ভাষা নিয়ে তথ্য সংগ্রহকারী আন্তজার্তিক সংস্থা এথনোলগ্-এর সর্বশেষ ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিবেদন (২৩ তম সংস্করণ) অনুযায়ী পৃথিবীতে ৭১১৭টি জীবন্ত ভাষা রয়েছে। এরমধ্যে ভাষাভাষী হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান পাঁচ নম্বরে এবং বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান সাত নম্বরে। প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। উপমহাদেশে প্রধান তিনটি ভাষা : হিন্দি, উর্দু, বাংলা। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও বুনিয়াদি ভাষা কোনটি তা দেখা যাক।
(ক) উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত ভাষা
প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে দলে-দলে বিভিন্ন ভাগে আর্যরা আমাদের এ উপমহাদেশে এসে ধীরে-ধীরে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তারা সবাই আর্য ভাষাভাষী হলেও বিভিন্ন ভাগের ভাষার মধ্যে কিছু-কিছু পার্থক্য ছিল। অর্থাৎ আর্য ভাষার বিভিন্ন উপভাষার মানুষ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের নিজ-নিজ আর্য উপভাষার মৌখিক কথাবার্তা ওই অঞ্চলের স্থানীয় ভাষার সংস্পর্শে আসায় উভয় মিলে সেখানকার আঞ্চলিক কথ্য প্রাকৃত ভাষার উদ্ভব হয়। এভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক-পৃথক আঞ্চলিক প্রাকৃত ভাষার উদ্ভব ঘটায়। যেমন : শৌরসেনী, মহারাষ্ট্রী, পৈশাচী, মাগধী, গৌড়ীয় ইত্যাদি প্রাকৃত ভাষা। পরবর্তীকালে সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে-সাথে আরও বিভিন্ন বিষয় যুক্ত হওয়ায় সাধারণের কথ্য এসব প্রাকৃত ভাষা পরিবর্তিত হতে থাকে এবং অপভ্রংশের জন্ম হতে থাকে। পতঞ্জলির মতে সংস্কৃত হচ্ছে শাস্ত্রবানদের ভাষা, আর অপভ্রংশ হচ্ছে শাস্ত্রহীনদের অশুদ্ধ ভাষা। মাগধী, অন্যমতে গৌড়ীয় প্রাকৃতের অপভ্রংশ হতে সপ্তম বা অষ্টম শতকে প্রাচীন বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়। সিদ্ধাচার্যগণ প্রাচীন বাংলা ভাষায় চর্যাপদ রচনা করেন—যা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন।
অন্যদিকে আর্য ও স্থানীয় ভাষা মিলে দিল্লি অঞ্চলে যে প্রাকৃতের উদ্ভব হয়, তার নাম হচ্ছে শৌরসেনী প্রাকৃত। শৌরসেনী প্রাকৃতের অপভ্রংশ থেকে দিল্লি অঞ্চলে যে ভাষার উদ্ভব হয়, তার নাম খাড়িবুলি ভাষা। ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আসা-যাওয়া সৃষ্টি হওয়ায় এবং পরবর্তীকালে প্রথমে তুর্কি পরে ফারসিভাষীরা দিল্লিতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় খাড়িবলি ভাষার শব্দের সঙ্গে তুর্কি, আরবি, ফারসি শব্দের ব্যাপক মিশ্রণ ঘটতে থাকে। এতে খাড়িবলি ভাষা অনেকটা মার্জিত ও পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটাকে হিন্দুস্তানি ভাষাও বলা হতো। মুঘল আমলে এটা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে এবং এর অনেক বেশি বিস্তৃতি ঘটে। বিভিন্ন অঞ্চলের সৈন্যরা সেনানিবাসে এভাষা ব্যবহার করত। সম্রাট শাহজাহান (১৬২৮-১৬৫৮)-এর একটি সেনানিবাসের নাম ‘উর্দু-এ-মুআল্লা’ থাকায় তিনি সৈন্যদের ব্যবহৃত এ ভাষার নামকরণ করেন উর্দু। এই উর্দু শব্দটি তুর্কি ওর্দু শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ শিবির বা ক্যাম্প। উর্দু ভাষায় আরবি লিপি গ্রহণ করা হয়। সে সময় উর্দু ভাষাকে হিন্দি থেকে পৃথক ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হতো না।
ইংরেজ আমলে উনিশ শতকে হিন্দুস্তানি খাড়িবুলির আঞ্চলিক রূপকে প্রমিত হিন্দি হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়। এর ফলে উর্দু ভাষার আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দ পরিহার করে সংস্কৃত শব্দপ্রধান হিন্দি ভাষা প্রতিষ্ঠা পায়। হিন্দিতে দেবনাগরী লিপি গ্রহণ করা হয়। এভাবেই প্রমিত উর্দু থেকে প্রমিত হিন্দি পৃথক হয়ে যায়। হিন্দিভাষী বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টায় ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম হিন্দি বিহার প্রদেশের সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়। সে সময় থেকেই কাব্য, সঙ্গীত ইত্যাদিতে হিন্দি সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। এসব ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে এখানে ‘বাংলা, উর্দু ও হিন্দি ভাষার জন্মকথা’ শীর্ষক আমার অপর একটি লেখায় অনেক বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি। দেখা যাচ্ছে, বাংলার তুলনায় হিন্দি তো বটেই উর্দুও অনেক হাল আমলের ভাষা।
উপরোক্ত পর্যালোচনা হতে এটা সুস্পষ্ট যে, এই উপমহাদেশের প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে আমাদের মতো প্রাচীনত্ব, সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যমণ্ডিত এবং সাহিত্যকর্মের ভাষা আর একটিও নেই। তা ছাড়া হিন্দির উপভাষাসমূহ এবং উর্দু বাদ দিলে বাংলা ভাষার লোকসংখ্যাও হিন্দির থেকে অনেক বেশি। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিকভাবে উর্দু ও হিন্দি একই ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়।
তামিল ভাষার প্রাচীনত্বের অবশ্য অন্য ইতিহাস রয়েছে। পৃথিবীর আদি বারটি ভাষা বংশের অন্যতম দ্রাবিড় বংশের একটি হচ্ছে তামিল ভাষা। প্রাচীনত্ব ঐতিহ্য তামিল ভাষার অনেক বেশি। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বাংলা, উর্দু, হিন্দি যতটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, যতটা প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করেছে, যতটা প্রচলিত হয়েছে এবং যতটা প্রধান ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়, তামিল সে তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। তাদের মাঝে এ নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে।
পৃথিবীতে মাত্র এক শতাংশ ভাষার মানুষ নিজ ভাষায় সাহিত্যচর্চা করার যোগ্যতা রাখে। আমাদের কবি এক শ’ বছরেরও আগে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
ইংল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশি চিকিৎসক ও লেখক অপূর্ব চৌধুরী, যিনি ইংরেজি বাংলা-সহ বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী, তিনি ‘ভাষার বৈচিত্র্য এবং বাংলা ভাষা’ শীর্ষক শিরোনামে লিখিত খুবই মূল্যবান এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা বলা হয় ফ্রেঞ্চ ভাষাকে। দ্বিতীয় স্থান নিয়ে বাংলা এবং ইতালিয়ান ভাষার লড়াই’। এতে বুঝা যায়, বাংলা খুবই সুমিষ্ট ভাষা। একসময় বাংলা সবচেয়ে সুমিষ্ট ভাষা বলে ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদিতে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। অবশ্য ইউনেস্কোর বরাত দিয়ে যা প্রচার করা হয়েছে তার কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের সৈনিকদের সেবা ও এ ভাষার মোহনীয়তার দরুন সিয়েরালিয়েন-সহ আফ্রিকার অপর কতক রাষ্ট্রের জনগণ এ ভাষাকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়েছে। তবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে সেদেশে গ্রহণের কথা ঠিক নয়।
বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার জন্য ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সন্তানেরা জীবন দিয়েছে। যার সূত্র ধরে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে—পৃথিবীর সব দেশেই যা পালিত হয়। আর এই ভাষার ভিত্তিতে বাংলাদেশ নামক দেশটি জন্ম নিয়েছে—যা পৃথিবীতে একমাত্র দৃষ্টান্ত। এ ছাড়াও আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্য ১১জন জীবন দিয়েছে। বাঙালিরাই পারে।
প্রথম পর্বে দেখিয়েছি, উপমহাদেশে প্রধান তিনটি ভাষা—উর্দু, হিন্দি ও বাংলার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও বুনিয়াদি ভাষা হচ্ছে, বাংলা। আমাদের মতো প্রাচীনত্ব, ঐতিহ্যমণ্ডিত আর সাহিত্যকর্মের ভাষা উপমহাদেশে আর একটিও নেই। এখন বাংলা ভাষার আর একটি মাহাত্ম্য দেখা যাক। সেটা বাংলা লিপি সম্পর্কিত।
(খ) বাংলা লিপির বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব
ভাষার মূল হচ্ছে ধ্বনি বা বর্ণ। কোনো ভাষার উচ্চারিত শব্দকে বিশ্লেষণ করলে যে উপাদানসমূহ পাওয়া যায়, সেগুলোকে পৃথকভাবে ধ্বনি বলে। বিভিন্ন ধ্বনি পরপর সাজিয়ে তৈরি হয় শব্দ। আর অনেক শব্দ নানা বিন্যাসে সাজিয়ে গড়া অসংখ্য সব বাক্য নিয়ে তৈরি হয় একটি ভাষা। সব ভাষার শব্দ ও বাক্য গঠনের সূত্রগুলো প্রায় একই ধরনের। লিখে প্রকাশ করার সুবিধার্থে ধ্বনিগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে কিছু চিহ্ন তৈরি করা হয়েছে। এই চিহ্নের নাম বর্ণ।
প্রতিটি কথ্য ভাষায় স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি বা বর্ণ আছে। যেমন বাংলা ভাষায় অ, আ- – – ও, ঔ ১১টি স্বরবর্ণ রয়েছে, ইংরেজিতে আছে a, e, i, o, u এই পাঁচটি স্বরবর্ণ। বাংলায় ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে ৩৯টি, ইংরেজিতে রয়েছে ২১টি। স্বরধ্বনি ব্যঞ্জনধ্বনির সাহায্য ছাড়া পূর্ণ ও স্পষ্টরূপে উচ্চারিত হয়। আর ব্যঞ্জনধ্বনি স্বরধ্বনির সাহায্যে উচ্চারিত হয়। যেমন : ক+অ = ক, চ+অ = চ, b+e = b, k+a = k ইত্যাদি।
বর্ণমালার সুনির্দিষ্ট সাজানো ক্রমকে বলা হয়, বর্ণমালা। আমাদের বর্ণ তৈরি ও তার সাজানো ( বর্ণমালা ) থেকেই দেখা যায় যে, আমাদের পৃর্ব পুরুষরা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন। অ থেকে ঔ স্বরবর্ণগুলো প্রথমে সাজানো হয়েছে। সেখানেও এক জাতীয়গুলো একসঙ্গে রাখা হয়েছে, যেমন—অ আ, ই ঈ, উ ঊ, এ ঐ ইত্যাদি। ব্যঞ্জনবর্ণগুলো স্বরবর্ণের পরে সাজানো হয়েছে। সবগুলো ব্যঞ্জনবর্ণ ‘অ’ স্বরবর্ণের সাহায্যে উচ্চারিত হয়। আবার দেখুন, উচ্চারণের স্থান অনুযায়ী ব্যঞ্জনবর্ণগুলো বিভিন্ন বর্গে ভাগ করে সাজানো হয়েছে। যেমন : ক বর্গ ( ক খ গ ঘ ঙ) হচ্ছে, কণ্ঠ বা জিহ্বামূল থেকে উচ্চারিত জিহ্বামূলীয় ধ্বনি; চ বর্গ ( চ ছ জ ঝ ঞ ) হচ্ছে, জিহ্বার তালু থেকে উচ্চারিত তালব্য ধ্বনি; মূর্ধা থেকে উচ্চারিত ট বর্গ ( ট ঠ ড ঢ ণ ) মূর্ধন্য ধ্বনি; ত বর্গ ( ত থ দ ধ ন ) দন্ত থেকে উচ্চারিত বলে দন্তমূলীয় ধ্বনি; ঠোঁট বা ওষ্ঠ থেকে উচ্চারিত প বর্গ ( প ফ ব ভ ম ) ওষ্ঠ ধ্বনি। অন্যান্য বর্ণগুলো উপরোক্ত বিভিন্ন বর্গে পড়ে। কত সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে আমাদের বর্ণমালা। আবার দেখুন, ক বর্গের শেষ বর্ণ ঙ; ঙ-এর সঙ্গে ক বর্গের বাকি বর্ণগুলো যুক্তাক্ষর তৈরি করে। সেরকম ঞ যুক্তাক্ষর তৈরি করে চ বর্গের বাকি বর্ণগুলোর সঙ্গে, ন করে ত বর্গের এবং ণ করে ট বর্গের বাকি বর্ণের সঙ্গে।
আবার অন্যান্য অনেক ভাষায় লিখা হয় এক রকম, আর পড়া হয় অন্য রকম। একই বর্ণ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়, অনেক বর্ণের তো কোনো উচ্চারণই নেই। এধরনের গুরতর কোনো গোলযোগ নেই আমাদের ভাষায়। এ সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হয়েছে।
এবার সবচেয়ে প্রতাপশালী ভাষা ইংরেজির দিকে নজর দেওয়া যাক। ইংরেজ তার সাম্রাজ্য হারালেও ইংরেজি ভাষা তার সাম্রাজ্য হারায়নি। বরঞ্চ প্রতিনিয়ত তা আরও বিস্তার লাভ করছে। ইংরেজিতে ২৬টি বর্ণ : A B C D E F G H I J K L M N O P Q R S T U V W X Y Z. এরমধ্যে A E I O U এই পাঁচটি স্বরবর্ণ। স্বরবর্ণগুলো বাংলার মতো করে একসাথে সাজানো হয়নি। আসলে বর্ণমালা তৈরির সময় স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের পার্থক্য তারা হিসাবে আনতে পারেনি। ব্যঞ্জনবর্ণগুলো সাজাতেও কোনো নিয়ম অনুসরণ করতে পারেনি। আমাদের মতো একটি স্বরবর্ণ ( অ ) দিয়ে সব ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারিত নয়। আবার দেখুন, A স্বরবর্ণের সাহায্যে উচ্চারিত হয় J ও K ব্যঞ্জনবর্ণ (J+A = J), (K+A =K )। এ দুটি বর্ণ A থেকে কতদূরে। B C D উচ্চারিত হয় E স্বরবর্ণের সাহায্যে ( B+E = B), (C+E = C), (D+E = D)। E-এর খবর নেই, অথচ তার সাহায্যে উচ্চারিত B C D এসে গেল। আবার অনেক পরে আসলো E-এর সাহায্যে উচ্চারিত G P T V ব্যঞ্জনবর্ণগুলো। I (আই) স্বরবর্ণের সাহায্যে উচ্চারিত Y অনেক পরে। অন্যগুলোর অবস্থা তথৈবচ। F L M N R S X V ব্যঞ্জনবর্ণগুলো কোন্ স্বরবর্ণের সাহায্যে উচ্চারিত হয় তা ঠিক বুঝা যায় না। এককথায় বলা যায়, ইংরেজরা একটা জগাখিচুড়ি মার্কা বর্ণমালা তৈরি করেছে, বুদ্ধি-জ্ঞানের লেশমাত্র নেই। অন্যান্য ভাষায়ও এধরনের অনেক অবস্থা রয়েছে—যা আলোচনা করে কলেবর বাড়াতে চাই না। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আসলে ইংরেজি ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। ধার করা রোমান বর্ণ দিয়ে তাদের ভাষা লিখে থাকে। সংস্কৃত ভাষারও নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। আর আমরা চলি আমাদের নিজস্ব বর্ণমালায় ।
আবার দেখুন, ইংরেজি অক্ষরের উচ্চারণ একরকম—আর তার ব্যবহার অন্যরকম। এটা লক্ষ করেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা লিখেছেন, তা হচ্ছে : ‘ ইংরেজি শিখিতে আরম্ভ করিয়া ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ মুখস্থ করিতে গিয়াই বাঙালি ছেলের প্রাণ বাহির হইয়া যায়। প্রথমত ইংরেজি অক্ষরের নাম একরকম, তাহার কাজ আর একরকম। অক্ষর দুইটি যখন আলাদা হইয়া থাকে তখন তাহারা এ বি, কিন্তু একত্র হইলেই তাহারা অ্যাব হইয়া যাইবে, ইহা কিছুতেই নিবারণ করা যায় না। এদিকে U কে মুখে বলিব ইউ, কিন্তু UP-এর মুখে যখন থাকেন তখন তিনি কোনো পুরুষে ইউ নন। ও পিসি এদিকে এসো, এই শব্দগুলো ইংরেজিতে লিখিতে হইলে উচিতমত লেখা উচিত — O pc adk so। পিসি যদি বলেন, এসেচি, তবে লেখো she; আর যদি পিসি বলেন এইচি, তবে আরো সংক্ষেপে—he। কিন্তু কোনো ইংরেজের পিসির সাধ্য নাই এরূপ বানান বুঝিয়া উঠে। আমাদের ক খ গ ঘ-র কোনো বালাই নাই ; তাহাদের কথার নড়চড় হয় না।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও লিখেছেন, ‘ এই তো গেল প্রথম নম্বর। তারপরে আবার এক অক্ষরের পাঁচ রকমের উচ্চারণ। অনেক কষ্টে যখন বি এ = বে, সি এ = কে মুখস্থ হইয়াছে, তখন শুনা গেল, বি এ বি = ব্যাব্, সি এ বি = ক্যাব্। তাও যখন মুখস্থ হইল তখন শুনি বি এ আর = বার্, সি এ আর = কার্। তাও যদিবা আয়ত্ত হইল তখন শুনি, বি এ ডবল্-এল = বল্, সি এ ডবল্-এল = কল্। এই আকূল বানান-পাথারের মধ্যে গুরু মহাশয় যে আমাদের কর্ণ ধরিয়া চালনা করেন, তাঁহার কম্পাসই বা কোথায়, তাঁহার ধ্রুবতারাই বা কোথায়। আবার এক এক জায়গায় অক্ষর আছে অথচ তাহার উচ্চারণ নাই; একটা কেন, এমন পাঁচটা অক্ষর দাঁড়াইয়া আছে, বাঙালির ছেলের মাথার পীড়া ও অম্লরোগ জন্মাইয়া দেওয়া ছাড়া তাহাদের আর কোনো সাধু উদ্দেশ্যই দেখা যায় না। মাস্টারমশায় Psalm শব্দের বানান জিজ্ঞাসা করিলে কিরূপ হৃৎকম্প উপস্থিত হইত তাহা কি আজও ভুলিতে পারিয়াছি। পেয়ারার মধ্যে যেমন অনেকগুলো বীজ কেবলমাত্র খাদকের পেট কামড়ানির প্রতি লক্ষ্য করিয়া বিরাজ করে, তেমনি ইংরেজি শব্দের উদর পরিপূর্ণ করিয়া অনেকগুলি অক্ষর কেবল রোগের বীজস্বরূপে থাকে মাত্র। বাংলায় এ উপদ্রব নাই।’
দেখতে পাই doubt-এর b, psychology-এর p এর কোনো কাজ নেই। এরকম অগণিত শব্দ রয়েছে। A কখন অ, আ, অ্য, অ্যা, আ্যা, এ, এ্য, এ্যা হবে তা বুঝা কঠিন। আছিয়া আর এশিয়ার পার্থক্য করা যায় না—দুটোই Asia। আবার i এর উচ্চারণ কখন i এর মতো কখন y এর মতো, বা y কখন y বা i এর মতো হবে তা জানতে অনেক কষ্ট। অনেক সময়ই e এর উচ্চারণ হয়ে যায় অ্যা। O হয়ে যায় অ্যা। u কখনো আ, কখনো উ হয়। g কখনো গ, কখনো জ হয়। c কখন ক, কখন চ, কখন স হবে তা মুখস্থ করতে হবে। আমাদের মতো পৃথকভাবে লিখার ক্ষমতা ওদের নেই। door হয় ডোর, কিন্তু poor হয় পুওর; but হয় বাট্, কিন্তু put হয় পুট। (Love) লোভী হয়ে গেল লাভ। To যদি টু হয়, তাহলে Go কেন গু হয় না। পুরো ভাষা জুড়েই রয়েছে এই বিশৃঙ্খলা। ফেসবুকে দেখলাম, এক শিক্ষিকা ছোট-ছোট বাচ্চাদের সুর করে ইংরেজি NATURE এবং FUTURE শব্দ শিখাচ্ছেন এভাবে : NA—না, TU—টু, RE—রে = নাটুরে। FU—ফু, TU—টু, RE—রে = ফুটুরে। নাটুরে, ফুটুরে। ইংরেজি এরকমই। মূলত ইংরেজি শব্দগুলো মুখস্থ বিদ্যাপন্থি; বাংলা শব্দ এতটা মুখস্থপন্থি নয়, তা সুশৃঙ্খলিত ধ্বনিমূলক।
ধ্বনি বিজ্ঞানী মুহম্মদ আব্দুল হাই লিখেছেন, ‘বাংলা লিপির বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব এই যে, তা অত্যন্ত ধ্বনিভিত্তিক ( phonetic )। একটি হরফ অনেকগুলো ধ্বনির বাহন হয়ে শিক্ষার্থী কিংবা পাঠকের মনে কোনো সংশয় বা সন্দেহের উদ্রেক করে না।’
ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন ধরনের ধ্বনি উচ্চারণের ক্ষমতা খুবই সীমিত। বাংলা বর্ণ অ আ চ ছ ত থ দ ধ শ ষ ড় ঢ়-সহ আরও অনেকগুলো বর্ণের উচ্চারণের মতো উচ্চারণ করার কোনো বর্ণ ইংরেজিতে নেই। সে কারণে একজন ইংরেজ তুমিকে বলবে টুমি, দুধকে বলবে ডুড, দুর্নীতিকে বলবে ডুর্নিটি ইত্যাদি। কিন্তু একজন বাংলাভাষী এতটা বিকৃত করে অন্য ভাষা উচ্চারণ করবে না। কারণ বাংলা ভাষার মাহত্ম্যের জন্য বাঙালির শব্দ উচ্চারণের ক্ষমতা অনেক বেশি বিস্তৃত।