পশুদের মধ্যে রেখে দাও।
ইফ্রিত হরিণীওয়ালা বৃদ্ধের গল্প শুনে বিস্ময়বিহ্বল হয়ে পড়েছিল—বৃদ্ধ গল্প বলতে থাকল—
হে জ়ীনদের রাজা, যখন এই সব চলছিল, আমার স্ত্রী—এখন এই হরিণী—আমাকে দেখছিল, আর বলছিল বাছুরটিকে জবাই করে দিতে, কেননা, এটি মোটাতাজা ছিল। কিন্তু আমি বাছুরটিকে জবাই করতে পারিনি, বরং রাখালকে বললাম বাছুরটিকে নিয়ে যেতে, সে তাই করলো। পরের দিন আমি সেখানে বসে ছিলাম, রাখাল আমার কাছে ফিরে এসে বলল, ‘আমি আপনাকে এমন একটি খবর দিব যা শুনে আপনি খুশি হবেন, অবশ্য তার জন্য আপনি আমাকে পুরষ্কার দিতে হবে।’ আমি তার কথায় রাজি হলাম, সে বলল, ‘মনিব, আমার একটি যুবতী কন্যা আছে, সে আমাদের সাথে বাস করা একজন বৃদ্ধার কাছে যাদু বিদ্যা শিখেছিল। গতকাল আপনি যখন আমাকে বাছুরটি দিয়েছিলেন, আমি সেটাকে নিয়ে আমার কন্যার কাছে গেলাম, বাছুরটিকে দেখে সে তার মুখ ঢেকে ফেলল। সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, এরপর তার চোখ সজল উঠল। তারপর সে বলল, “বাবা, তুমি কি আমাকে এখনো ছোট মনে কর যে আমার সামনে অদ্ভুত পুরুষদের নিয়ে আস?” “কোথায় অদ্ভুত পুরুষেরা,” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এবং তুমি হাসলে কেন, আর কাঁদলেই বা কেন?” সে বলল, “তোমার সাথে যে বাছুরটি আছে, সেটি আমাদের মনিবের ছেলে। সে ও তার মা তার বাবার স্ত্রীর যাদুর অধীনে রয়েছে। এই কারণে তাকে দেখে আমি হেসেছিলাম, কিন্তু যখন সে বলল, তার বাবা তার মাকে জবাই করে দিয়েছেন, তখন আমি কেঁদে দিলাম।” আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম, এরপর সকাল হতেই তাড়াতাড়ি আপনাকে বলার জন্য চলে এলাম।’
লোকটির কথা শুনে আমি তার সাথে বাইরে গেলাম, খুশিতে ও আনন্দে আমি মাতাল হয়ে গেলাম যদিও আমি মদপান করিনি। আমি যখন তার বাড়িতে পৌঁছলাম তার কন্যা আমাকে স্বাগত জানাল, এবং আমার হস্তচুম্বন করল, এমন সময় বাছুরটি এসে উঠোনে আমার সামনে গড়াগড়ি দিতে লাগল। আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাছুরটি সম্পর্কে তুমি যা বলেছ তা কি সত্য?’
সে আমাকে নিশ্চিত করল, ‘জি, মনিব, এটাই আপনার প্রিয় পুত্র।’
আমি তাকে বললাম, ‘মেয়ে, তুমি যদি তাকে মুক্ত করে দিতে পার, এই সমস্ত পশু এবং তোমার বাবা যা দেখাশোনা করে সমস্ত কিছু তোমাকে দিয়ে দিব।’
সে হেসে বলল, ‘আমি কেবল দুটি শর্তে এই কাজ করতে পারি, প্রথমত, আপনি আমাকে তার সাথে বিয়ে দিবেন, দ্বিতয়ত, আমাকে অনুমতি দিতে হবে, যে তাকে যাদু করেছে আমিও তাকে যাদুতে বন্দী করে রাখব। অন্যথায় আমি তার চক্রান্ত থেকে নিরাপদ থাকতে পারব না।’
যখন আমি তার কথাগুলো শুনলাম, তখন আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিলাম যে, সে যা চায় তাই পাবে এবং তার বাবার দায়িত্বে থাকা আমার সমস্ত কিছুও তাকে দিয়ে দিব, এমনকি আমি তাকে আমার স্ত্রীকে হত্যা করার অনুমতিও দিলাম। তখন সে একটি জলভর্তি বাটি আনল, তাতে মন্ত্র পাঠ করল, তারপর সে পানি বাছুরটির উপর ছিটাতে ছিটাতে বলল, ‘যদি তুমি মহান আল্লাহ সৃষ্টি বাছুর হয়ে থাক তাহলে তুমি যেমন আছ তেমনি থাক, আর যদি কোন যাদু দ্বারা তোমাকে পরিবর্তন করা হয় তাহলে তুমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইচ্ছায় তোমার আসল রূপে ফিরে এস।’
বাছুরটি কেঁপে উঠল এবং মানুষে পরিণত হল। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘আল্লাহ দোহাই, আমার স্ত্রী তুমি ও তোমার মায়ের সাথে কী করেছে আমাকে বল।’
সে যা যা ঘটেছিল সব বলল, আমি বললাম, ‘পুত্র, আল্লাহ তোমাকে উদ্ধার করার জন্য একজন উদ্ধারকারিণী পাঠিয়েছেন।’
রাখাল কন্যার সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিলাম, সে আমার স্ত্রীকে হরিণীতে পরিণত করে দিয়ে বলল, ‘এটি সুন্দর আকৃতি, দেখতে খারাপ লাগতে পারে এমন পশুর মত নয়।’
মেয়েটি কিছু সময়ের জন্য আমাদের সাথেই ছিল, যতক্ষণ না আল্লাহ তাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং আমার ছেলে এই ব্যক্তির দেশ ভারতে চলে যায় যার সাথে তোমার ঝামেলা বেঁধেছে। আমার স্ত্রী, এই হরিণীটিকে আমি আমার সাথেই রাখলাম, আর তার সন্ধানে নানান স্থানে ভ্রমণ করতে লাগলাম। ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, আমি দেখলাম, বণিক এখানে বসে বসে কাঁদছেন। এটাই আমার কাহিনী।
ইফ্রিত খুশি হয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘এটি সত্যিই একটি বিস্ময়কর কাহিনী, আমি আপনাকে তার রক্তের এক-তৃতীয়াংশ প্রদান করে দিলাম।’
বৃদ্ধ ও দুই সালুকির গল্প
এমন সময় দুই সালুকিসহ বৃদ্ধ লোকটি এগিয়ে এসে ইফ্রিতকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি যদি তোমাকে আমার আর আমার ভাইদের অর্থাৎ এই দু’টি কুকুরের কী হয়েছিল সে কাহিনী বলি এবং কাহিনীটি যদি তোমার কাছে আশ্চর্যজনক ও অদ্ভুত মনে হয় তবে কি তুমি এই ব্যক্তির অপরাধের এক-তৃতীয়াংশ আমার কাছে হস্তান্তর করবে?’
ইফ্রিত রাজি হলে বৃদ্ধ তার কাহিনী বলা শুরু করলেন— হে জ়ীনদের মহারাজ, এই কুকুর দুটি আমার দুই বড় ভাই, আমি তৃতীয়। আমাদের পিতা মৃত্যুর সময় আমাদের জন্য তিন হাজার দিনার রেখে যান এবং আমরা প্রত্যেক ব্যবসায়ের জন্য একটি করে দোকান খুললাম। আমার বড় ভাই, এখন এই কুকুর দুটির মধ্যে একটি, তার দোকানে সামগ্রী এক হাজার দিনারে বিক্রি করে বাণিজ্যের জিনিসপত্র কিনে ভ্রমণে রওয়ানা হয়ে গেল।
পুরো এক বছর যাবৎ তিনি দূরে ছিলেন, একদিন আমি আমার দোকানে ছিলাম, একজন ভিখারী আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমি তার মঙ্গল কামনা করলাম, সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি কি আমাকে একেবারেই চিনতে পার নি?’ আমি তার দিকে ভাল করে তাকালাম, দেখলাম এই তো আমার ভাই, আমি গিয়ে তাকে স্বাগত জানালাম এবং আমার দোকানে নিয়ে এলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কেমন ছিলেন। তিনি বললেন, ‘আর বলো না। আমার সব সম্পত্তি খোয়া গেছে, এবং আমার অর্থনৈতিক অবস্থাও বদলে গেছে।’
আমি তাকে গোসলখানায় নিয়ে গেলাম, আমার কিছু জামাকাপড় দিলাম তাকে, তারপর তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। এরপর আমি আমার হিসাবখাতা ও দোকানের বিক্রয়াদি পরীক্ষা করে দেখলাম যে আমার দুই হাজার মূলধনে এক হাজার দিনার লাভ করেছি। আমি আমার ভাইয়ের সাথে সেটি ভাগ করে নিলাম এবং তাকে কখনও বিদেশ ভ্রমণ করেছিলেন সেটা ভুলে যেতে বললাম। সে সানন্দে টাকাটা নিল এবং আরেকটি দোকান খুলল।
কিছুদিন পরে আমার দ্বিতীয় ভাই, এখানে অন্য কুকুরটি, ভ্রমণের অভিপ্রায়ে তার সব কিছু বিক্রি করে দিল। আমরা তাকে থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম কিন্তু সে বাণিজ্যিক পণ্য কিনে অন্য কয়েকজনের সাথে চলে গেল। সেও তার ভাইয়ের মত একই অবস্থায় আমার কাছে ফিরে আসার আগে পুরো এক বছর দূরে কাটিয়েছে। আমি তাকে বললাম, ‘ভাই, আমি কি তোমাকে নিষেধ করিনি?’
সে জবাব দিল, ‘আমার ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে, এখন আমি হতদরিদ্র, টাকাকড়িহীন, এমন কী আমার একটি জামাও নেই।’
আমি তাকে গোসলে নিয়ে গেলাম, আমার দোকানে নিয়ে আসার আগে আমার নিজের পোশাক থেকে একটি নতুন পোশাক তাকে দিলাম। এরপর আমরা একত্রে পানাহার করলাম। আমি তাকে বললাম, ‘ভাই, আমি প্রতি নববর্ষে আমার দোকানের লাভ-লোকসান হিসাব করি, আমি যে লাভ পাব তার থেকে আপনাকে অর্ধেক দিব।’ হিসাব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলাম যে আমার দুই হাজার দিনার লাভ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! আমি তাকে এক হাজার দিনার দিয়ে বাকিটা আমার কাছে রেখে দিলাম।
আমার ভাই আরেকটি দোকান খুললেন। কিছুদিন পর তিনি ও আমার অন্য ভাই আমাকে প্রস্তাব করলেন যে, আমিও যেন তাদের সাথে সমুদ্রযাত্রায় যাই। আমি তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললাম, ‘আপনারা আপনাদের ভ্রমণ থেকে কী লাভ পেয়েছেন যা দেখে আমিও লাভ করার জন্য আশাবাদী হতে পারি?’ আমি তাদের কোন কথা শুনতে রাজি হইনি এবং আমরা আমাদের দোকানেই ব্যবসা করতে থাকি।
প্রতিবছর তারা আমাকে একই প্রস্তাব দিত, আমি কখনও রাজি হতাম না। ছয় বছর পর আমি তাদের প্রস্তাব মেনে নিলাম এবং তাদের সাথে বাণিজ্যে যেতে রাজি হলাম। আমি তাদের বললাম, আপনাদের কাছে কী কী আছে আমাকে দেখান, তারা কিছুই দেখাতে পারল না। খেয়ে পরে আর বিনোদন করে তারা সমস্ত উজাড় করে দিয়েছে। আমি তাদের কোন কথা বলিনি, কিন্তু আমার দোকানের হিসাবপত্র নিরীক্ষা করে দেখলাম। এরপর আমার দোকানের সমস্ত জিনিসপত্রের সাথে আমি যা যা অর্জন করেছি সব বিক্রি করে দিলাম ছয় হাজার দিনারের বিনিময়ে। শুধু আমার বাড়িটি রাখলাম শেষ আশ্রয় হিসেবে। আমি টাকাটাকে দুই ভাগ করলাম, ভাইদের বললাম, আমার ও তাদের বাণিজ্যের জন্য মাত্র তিন হাজার দিনার আছে। তাদের সাথে যা হয়েছে আমার সাথেও যদি তাই হয়, এই ভেবে বাকী তিন হাজার দিনার আমি মাটির নিচে লুকিয়ে রাখলাম। যদি এমনই হয়, তবে আমি সেই টাকা উত্তোলন করে আবার নতুন করে দোকান তুলে ব্যবসায় করতে পারব। তারা তাতে রাজী হলো, আমি তাদের প্রত্যেককে এক হাজার দিনার করে দিলাম এবং আমার জন্য এক হাজার দিনার রাখলাম।
বাণিজ্যিক পণ্য এবং পথে আমাদের যা যা লাগবে সব কিছুর ব্যবস্থা করলাম এবং একটি জাহাজ ভাড়া করে তাতে পণ্য বোঝাই করে ভ্রমণের প্রস্তুতি নিলাম। পুরো একমাস ভ্রমণ করে আমরা একটি নগরে এসে পৌঁছলাম, এখানে আমরা দশগুণ মুনাফা অর্জন করলাম। আমরা আবার সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি নিলাম। বন্দরে আসার সময় পুরোনো ও ছিন্নভিন্ন বস্ত্র পরিহিতা একটি মেয়েকে দেখতে পেলাম। সে আমার হস্তচুম্বন করে বলল, যদি আমি দানশীল ব্যক্তি হই, তাহলে সে আমাকে পুরষ্কৃত করবে। ‘আমি দান ও সৎকাজ পছন্দ করি,’ আমি তাকে বললাম, ‘এমন কী যদি তুমি আমাকে কোন প্রতিদান প্রদান নাও কর।’
সে বললল, ‘আমাকে বিয়ে কর এবং তোমার দেশে নিয়ে যাও। আমি নিজেকে তোমার কাছে সঁপে দিয়েছি, আমার সাথে সদয় আচরণ কর, কেননা, আমি দয়া ও উদারতা পাওয়ার যোগ্য। আমি এইসব আপনাকে ফেরত দিব, আমার বর্তমান অবস্থা দেখে বিভ্রান্ত হবেন না।’
এইসব শুনে আমি তার জন্য ব্যাকুলতা অনুভব করলাম, মহান ও মহিমান্বিত আল্লাহ যেমন আদেশ করেছিলেন। আমি তাকে গ্রহণ করলাম, তার পোশাক দিলাম এবং তার থাকার জন্য জাহাজে সুন্দরভাবে সজ্জিত একটি কামরা দিলাম। আমি তার সাথে সম্মানজনক আচরণ করলাম। আমাদের যাত্রা শুরু হওয়ার পরে ধীরে ধীরে আমি গভীর ভাবে তার প্রেমে পড়ে গেলাম। রাতে বা দিনে কখনই আমি তাকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না। তার প্রতি অধিক সম্পৃক্ততার কারণে আমি আমার ভাইদের অবহেলা করতে লাগলাম। তারা আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত হল, আমার সম্পদ ও আমার পণ্যের পরিমাণকে হিংসা করছিল। এইসব দেখার জন্য তারা সময় ব্যয় করল। তারা আমাকে হত্যা এবং আমার কাছে যা ছিল তা নিয়ে আলোচনা করেছিল। তারা বলল, ‘আমাদের ভাইটিকে হত্যা করব এবং তার যা আছে সব আমাদের হয়ে যাবে।’ শয়তান তাদের কাছে এই কাজটিকে আকর্ষণীয় করে তুলল, সুতরাং আমাকে একা পাওয়ার চেষ্টা করছিল। একদিন আমি আমার স্ত্রীর সাথে ঘুমাচ্ছিলাম, তারা আমাদের দুজনকে জাহাজের বাইরে সমুদ্রে ফেল দিল।
আমার স্ত্রী জেগে উঠল, তার মধ্যে একটা কাঁপুনি এল, সে একজন ইফ্রিতায় পরিণত হল। সে তখন আমাকে একটি দ্বীপে নিয়ে গেল যেখানে সে আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ভোর হওয়ার পূর্বে সে ফিরে এসে সে আমাকে বলল, ‘আমি তোমার দাসী, আমিই সেই যে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তোমাকে এখানে নিয়ে এসে তোমার জীবন বাঁচিয়ে ছিলাম। তুমি নিশ্চয় জেনে গেছ, আমি একজন জিন। আমি তোমাকে দেখেই তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, এটা আল্লাহর অভিপ্রায় ছিল। আমি আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর প্রেরিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি ন্যাকড়া পরে তোমার সামনে এসেছি, তুমি এমনটিই দেখেছ, তবু তুমি আমাকে বিয়ে করেছ। এখন আমি তোমাকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছি। আমি তোমার ভাইদের প্রতি রাগান্বিত হয়েছি এবং তাদেরকে হত্যা করব।’
তার কথা শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, সে যা করেছে তার জন্য তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম এবং আমার ভাইদের হত্যা না করার জন্য অনুরোধ জানালাম। আমি তখন তাকে তাদের সাথে আমার কী চুক্তি হয়েছিল তার পুরো কাহিনী বললাম। সে উত্তেজিত হয়ে উঠল, বলল, ‘আজ রাতে আমি তাদের কাছে উড়ে যাব, তাদের জাহাজ ডুবিয়ে দেব এবং তাদের ধ্বংস করে ফেলব।’ আমি তাকে আল্লাহ নামে অনুনয় করেছিলাম যাতে সে এমন না করে। আমি তাকে একটি প্রবাদ স্মরণ করিয়ে দিলাম যাতে বলা হয়েছে যে ক্ষতি করে তাদের ভাল কর। — ‘দুষ্কৃতিকারীর আপন কর্মই তার প্রতি শাস্তি।’ — তাকে বোঝাতে চাইলাম, যত কিছুই করুক, তারা তো আমার ভাই।
আমার অনুনয়-বিনয় সত্বেও সে জেদ করতে থাকে। তারপর আমার সাথে উড়ে এসে আমাকে আমার বাড়ির ছাদে নামিয়ে দেয়। আমি দরজা খুললাম, পুঁতে রাখা টাকা বের করলাম। এলাকার লোকেদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিয়ম করলাম এবং নতুন করে মালপত্র কিনে আবার আমার দোকান খুললাম।
সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরে এলাম, দেখলাম কুকুর দুটি বাঁধা রয়েছে। যখন আমার চোখে তাদের চোখ পড়ল, তাদের চোখে অশ্রু বইতে শুরু করল। তারা আমার গা ঘেঁসে দাঁড়াল। কী ঘটেছে আমি তা বুঝে উঠার আগেই আমার স্ত্রী এসে বলল, ‘এরা তোমার ভাই।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তাদের এই অবস্থা করেছে?’
সে বলল, ‘আমি আমার বোনকে খবর পাঠিয়েছিলাম, সে তাদের আকৃতি পরিবর্তন করে দিয়েছে, দশ বছরের জন্য তারা এই যাদু থেকে মুক্ত হতে পারবে না।’
আমার ভাইয়েরা এখন দশ বছর যাবৎ এভাবেই আছেন, আমি তাদের মুক্তির পথেই ছিলাম, তখন এই লোকটিকে দেখতে পেলাম। সে আমাকে তার কাহিনী বলেছে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে তোমার এবং তার মধ্যে কী ঘটতে চলেছে তা না দেখা পর্যন্ত আমি তাকে ছেড়ে যাব না। এটাই আমার কাহিনী।
‘এটি একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা,’ ইফ্রিত একমত হল, বলল, ‘আমি তোমাকে তার অপরাধের জন্য রক্তের এক তৃতীয়াংশের নিশ্চয়তা প্রদান করছি।’
বৃদ্ধ ও খচ্চরের গল্প
তৃতীয় বৃদ্ধ, যিনি খচ্চর নিয়ে এসেছিলেন, তিনি বললেন, ‘যদি আমি এই দু’টি গল্পের চেয়ে আরও বেশি আশ্চর্যজনক গল্প শোনাতে পারে তুমি কি আমাকে অবশিষ্ট অংশটি প্রদান করার নিশ্চয়তা দিবে?’ ইফ্রিত রাজি হলে বৃদ্ধ তার কাহিনী বলা শুরু করলেন—
হে জিনদের সুলতান ও সর্দার, এই খচ্চরটি আমার স্ত্রী। আমি এক বছরের জন্য দূরে ভ্রমণে গিয়েছিলাম, ভ্রমণ শেষে আমি তার কাছে ফিরে এসেছিলাম। তখন ছিল রাত, আমি দেখলাম একটি কৃষ্ণ কৃতদাস তার সাথে বিছানায় শুয়ে আছে; তারা দু’জন কথা বলছে, পরস্পরের শরীরে হাত দিচ্ছে, হাসাহাসি করছে, চুমোচুমি করছে এবং একজন আরেক জনের সাথে খেলা করছে। আমার প্রতি আমার স্ত্রীর নজর পড়ল, সে আমার কাছে এক জগ পানি নিয়ে এল যাতে সে মন্ত্র পাঠ করছিল। সে সে পানি আমার উপর ছিটিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার এই আকৃতি ত্যাগ কর এবং কুকুরের আকৃতি গ্রহণ কর।’ তাৎক্ষণিক আমি কুকুর হয়ে গেলাম সে আমাকে ঘরের দরোজা দিয়ে বাইরে তাড়িয়ে দিল।
আমি চলতে চলতে এক কসাইয়ের দোকানে পৌঁছে গেলাম, সেখানে আমি হাড় চিবুতে লাগলাম। কসাই আমাকে দেখে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। আমাকে দেখে তার কন্যা মুখ ঢেকে ফেলল, বলল, ‘তুমি আমার সামনে একটা পুরুষ মানুষ নিয়ে এসেছে, বাবা?’
‘কোথায় পুরুষ মানুষ?’ তার বাবা জানতে চাইলেন, সে বলল, ‘এই কুকুরটি একজন পুরুষ মানুষ যার উপর তার স্ত্রী জাদু করেছে; তবে আমি তাকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করে দিতে পারব।’
‘আল্লাহর দোহাই তোমার, তুমি তাই কর,’ তার বাবা বললেন।
সে একটি জগে করে পানি নিয়ে এল, তার উপর কিছু কথা বলে আমার উপর ছিটিয়ে দিল। সে বলল, ‘তোমার আসল আকৃতিতে ফিরে যাও,’ এবং আমি তাই করলাম।
আমি সেই মেয়েটির হস্তচুম্বন করে বললাম, ‘আমি আপনার যাদু দিয়ে আমার স্ত্রীকে তাই করতে চাই সে আমার সাথে যা করেছে।’
সে আমাকে কিছু কিঞ্চিৎ পানি দিয়ে বলেছিল, ‘আপনি যখন তাকে ঘুমাতে দেখবেন, তখন তার উপর এই পানি ছিটিয়ে দিবেন এবং আপনার পছন্দ মত কিছু বলবেন। আপনি যেমন বলবেন সে তেমনি আকৃতির হয়ে যাবে।’
সে পানি নিয়ে আমি আমার স্ত্রীর কাছে গেলাম, দেখলাম সে ঘুমাচ্ছে। আমি তার উপর পানি ছিটিয়ে দিলাম আর বললাম, ‘এই আকৃতি ত্যাগ কর আর খচ্চর হয়ে যাও।’ সে তৎক্ষণাৎ খচ্চর হয়ে গেল। সুলতান ও জিনদের শাহেনশাহ, এটিই সেই খচ্চর।
* * *
‘এটা কি সত্যি?’ লোকটি খচ্চরকে জিজ্ঞাসা করল, এতে সে মাথা নাড়াল, ইশারায় বার্তা দিল, ‘এটা আমার গল্প এবং আমার সাথে তাই ঘটেছিল।’
বৃদ্ধ যখন তার গল্প শেষ করলেন, ইফ্রিত আনন্দে কাঁপতে কাঁপতে তাকে বণিকের রক্তের অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ অধিকার প্রদান করে দিল।
এখন ভোর হয়েছে, শাহরাজাদ তাকে যা বলার অনুমিত প্রদান করা হয়েছিল তা থেকে বিরত হল। ‘এটা কী ভাল, মনোরম, আনন্দদায়ক ও সরস গল্প!’ চিৎকার করে উঠল দুনিয়াজাদ। তখন শাহরাজাদ তাকে বলল, ‘কিভাবে আসন্ন রাতে তোমাকে যে গল্প শোনাব তার সাথে এই গল্পের তুলনা করা যায়? যদি আমি বেঁচে থাকি আর রাজা আমাকে হত্যা না করেন।’
রাজা মনে মনে বলল, ‘আল্লাহর কসম, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে হত্যা করতে যাব না যতক্ষণ পর্যন্ত তার কাছ থেকে এই অসাধারণ কাহিনীর অবশিষ্টাংশ শুনে শেষ না করি।’ অতএব সূর্য পুরোপুরি উদিত হওয়া পর্যন্ত সময় তারা পরস্পর জড়াজড়ি করে কাটিয়ে দেয়।
অতঃপর রাজা তার দরবারে গেলেন। মন্ত্রীর সাথে অন্যান্য দরবারি ও সৈনাপ্রধানেরাও এসে পৌঁছলেন। রাজা বিচারকার্য, কিছু কর্মকর্তাকে নিয়োগ ও অন্যদের বরখাস্ত করে এবং নানা আদেশ ও নিষেধ জারি করে সন্ধ্যা পর্যন্ত দরবারে কাটালেন। এরপর প্রাসাদে ফিরে এলেন। রাত হলে তিনি আবার শাহরাজাদের সাথে শুয়ে পড়েন।