অত্যাচারী ইংরেজদের কাছে টেরর – “শান্তি ও সুনীতি” মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে দু’জনে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলেন, যাতে আতঙ্ক ঢুকে গেছিল ইংরেজ শাসকের মনে। কুমিল্লার গণ্ডি পার করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল দুই বীরাঙ্গনার কীর্তি।
১৯৩১ সাল, বিচার চলছে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি দুই কিশোরীর। কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স হত্যার গুরুতর অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে। এমন বন্দিদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয়, তা ভালো করেই জানে ইংরেজ সরকার। মামলার দ্বিতীয় দিনে তাঁদের বসার জন্য কোনো ব্যবস্থা রইল না ডকে।
কিন্তু ইংরেজও চিনতে পারেনি দুই কিশোরীর অদম্য জেদ আর তীব্র আত্মসম্মানকে। পুরো মামলা জুড়ে উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁরা। শেষে হার মানতে বাধ্য হল প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশরাজও। মামলার শেষ দিন পর্যন্ত চেয়ারের বন্দোবস্ত করা হয় শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরীর জন্য।
এই ঘটনা সামান্য উদাহরণ মাত্র। সময়টা উত্তাল তিনের দশক। সমগ্র দেশ জুড়ে চলছে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি। স্বাধীনতার বিপ্লবী টিকা কপালে নিয়েই বড় হয়ে ওঠা শান্তি ও সুনীতির।
১৯১৬ সালে জন্ম শান্তির। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষও সরাসরি যুক্ত ছিলেন রাজনৈতিক কাজে। ছোটো থেকেই স্বদেশি গান শেখাতেন শান্তিকে। একবার কুমিল্লায় সভা করতে এলেন সরোজিনী নাইডু। সেখানে গান ধরলেন ছোট্ট শান্তি, “ভারত আমার, ভারত আমার/ যেখানে মানব মেলিল নেত্র।” গোটা সভা মন্ত্রমুগ্ধ তাঁর গানে।
দেবেন্দ্রনাথ বললেন, “আজ তুমি যাঁর সভায় গান গাইলে, একদিন যেন তুমি তাঁর মত বড় হতে পার।”
পিতার অকালমৃত্যুর পর মা সলিলাবালা ঘোষের ছত্রছায়ায় শুরু হয় শান্তির ভবিষ্যৎ জীবনের পাঠ। না, সভার মানুষটির মত হননি তিনি, বরং দেশের জন্য কাজ করেছিলেন নিজের পথ ধরেই।
সুনীতির সঙ্গে তাঁর পরিচয় কুমিল্লার ফৈজন্নেসা গার্লস স্কুলে। তাঁদের আরেক সহপাঠিনী ছিলেন প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম। তাঁর সূত্রেই শান্তিদের পরিচয় হয় যুগান্তর দলের সদস্যদের সঙ্গে। ক্রমে শিখতে থাকেন লাঠি ও ছোরা খেলা। ময়নামতী পাহাড়ে গিয়ে অভ্যাস করলেন রিভলভার থেকে গুলি ছোঁড়া। বাহ্যিক পরীক্ষা তো বটেই, দু’জনে ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার উপর শক্তিশালী আঘাত হানার জন্য। সেই সুযোগ এসে গেল ১৯৩১ সালে।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স সাহেবকে হত্যার গুরু দায়িত্ব এসে পড়ল শান্তি-সুনীতির উপর। প্রফুল্ল থাকবেন বাইরে, প্রয়োজনে আত্মগোপন করে দলের কাজ করে যাবেন। ঠিক হল, দরখাস্ত দেওয়ার অজুহাতে দুজনে যাবেন ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোতে। আর সেখানেই সমাপ্ত হবে অত্যাচারী স্টিভেন্সের জীবন।
১৯৩১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কুঠিতে পৌঁছোলেন শান্তি ও সুনীতি। দুই বালিকাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কী আশ্চর্য সংকল্প নিয়ে তাঁরা আজ এসেছেন। সময়মতো চাপরাশি কার্ড পাঠিয়ে দিলেন ভিতরে। কিছু মুহূর্ত পরে বেরিয়ে এলেন স্টিভেন্স। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল বন্দুক। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। আর ততক্ষণে তাঁদের ঘিরে ফেলেছে শাসকবাহিনী। নির্বিচারে শারীরিক আক্রমণ চলতে লাগল তাঁদের উপরে। পালানোর কোনো উপায় নেই আর। পালাতে অবশ্য চাননি তাঁরা।
ইংরেজ শাসকের মুখের উপর ছুঁড়ে মারতে চেয়েছিলেন প্রতিস্পর্ধা। দেখাতে চেয়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য কী করতে পারে ভারতীয়রা। তাই প্রবল অত্যাচারেও তাঁদের মুখ খুলতে পারেনি পুলিশ। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’-এর চিরাচরিত পদ্ধতিও খাটেনি তাঁদের বিরুদ্ধে।
পরদিন গ্রেপ্তার করা হয় প্রফুল্লনলিনী ও ইন্দুমতী সিংহকে।
অবশেষে ১৯৩১-এর ১৮ জানুয়ারি শুরু হল বিচারপর্ব। চেয়ার না দেওয়ায় মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন শান্তি-সুনীতি। তারপর তেজস্বিতা আর উন্মাদনায় ভরিয়ে দিলেন গোটা কোর্টকে। কে বলবে, তাঁরা হত্যাকাণ্ডের আসামী? বিচারসভা হয়ে গেল তাঁদের কাছে আদর্শ প্রচারের আদর্শ মঞ্চ।
প্রায় এক বছর পর, ১৯৩২-এর ২৭ জানুয়ারি শোনানো হল যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা। এই প্রথমবার হয়ত উৎসাহে একটু ভাঁটা পড়ল তাঁদের। হতাশা যেন গ্রাস করল দু’জনকে। তাঁরা তো ফাঁসির সাজা চেয়েছিলেন। ব্রিটিশের চোখে চোখ রেখে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ার মহান সম্মান থেকে বঞ্চিত হতে হল। আসলে দু’জনেই তখন নাবালিকা। তাই শুধুমাত্র যাবজ্জীবনই বরাদ্দ হয় দুজনের জন্য।
জেলে শান্তি ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির আর সুনীতি তৃতীয় শ্রেণির কয়েদি। এখানেও সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল। তার সঙ্গে অত্যাচার নেমে এল সুনীতির বাড়ির লোকের উপরে। ভেঙে ফেলা হল তাঁর বাড়ি, গ্রেপ্তার করা হল দাদাদের। অভাব আর অত্যাচারে মৃত্যুবরণ করেন ছোটভাই। তাতেও টলানো গেল না সুনীতির সাধনা। অন্যদিকে জেলে-জেলে ঘুরে বেড়াতে হল শান্তিকে।
অবশেষে ১৯৩৯-এ মুক্তি মেলে দুজনেরই। পরবর্তী জীবনে ডাক্তারি পাশ করে জনসেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুনীতি। সাধারণ মানুষের মধ্যে কর্মমুখর থাকে শান্তি ঘোষের জীবনও। সদ্যকৈশোরের বৈপ্লবিক স্ফুলিঙ্গ সদাজাগ্রত ছিল দু’জনের মনে। তাঁদের সাহসিকতার গল্পে ভর করেই স্বাধীনতার লড়াইয়ে এগিয়ে এসেছিল বহু যুবক-যুবতী। প্রণাম সেই বীরাঙ্গনাদের।