চীন বাংলা/দক্ষিণ এশিয়া সংযোগ1
চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য, কৃষ্টিগত, কূটনৈতিক যোগসূত্র বেশ কয়েক হাজার বছরের পুরোনো হলেও প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব দেড় হাজার বছরের সময়। সংক্ষেপে। চীনের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম, উত্তর-মধ্য ভারতের বাণিজ্য, সামাজিক, ধর্মীয় যোগ নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন তানসেন সেন এবং অনেকেই বাংলা সঙ্গে চীনের বহু কাল পুরোনো গভীর যোগসূত্র তৈরি করলেও [উল্টোটাও বলা যায়] বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় উঠে আসে নি। আমাদের এই প্রবন্ধে আলোচনায় আসবে উত্তর এবং পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ, দক্ষিণ তিব্বত, নেপাল, উত্তর-মধ্য বার্মা (আজকের মায়ানমার) এবং দক্ষিণপশ্চিম চীনের (ইউনান, সিচুয়ান এবং গুইঝাউ) মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক। এই বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে ধাতু, ওষুধ, বইপত্র, তথ্য, বিভিন্ন ধর্মীয় স্মৃতিবস্তু, প্রতিমা/মূর্তি ইত্যাদি আদানপ্রদান, ব্যবসা হত। এই কাণ্ডটা ঘটত মুদ্রা মাধ্যমে দেওয়া নেওয়ার মাধ্যমে।
রীলা মুখার্জী বলছেন, ভারতবর্ষের সঙ্গে চীনাদের সংযোগ তৈরি করার তিনটে বাধ্যবাধকতা ছিল—
- মধ্য এশিয় যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণ থেকে সীমান্ত রক্ষার জন্যে সামরিক সাহায্যের আশা;
- মধ্য এশিয়ায় স্থলপথ পরিবহন রাষ্ট্র বিপ্লবে অগম্য হয়ে পড়লে জলপথ পরিবহন ব্যবস্থা সচল রাখার উদ্দেশ্য;
- চৈনিক বৌদ্ধতন্ত্রের প্রামাণিকতা এবং মূলানুগত্য বজায় রাখার জন্যে ভারতবর্ষ থেকে নানান শাস্ত্র এবং শিক্ষক নিয়ে যাওয়া।
একই সঙ্গে তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, ভারত কেন চীনের সঙ্গে যোগ রাখত? সে বিষয়টা আজ আর খুব বেশি পরিষ্কার নয়, হয়ত নিরাপত্তা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে তৈরি করার জন্যেও বাংলা চীনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত।
গুপ্ত রাজারা চীন থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় আসার ব্যবসা রাজপথে (যাকে আমরা রেশম পথ বলে থাকি) চীন, তিব্বত এবং নেপাল রাজত্বের সম্ভাব্য আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে বেশ কিছু থানা চৌকি তৈরি করেছিল। শুধু বাধা দেওয়াই নয়, পরস্পরের সঙ্গে যাতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে যোগাযোগ রাখা যায় সে বিষয়েও রাষ্ট্র প্রধানেরা সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ইৎ সিং লিখছেন— গুপ্ত রাজত্বের সময় পূর্ব রেশম রাজপথে একটা আলাদা ‘চীনাপথ’ তৈরি হয়। চীন থেকে যে সব শিক্ষার্থী ভারতবর্ষে পাঠ নিতে আসত, তাদের সুবিধের জন্যে গুপ্ত রাজারা দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে চৈনিক দেব মন্দিরও তৈরি করেছিলেন।
রেশম পথজুড়ে শত শত বছর ধরে যুদ্ধ অভিযান, ধর্মীয় প্রবজন, রাজীয় দৌত্য সম্পাদিত হয়েছে। পরস্পরের মধ্যে আদানপ্রদানের ফলে বৌদ্ধিক মতবাদ, ধার্মিক তত্ত্ব, শিল্পকলা, যুদ্ধাস্ত্র প্রযুক্তিরও হাত বদল ঘটেছে। রেশম রাজপথ আমাদের অতীত গৌরব তৈরি করেছে। এই রাস্তা বেয়ে যে পণ্য, ভাবনা, কৃষ্টির আদানপ্রদান হয়েছে সেসব বিষয় জানা, বোঝা এবং নতুন তথ্যের আবিষ্কার আমাদের ব্রিটিশপূর্ব ভারতবর্ষের ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। আমরা এই পর্বে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি বাণিজ্যপথ নিয়ে আলোচনা করব।
জাপানের টোয়ো বুঙ্কো (Toyo Bunko) গবেষণা জাদুঘর সংগঠনের দ্য ডিজিটাল সিল্ক রুট প্রজেক্ট, রেশম পথকে তিনটে রাস্তায় ভাগ করেছে—
প্রথম যুগের স্তেপ রাজপথ [আজকের মঙ্গোলিয়া, রুশ, কাজাকস্তান থেকে কৃষ্ণসাগর ভূখণ্ড],
পরের দিকের তৈরি হওয়া মধ্য এশিয় মরুদ্যান রাজপথ [তিব্বত, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিছুটা উত্তর ভারত; যে উত্তরাপথকে টেনে নিয়ে গেছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত] এবং প্রখ্যাত সমুদ্রপথ যেটি আদ্রিয়াটিক সাগর, কৃষ্ণ সাগরকে ভারত মহাসাগরে জুড়েছে।
শেষ পথটি পরের সময়ের আবিষ্কার। মাথায় রাখা দরকার চীন আর দক্ষিণ এশিয়াকে যোগ করা রেশমপথ একটামাত্র রাস্তা নয়, বরং বহু রাজপথ, উপপথ, শাখাপথের সমাহার যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণটি ছিল মধ্য এশিয় মরুদ্যান রাজপথ।
২৩৯ থেকে ২৬৫ খ্রি-র মধ্যে ইউ হুয়ান সম্পাদিত Wei Lue নথি সূত্রে তিনটে রেশম পথের উল্লেখ পাচ্ছি;—
- ইয়ুমেন (জেড দরজা) আগুয়ান থানা থেকে পশ্চিম দিকে চুয়ো কিয়াং (দুর্বিনীত কিয়াং) পর্যন্ত [গিয়ে] আরও পশ্চিমে ঘুরে কংলিং (পামির) অতিক্রম করে জুনডুতে (উত্তর হুনজার ঝুলন্ত পথ) প্রবেশ করে সেখান থেকে কুশানদের রাষ্ট্রে প্রবেশ করতে হবে। এটা দক্ষিণ রাজপথ।
- ইয়ুমেন থেকে পশ্চিমে জেড দুয়ারের আগুয়ান থানা পেরিয়ে, দাদুজিং পেরিয়ে, সাংলোংশার (তিন বালুর শৈলশিরা) উত্তরপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে জুলুকাং (গুদামময় বাসস্থান) পেরিয়ে সাক্সিজিংএর (বালুর কুঁয়ো) পশ্চিম [অঞ্চল] পেরিয়ে উত্তরপশ্চিমে মুড়ে লংডুই (ড্রাগনদের বালিয়াড়ি) পেরিয়ে পৌঁছবেন প্রাচীন লৌলান রাজত্বের পশ্চিম দিকের কিউসি (কুছা); সেই পথ কংলিংএ (পামির) পড়েছে। এটা মধ্য রেশম রাজপথ।
- ইয়ুমেন থেকে পশ্চিমে জেড দুয়ারের আগুয়ান থানা পেরিয়ে, হেংকেং (পূর্ব-পশ্চিম গলি = বেশ-টোঘরাক উপত্যকা) থেকে বেরিয়ে সাংলোংশা (তিনটি বালুর শৈলশিরা) এবং লংডুই (ড্রাগনদের বালিয়াড়ি) না ছুঁয়ে উত্তরে উচুয়ানে (পাঁচ নৌকো) পৌঁছে গাওচাংএর জুসিতে (তুর্ফানের ৪৭ কি. মি. দক্ষিণপূর্বে) মাও (উ) এবং জি সেনাপতির (কৃষক সেনাবাহিনীর দায়িত্বে থাকা) শহরে পৌঁছতে হবে। এখান থেকে পশ্চিম দিকে কিউসির (কুছা) রাস্তায় পড়বে। এটা নতুনতম রাজপথ।
ওপরে তিনটি রাস্তার দক্ষিণ রাজপথ উত্তর পশ্চিম ভারতবর্ষে যাচ্ছে। Wei Lueতে কিন্তু সে সবের দক্ষিণ এশিয়া ভূখণ্ডের পূর্বাঞ্চলে আসার রাস্তার কথা উল্লেখ নেই।
চতুর্থ বা দক্ষিণ রাস্তা
তিনটি রাজপথ ছাড়াও আরেকটি দক্ষিণপথ তার বিভিন্ন শাখাপথ নিয়ে পশ্চিম দিকে বিস্তৃত ছিল–
- কুইয়েমো রাজত্ব (চেরচেন), জয়াওয়ুয়ান (ছোট্ট উয়ান কুয়েজহির দক্ষিণে তিন মার্চের(?) পথ), জিংজুয়ি রাজত্ব (নিয়া), লৌলান রাজত্ব (লোপ নরের উত্তরে) সব কটা শানশানের রাজস্বদায়ী রাজত্ব;
- রংলু রাজত্ব (জিংজুয়ি বা নিয়া), হানমি (কেরিয়া), কিউলি রাজত্ব (কেরিয়ার দক্ষিণে) এবং পিকাং রাজত্ব (আজকের পিশান বা গুমা)–এগুলি সব উতিয়ান বা খোটানের রাজস্বদায়ী রাজত্ব;
- জিবিন রাজত্ব (গান্ধার-কাপিশা), ডাক্সিয়া রাজত্ব (ব্যাক্ট্রিয়া), গাওফু রাজত্ব (কাবুল), উত্তর তিয়ানজু রাজত্ব (উত্তর ভারতবর্ষ)–এগুলি সব দা ইউয়েঝি (কুশান) রাজত্বের রাজস্বদায়ী।
আমরা দেখলাম চীন থেকে ভারতবর্ষের দিকে আসার রাজপথ আলোচনায় শুধুই উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে আসার পথের কথা বলা হয়েছে, ভারতের পূর্বাঞ্চলের কথা অধিকাংশ লেখাপত্রেই অনুল্লিখিত। তাহলে কী তখন চীন থেকে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে আসার কোনও রাস্তাই জানা ছিল না? চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে চীন থেকে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে আসার পথের উল্লেখ পাচ্ছি, যদিও পথটি বিখ্যাত হয় পরের শতাব্দ থেকে। ইউনান থেকে মায়ানমার হয়ে পূর্ব ভারতবর্ষে আসার দক্ষিণ রেশম পথ তৃতীয় শতাব্দ থেকেই খুবই জনবহুল যাত্রীবহুল রাস্তা এবং সপ্তম শতাব্দে এই রাজপথ থেকে বহু শাখা রাস্তা বেরিয়েছে অর্থাৎ পথটি ক্রমশ জনবহুল হচ্ছে। শুরুতে এটি মূলত নদী/সমুদ্রপথ ছিল। কিন্তু জলপথের পাশাপাশি ভূমিপথ আবিষ্কৃত হয় এবং পথ বাণিজ্য ব্যবস্থার কাঠামো তৈরি হয়। পথটি তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বে জানা থাকলেও সপ্তম শতক পর্যন্ত পেশোয়ার হয়ে উত্তরপশ্চিম ভারতবর্ষ মার্ফৎ পূর্বাঞ্চলে আসার এই রাস্তাই বহুল ব্যবহার হয়েছে। কারণ সেই সময় পর্যন্ত চীনা সূত্রে বার বার কুশান রাজত্বের উল্লেখ পেয়েছি। এর ফলে গান্ধার অঞ্চলের গুরুত্ব সম্বন্ধেও অবহিত হয়েছি। চীন ১২৭ খ্রিস্টপূর্বতে তারিম উপত্যকা দখল নিলেও চীনা তুর্কিস্তানের সঙ্গে কুশান রাজত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় ছিল। Wei Lueতে পূর্বাঞ্চলে আসার পথের অনুল্লেখ থেকে কী আমরা আন্দাজ করতে পারি, সে সময় পথটি কোনও কারণে অব্যবহার্য হয়ে পড়েছিল?
গুপ্ত আমল থেকে চীনা সূত্রে ভূমি এবং সমুদ্র পথে বাঙলার দিকে আসার উল্লেখ পাচ্ছি। ইয়ুনান আর উজানি মায়ানমারের মধ্যের শান রাজত্বের ভামো ছিল গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। এটি কামরূপ, পুণ্ড্রবর্ধন, কজঙ্গল [রাজমহল] চম্পা [ভাগলপুর] হয়ে ইউনান আর পাটলিপুত্রের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করেছে। হরপ্রসাদ রায় লিখছেন ‘সপ্তদশ শতকেই ডালি থেকে বর্মা হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশের রাস্তাপথ বিশদে বর্ণিত হচ্ছে। জিন তাংশু (তাং রাজত্বের নতুন ইতিহাস) দিলি ঝি (ভূগোল) অধ্যায়ে আমরা ডালি থেকে বার্মার প্রাচীন তাগাউং শহর পর্যন্ত ৭০০ কি. মি. এবং সেখান থেকে বার্মার প্রাচীন রাজধানী পিয়ুসের (পুগান) ৫০০ কি. মি. দূরত্বের হিসেব পাচ্ছি। পিয়ুস থেকে ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন এবং মধ্য প্রবাহের কামরূপের দূরত্ব ৮০০ কি. মি.; সে শহর থেকে উত্তরবঙ্গের পুণ্ড্রবর্ধনের দূরত্ব ২০০ কি. মি. এবং সেখান থেকে গঙ্গার তীরে মগধ আরও ৩০০ কি. মি.। আরেকটি রাস্তা ঝুগি লিয়াং মাইটিকিনা, মোরাং হয়ে ৮০০ কি. মি. পথ পরিক্রমা করে মণিপুরে প্রবেশ করে [নাম দাকিন বোলোমেন, দক্ষিণের ব্রহ্মদেশ] শেষ হয়েছে আরও ৭০০ কি. মি. দূরের পুণ্ড্রবর্ধনে। হিউএনসাং মগধ থেকে কামরূপের দূরত্ব কষছেন ১২০০ কি. মি.’।
চীন থেকে সাসানিয় সাম্রাজ্যে রেশম রপ্তানি হচ্ছে সমতট হয়ে
আমরা আজকের উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের উল্লেখ পাচ্ছি চৈনিক ইতিহাসে, ‘ডোঙ্গলি রাজত্বের (প্রাচ্য দেশের) কেন্দ্রস্থল হল শাকী [সাকেত, হয়ত সাঁচি; কিন্তু বর্তমানের গবেষণায় জানাগেছে এটি কোশল রাজত্বের রাজধানী অযোধ্যা]। শাকী শহরের অবস্থান তিয়াঝু’র [উত্তরপূর্ব ভারত] থেকে ৩০০০ লি [১২৪৭ কি. মি.] দক্ষিণ পূর্বে। এই অঞ্চলে তিয়াঝু’র মতই একই ধরণের পণ্য উৎপাদন হয়। ডোঙ্গলি রাজার শাসনে এক ডজনেরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ শহর আছে [সেগুলোর মধ্যে বারানসী, শ্রাবস্তী অন্যতম]। দা ইউয়েঝি এই অঞ্চল আক্রমন এবং পদানত করেন। এখানকার পুরুষ নারী ৮ চি[১.৮৫ মিটার] লম্বা কিন্তু ভয়ঙ্কর ভিতু। হাতি বা উটে চড়ে তারা পাশের রাজত্বগুলো ঘুরতে যায়। যুদ্ধের সময় তারা হাতি বাহিত হয়ে যুদ্ধ করে’। এই বয়ানে অন্তত চরম ২টো গলতি আছে প্রথমত প্রজাদের অস্বাভাবিক উচ্চতা আর দ্বিতীয়ত খোটানের রাজা, বিজয় কীর্তি আর কুছা রাজার সহায়তায় ১২৭এ অযোধ্যা আক্রমন করেন।
বাংলার আসায় পথ, গুপ্তযুগে বহুল ব্যবহারে ক্রমশঃ আরও পরিষ্কার, আরও চলাচল উপযোগী হয়ে উঠছে। উপনিবেশপূর্ব সময়ের বাংলায় যত ভূদান হয়েছে, সেসবে উত্তর এবং দক্ষিণ বাংলাকে যোগ করা স্থলপথ আর জলপথ আর সাসানিয় রাজপথের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া শাখাপথগুলোর বর্ণনা পাচ্ছি। মূল রাজপথটি ধরে পশ্চিমে পাটলিপুত্র, পূর্বে মায়ানমার এবং গৌড় এবং কামরূপে চোল এবং পূর্ব চালুক্যদের আক্রমন চালানোর তথ্য থেকে পরিষ্কার হয় যে দক্ষিণ রাজত্বগুলো পর্যন্ত যাত্রাপথ বেশ সুগম ছিল। ১০৯০এর চোল ব্যবসায়ী পেশাদারদের সংগঠন [গিল্ড] পাণ্ডিয়েন-বিশ্যমের নাগাপট্টিনাম শিলালিপিতে ১৮টি দেশের নামোল্লেখের মধ্যে বঙ্গম বা বাংলার নাম পাচ্ছি। সাত শতাব্দেও পূর্ব রেশমপথ ব্যবহার হচ্ছে। ডালি ইউহানের শিলালেখ এবং আঞ্চলিক মূর্তিগুলি বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারি, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল থেকে মূর্তি, বই, ধর্মীয় তত্ত্ব এবং সাধারণভাবে মানুষও ডালি রাজত্বে পৌঁছচ্ছে।
দক্ষিণের রেশমপথ এবং তার উপপথ
রেশমপথের চরিত্র অনড়ও নয়, অচলও নয় বরং ভয়ঙ্কর রকমের অস্থির; প্রাচ্যের কোনও কিছুই প্রাচ্যবাদী তাত্ত্বিকদের স্বপ্ন সফল করতে চিরকাল অপরিবর্তিত থাকে নি, কালের প্রবাহে রেশমপথও পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত হয়েছে। নতুন সময়ে, নতুন দাবি, নতুন চাহিদা পূরণে ব্যবসা, ধর্ম, কূটনীতি প্রসারিত হয়েছে, বৌদ্ধিক, জ্ঞানী এবং তীর্থযাত্রীর আনাগোণা বেড়েছে, নতুন নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে, রাস্তা চিহ্নিত করার নতুন বয়ান উঠে আসছে – রেশম পথকে কেউ পশম পথও আখ্যা দিচ্ছেন ক্রমশঃ পথ বাহিত পণ্যের সুবাদে।
দক্ষিণের রেশমপথের বৈচিত্র এবং ভারতবর্ষের পানে আসা দক্ষিণপশ্চিম রেশমপথ
সপ্তদশ শতে ভারতে আসার দক্ষিণ রেশম পথের ওপর তাং রাজত্বের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ঢিলে হওয়ার ফলে আঞ্চলিক ভূগোল-তথ্যের বহুল বিস্তার ঘটছে। মধ্য এশিয়া রেশমপথে আরব দখলদারির ফলে চীন, দীর্ঘকালের দাকিন অঞ্চল অর্থাৎ রোমক প্রাচ্য [ভূমধ্যসাগর এবং মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস অঞ্চল] পর্যন্ত রাস্তার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। ৬৩৮এ আরবেরা এন্টিওক এবং ৬৬১ থেকে ৬৭৫এর মধ্যে কন্সট্যান্টিনোপল আক্রমন করে দখল নেয়। পারসিক আর নেওস্টোরিয়ানেরা চীনে পৌঁছয়। তারিম উপত্যকা দখলের জন্যে তিব্বতি, পশ্চিমা তুর্কি এবং তাং সাম্রাজ্য নিরন্তর লড়েছে; তিব্বতিরা তাং চীন আক্রমন করে ৬৬২-৬৭০তে।
ফলে উত্তর মায়ানমার হয়ে ভারতবর্ষে আসার পূর্ব রেশমপথের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে ক্রমশ। সপ্তম শতকের পরের সময়ের ৬৯১, ৮০৭/৮১০, ৮৬৩ এবং ১০৬০এর চীনা সাহিত্যে, নথিতে পূর্বপথের বিস্তৃত উল্লেখ পাচ্ছি। তিন শতক থেকে চেনা জানা সেজুয়ান, ইয়ুংচ্যাং, তিব্বত হয়ে ভারতে আসার শাং-কো পথটি সব থেকে ছোট রাস্তা হলেও সাত শতক থেকে নেপাল রাস্তাটি তাং-সাসানিয় রেশম পথ হিসেবে বহুল প্রচলিত হচ্ছে। মাথায় রাখতে হবে রেশম কিন্তু চীন থেকে বঙ্গোপসাগর বাহিত হয়ে ভূমিপথে সমতট হয়ে হর্ষবর্ধনের রাজধানী পাটলিপুত্র, নেপাল পৌঁছচ্ছে। রকহিল চীনা নথি চাউজু-কুয়া অনুবাদে বলছেন সাত শতক থেকে ভারতবর্ষে আসার ভূমিপথ এবং সমুদ্রপথের ক্রমবিস্তার ঘটছে। সাত শতের দ্বিতীয়ার্ধে ক্যান্টন থেকে হো-লিং (জাভা), পালেম্বাং (সুমাত্রা), নিকোবর এবং শ্রীলঙ্কা হয়ে তাম্রলিপ্তি আসার সমুদ্রপথ বহুল ব্যবহার হচ্ছে। একইভাবে আট শতকে আগের সমুদ্রপথটি থেকে আরও একটি ফ্যাকড়া সমুদ্রপথ মায়ানমারের শ্রীক্ষেত্র থেকে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটছে।
এটাই নতুন বড় রেশম পথের অংশ যাকে আমরা বলব দক্ষিণ পশ্চিম রেশমপথ
শু-ইয়াণ্ডু দাও (সিচুয়ান থেকে ভারতে যাওয়ার রাস্তা) ছিল দক্ষিণ পশ্চিম রেশমপথের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শুরু হয়েছে শিচুয়ানের রাজধানী চেংডু থেকে …এবং চেংডুর পরের একঘন্টার রাস্তার শহর গুনঘান থেকে। চেংডু থেকে বেরিয়ে ইয়ুনানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা শহর কুনমিং থেকে ডালি থেকে দুটো রাস্তা বেরিয়েছে। উত্তর রাস্তাটা চেংডু, লিংকিয়ং (কুইইয়ংলি), লিংগুয়ান (লুশান), জুওডু (হানিউয়ান), কিয়ংডু (জি-চ্যাং), কুইংলিং (আজকের দায়ায়ো, ইয়ুনানের ঢুকে), দাবোনং (আজকের জিয়ানগিয়ুম) এবং ইয়তেয়ু (দালি) শহরগুলোর হৃদিঅক্ষ ছুঁয়েছে। এই রাস্তা যেহেতু বাধ্যতামূলকভাবে লিংগুয়ান (লুশান) গিরিখাদ হয়েই গিয়েছে, তাই রাস্তাটির নাম লিংগুয়ানএ যাওয়ার রাস্তা (লিংগুয়ান দাও)। দক্ষিণের রাস্তাটি গিয়েছে চেংডু, ইয়িবি (এখানে অনেকটা গার্বেজ হয়েছে, লাইনটা পড়া যাচ্ছে না) বোনাম যাওয়ার পথ টি ইয়ংচ্যাং এবং টেগিয়ু হয়ে বার্মা হয়ে (পূর্ব)ভারতবর্ষে ঢুকেছে।
শাখা পথ হিসেবে মায়ানমার থেকে দুটি ভূমিপথ পূর্ব ভারতবর্ষে ঢুকেছে। ৮ শতকের সার্বিক ভূমিপথ মোগাউং থেকে কামরূপ হয়ে মগধ অবদি বিস্তৃত ছিল; এটি উত্তর মায়ানমার এবং শান প্রদেশ ছুঁয়ে ভারতে ঢুকত। আরেকটা ইয়াংচ্যাংফু (ইউনান) থেকে হয় শ্রীক্ষেত্রে, না হয় হালিয়াংগাই [এলাকা কোনটা পরিষ্কার নয়], পিউ, ছিন্দউইন হয়ে কামরূপে ঢুকেছে—এই রাস্তা মধ্য ইরাবতী উপত্যকাকে জুড়েছে পূর্বভারতের সঙ্গে। চীন-কামরূপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মহাভারতে কামরূপের অতীত নাম প্রাগজ্যোতিষের রাজা ভগদত্তের সেনা বাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, taking away by the prowess of his arms the golden crown of the Chinese (তাঁর অস্ত্রশক্তি চীনা সম্রাটের সোনার মুকুট কেড়ে নিতে পারে)।
হাতি-চা-ঘোড়া বাণিজ্যের রেশমপথ
৯০০ খ্রিপূতে চেংজিয়াং গাও বা হাতি চড়াদের দেশ হিসেবে আসাম বা ভারত-চৈনিক রেশম পথে টাই প্রদেশ হিসেবে কোনও এক অনির্দেশ্য জায়গা বর্ণনার উল্লেখ পাচ্ছি। মনে হয় এটা রেশম পথ থেকে বেরোনো রাস্তায় পড়ে। আরেকটা বৈচিত্রের রাস্তাকে চা-ঘোড়া বাণিজ্যের রাস্তা হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে—সেটা হল ইয়ুনান থেকে সিচুয়ান হয়ে তিব্বত এবং ভারতের দিকে আসার রাস্তা। এই রাস্তায় চা আর ঘোড়া, এই দুটো প্রধান পণ্য বাণিজ্য হত। এটার নাম ছিল জাং চা-মা গুদাও (ইয়ুনান আর তিব্বতের মধ্যে চা এবং ঘোড়া বাণিজ্যের প্রাচীন রাস্তা)। এই তরাই পথটি মধ্য বাঙলা অবদি বিস্তৃত ছিল।
ইয়ুনান এবং উজানি মায়ানমার থেকে বাংলায় ১২০০-১৫০০ অবদি দামি ধাতু আমদানি (মাথায় রাখতে হবে ৪ ধরণের মুদ্রার যে চারটি উপাদান সোনা (মোহর), রূপো (রূপিয়া), তামা (দহ্ম বা দাম) আর কড়ি (খুচরো মুদ্রা, আজকের ভাষায় কানাকড়ি, কড়িকে ফুটো করে দড়ি বা ধাতব পাত দিয়ে বেঁধে রাখা হত)—কোনওটাই দক্ষিণ এশিয়ায় মিলত না, ফলে দক্ষিণ এশিয় বাজারে অন্য বিদেশি পণ্যের চাহিদা না থাকলেও এই চার উপাদানের ব্যাপক চাহিদা ছিল) নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জন ডেয়েল সমুদ্র/জলপথ ছাড়াও পরস্পরকে ছেদ করা তিনটে ভূপথের কথা বলছেন। তিনটেই ইয়ুংচ্যাং থেকে শুরু হয়ে উজানি মায়ানমার পেরিয়ে পশ্চিম দিকে এসে বাংলায় ঢুকেছে। প্রথমটি ইয়ুংচ্যাং থেকে শুরু হয়ে মোমেইন এসে ইরাবতী পেরিয়ে মোগাউংএ ঢুকে উত্তরে হুকং উপত্যকা ছেদ করে পাটকাই পর্বতমালা পেরিয়ে উজানি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় পড়েছে। এটা কামরূপের পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল এবং পথটা ৮ম শতে অবশ্যই বেশ জনপ্রিয় ছিল। একই সময়ে দ্বিতীয় রাস্তাটা শেউলি উপত্যকা পেরিয়ে ইরাবতী পেরোচ্ছে তাগাউং এবং তারপরে ছিন্দউইন নদী ধরে উত্তরে পৌঁছে ইমোল গিরিখাত পেরিয়ে মণিপুরে প্রবেশ করেছে। জায়গাটা হল ত্রিপুরা হয়ে বাঙলা ঢোকার আগের পূর্বভারত সীমান্ত। তৃতীয় রাস্তাটা ইরাবতী পেরিয়ে তাগাউং, আভা বা বাগান হয়ে শ্রীক্ষেত্র পেরিয়ে আরাকানের আরাকান পর্বতমালা পেরিয়ে ভারতে ঢুকছে। আরেকটা ফ্যাকড়া রাস্তা বাগান থেকে আইয়ান গিরিপথ হয়ে সোজা আরাকানে পৌঁছেছে। এই রাস্তাটা বণিকদের হয় উত্তরের দিকে এসে চট্টগ্রামে এসে ভূমিপথ ধরাবে অথবা বাংলায় আসতে জলপথ ধরাবে।
কামরূপ/আসাম কেন্দ্রিকতা
নাসির আহমেদ আসাম-বেঙ্গল ট্রেড ইন মেডিভ্যাল পিরিয়ড প্রবন্ধে রেশমপথের কামরূপ-কেন্দ্রিকতার বেশ কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছেন।
চীন থেকে আসাম হয়ে বাংলায় আসার দুটো রাস্তা ছিল – একটা নদীপথ অন্য দুটি সড়ক পথ। ব্রহ্মপুত্রে পণ্য পরিবহনের শস্তা, গতিশীল, সুবিধেজনক। সড়ক পথের একটা রাস্তা তেজপুর (দরং জেলা) থেকে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরে কামরূপ আর গোয়ালপাড়া হয়ে সুলতানি আমলের বাংলার রাজধানী লখনৌতি আসত। শিবসাগর থেকে আরেকটি রাস্তা নওগাঁ-গুয়াহাটি হয়ে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে, ব্রহ্মপুত্রকে দক্ষিণে রেখে কামরূপের তেজপুর বরপেটায় এসে মিলত। আরেকটি রাস্তা শিবসাগর থেকে জয়ন্তিয়া পাহাড় বেয়ে সিলেট ময়মনসিংহ হয়ে সোনারগাঁওতে (ঢাকা) এসেছে। পরের রাস্তাটি নদী বন্দর ঢাকায় (সোনারগাঁও) এসে সমুদ্রপথ ধরার জন্যে ব্যবহৃত হত। আবার লখনৌতি থেকে কামরূপ হয়ে তিব্বত পৌঁছনো যেত। মহামহী দারা গিরিপথ হয়ে কামরূপ আর তিব্বতের যেতে ৩৫টা গিরিপথ পেরোতে হত। কাশ্মীর থেকে কোহিরাকাচাল (কুমায়ুন পর্বতশৈলী) হয়ে, পাটকি পাহাড় হয়ে উজানি বার্মা মধ্যে দিয়ে চীনের ইয়ুনানে পৌঁছবার একটা দীর্ঘ রাস্তা ছিল। এই রাস্তায় লখনৈতি থেকে একটা শাখা রাস্তা জুড়ত। এই তিনটে রাস্তা লখনৌতি-তেজপুর, লখনৌতি-তিব্বত এবং লখনৌতি-চীন রাস্তা মাঝেমধ্যে কোনও কোনও যায়গায় একটাই রাস্তা হিসেবে জুড়ে আবার আলাদা হয়েছে।
এই রাস্তাগুলো ভারতবর্ষজোড়া রাজপথগুলোর সঙ্গে মিলেছে
মুঘল মুদ্রায় থাট্টা, আহমেদাবাদ, সুরাট, বিজাপুর, আরকট, লখনৌ, এলাহাবাদ, পাটনা, আকবরনগর (রাজমহল) এবং জাহাঙ্গিরনগরের (ঢাকা) নাম পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলোর খনন স্থান বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি কোন পথে বিশাল বাণিজ্য কাফেলা গুজরাট বন্দর থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তেজপুর হয়ে উজানি অসমের বালিয়াপাড়া এবং শিবসাগর পৌঁছচ্ছে। একই সূত্রে জানছি কীভাবে পাকিস্তানের থাট্টা থেকে বণিকদের মস্ত কাফেলা লখনৌ ছুঁয়ে আসাম পৌঁছচ্ছে। গুজরাতের আহমেদাবাদ থেকে আসাম যেতে কাফেলাগুলোকে এলাহাবাদ, পাটনা, রাজমহল পেরোতে হত। আসামের গোলমরিচ সুরাট হয়ে ??? পতন ঘটে। কাশ্মীরের রাস্তাটি পরে কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যরাস্তায় মিশেছে… আসামের ১৭ এবং ১৮ শতের প্রথম দিক পর্যন্ত সরাসরি ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল কাবুল (আফগানিস্তান), সিন্ধু (পাকিস্তান) এবং গুজরাটের সঙ্গে। জাহাঙ্গির নগরের মুঘল আমলের মুদ্রা আসামে পাওয়া গিয়েছে। মনে হয় এই সময়ে নিম্নবঙ্গের সঙ্গে আসামের বাণিজ্যপথের যোগাযোগ ছিল।
আসাম থেকে ক্যারাভান রাস্তা বাংলায় ঢুকে সর্বভারতীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ত। সপ্তদশ শতে মধ্যবঙ্গ থেকে রাজপুথ বেরিয়ে খণ্ডেশ, মালব, আগরা হয়ে গুজরাট বা উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছত। শাখা রাস্তাগুলো পূর্ব উপকূলের বন্দরকে মূল রাস্তার সঙ্গে জুড়ত। উদাহরণস্বরূপ ১৭ শতে প্রাচীন তাম্রলিপ্ত/তমলুক আর পুরীকে জুড়ত বর্ধমানের রাস্তা; একইভাবে ওডিসার সঙ্গে মুঙ্গেরের যোগ ছিল বিষ্ণুপুর রাস্তা মার্ফৎ। এটাই ছিল ১৭ শতক অবদি বড় রাজপথ; অন্যগুলো চীন থেকে সুবর্ণগ্রাম-রাজমহল-পাটনা-প্রয়াগ-বানারস-আগরা হয়ে চলে যেত কাবুল আর মুলতান।
নেপাল রাস্তা
মধ্য এশিয়া এবং চীন থেকে বাংলা, বিহার, মধ্য ভারতবর্ষের বৌদ্ধ ধর্মস্থলে দ্রুত পৌঁছবার রাস্তা ছিল নেপাল হয়ে। এ রাস্তা ৬১৮য় তাং রাজত্বের আগে জনপ্রিয় হয় নি। পথটা তৈরি হওয়ার আগে চীন থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় পৌঁছনোর জন্যে বণিকদের স্বার্থবাহকে পশ্চিম দেশ ঘুরে পামীর, কাশ্মীর, সিন্ধু উপত্যকা পেরোতে হয়েছে। বিশ্ব ইতিহাসে নেপালের উল্লেখ পাচ্ছি ৪ শতক থেকে। তার আগে ভারতবর্ষের ব্যবসায়ী/ধর্মতাত্ত্বিক, নেপাল হয়ে চীন আর মধ্য এশিয়া যাওয়ার রাস্তা জানত বলে মনে হয় না।
নেপাল এশিয় ব্যবসাপথে ঠিকঠাকভাবে ঢুকল সাত শতকে, নেপালরাজ অংশুবর্মন বজ্রযানী এবং মহাযানী বৌদ্ধপন্থে দীক্ষিত হওয়ার পরের সময় থেকে। নেপালের মধ্যে দিয়ে দ্রুত ভারত থেকে চীনের পৌঁছনোর রাস্তাটি আবিষ্কৃত এবং তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়ও হল। রাজা চন্দ্রদেব বা প্রচণ্ডদেব, গৌড় সিংহাসন ছেড়ে স্বয়ম্ভূনাথ মন্দিরে বৌদ্ধপন্থে দীক্ষিত হয়ে শান্তিকর আচার্য নামে প্রখ্যাত হলেন। ইতিহাস তাঁকে চিনল নেপালে বজ্রযান-তন্ত্রযানের জ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রধানপুরুষ রূপে। শান্তিকর আচার্য কাঠমাণ্ডু উপত্যকার প্রথম তন্ত্রাচার্যরূপে আজও স্বীকৃত। এই সময়ে তাং সাম্রাজ্য স্থিতিশীল হলে মহাযান বৌদ্ধপন্থ ক্রমশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। চীন থেকে নেপাল হয়ে সরাসরি উত্তর ভারতে আসার পথ বাণিজ্য এবং তীর্থপথ হিসেবে পরিচিত হল। চীন থেকে সাসানিয় পারস্যে যাওয়ার রাস্তাটি সাত শতের প্রথম দিকে তিব্বতের সংসেনগাম্পো, কামরূপের ভাষ্করবর্মণ এবং উত্তর ভারতের হর্ষবর্ধনের রাজত্বকে জুড়েছিল।
সাত এবং আট শতে কামরূপ আর কুয়ংমিংটানে সাপ/ড্রাগন মিথের প্রচলনকে আমরা দীর্ঘকালের আঞ্চলিক কৃষ্টিগত যোগাযোগের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবেও গণ্য করতে পারি। সাত শতে চীনের প্রথম পাদে মঞ্জুশ্রী পন্থটি কাঠমাণ্ডুতে এসে স্বয়ম্ভূনাথ প্রতিষ্ঠা করে; পরিবর্তন স্থিতিশীল হল, কারন উপকথায় বলা হচ্ছে কাঠমাণ্ডু উপত্যকায় নাগ অধ্যুষিত একটি হ্রদ পরিষ্কার করে চীনা কাঠামোয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হল এবং চীনা সম্রাট নেপালের সিংহাসনে বসলেন। চীনা সম্রাটের নাম হল ধর্মকর। ভারতবর্ষের ধর্মপাল রাজা হলে নেপালের জীবনযাত্রায় চীনের প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় প্রভাব স্থায়ী হতে শুরু করে। নান ঝাও তু-চুয়ান এবং তার সময়ের নথিপত্র আমাদের জানাচ্ছে ৬৪৯এ চীনের রাজধানীটি দালি থেকে কুংমিংএ সরে গেলে চীনেও বৌদ্ধ প্রভাব বেড়েছে দ্রুত হারে। সেখানে ড্রাগন ভর্তি একটি হ্রদ পরিষ্কার করা হল। ৮৮০তে কুংমিংকে পূর্বাঞ্চলের রাজধানী ঘোষণা করা হয়। ৮৮৯ থেকে চৈনিক বর্ষপঞ্জীকে বাদ দিয়ে সংস্কৃত জয় বর্ষপঞ্জীকে গ্রহণ করা হলে চীন আর ভারত আরও কাছাকাছি আসে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় অন্যান্য ঘটনাও সমান্তরালভাবে ঘটতে থাকে। ভারত থেকে খোটান হয়ে মঞ্জুশ্রী কিংবদন্তী চীনে প্রবাহিত হওয়ায় সময়, প্রথম শতে খোটানের রাজা চীনা রাজকুমারীকে বিয়ে করলে রাজকুমারীর হাত ধরে খোটানে রেশম চাষ শুরু হল। সাত শতাব্দে তিব্বতের সংসেনগাম্পো নেপালের রাজা অংশুবর্মনের কন্যা ভৃকুটিকে কাঠমাণ্ডু উপত্যকায় পাটনে বিয়ে করলে নেপাল-তিব্বতের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হল। ৮৮১তে নান ঝাও শাসক তাং রাজকুমারীকে বিয়ে করার উদ্যম নিয়ে ব্যর্থ হয়েও মালয় উপদ্বীপের সম্ভবতঃ শ্রীবিজয় রাজকুমারী, কুংলুং রাণীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। রাজকীয় পরিবারগুলির মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি করে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে থাকার প্রভাব পড়ল ব্যবসা পথেও – হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চলগুলো আরও বেশি বঙ্গোপসাগর ব্যবহার করার সুযোগ পেল।
সমতট আর পুণ্ড্রবর্ধনে ক্রমাগত সোনার মুদ্রা ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্য থেকে পরিষ্কার, পাহাড়ি অঞ্চলের নেপাল-তিব্বতের শাখা রাস্তাগুলির বঙ্গোপসাগরের যোগ বাড়ছে। ৬৫০এর পরের সময়ে এই রাস্তা ধরে, বিশেষ করে নিম্নবঙ্গ অঞ্চলে সোনার মুদ্রার সংখ্যা কমতে থাকায় মনে হয় এই রাস্তাটি ধরে যে বাণিজ্য উদ্যম শুরু হয়েছিল, সেটি ক্রমশ পরিত্যক্ত হচ্ছে। এই সময় থেকে নয় শতাব্দ পর্যন্ত চীন আর মধ্য এশিয়াতে রাজনৈতিক গোলযোগের সূচনা হবে। ফলে মধ্য এশিয়া থেকে চীন-পারস্য ব্যবসার কাফেলাগুলি বাঙলা হয়ে যেতে থাকে। নেপাল রাস্তাটা মাঝেমধ্যে ব্যবহার হত।
বাংলার সঙ্গে তিব্বতের বাণিজ্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে নেপাল রাস্তার একাংশ ব্যবহার হয়েছে। সাত শতাব্দ থেকে নেপাল ক্রমশ তিব্বতের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ তীর্থ কেন্দ্র হয়ে উঠবে। নালন্দা, বিক্রমশীলা, জগদল এবং উদন্তপুর মঠের পতন এবং তের শতাব্দ থেকে বাংলায় মুসলমান শাসন শুরু হওয়ায়, বাংলা বৌদ্ধ কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। বাংলার বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলি নেপালে স্থানান্তরিত হয়। বৌদ্ধ কেন্দ্র হিসেবে নেপালের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
তিব্বত থেকে নেপালে আসার জন্যে প্রায় একই দৈর্ঘের তিনটে রাস্তা ছিল; একটা—শিংসে, চুম্বি (ভূটান) এবং সিকিমে পৌঁছনোর সরাসরি রাস্তা; কাঠমাণ্ডু উপত্যকা হয়ে আরও দুটো রাস্তার একটা টিংরি, কোডারি এবং শঙ্খু হয়ে আর একটা কায়রং এবং ত্রিশূলি হয়তে – এই দুটি জনপ্রিয় ছিল। প্রথমটা মধ্য তিব্বতকে দক্ষিণ বিহারের সঙ্গে যুক্ত করত, আর দ্বিতীয় দুটি পশ্চিম তিব্বতকে কাঠমাণ্ডু উপত্যকা হয়ে পূর্ব ভারতের নানান জায়গায় যুক্ত করত।
চীন বিশেষজ্ঞ কিরচার ১৬৬৭তে আমাদের চীন-নেপাল রাস্তা নিয়ে একটা বিস্তৃত ধারণা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন পিকিং থেকে সিগাংফু, সেখান থেকে সিনিংফু অবদি আসতে দুমাস লাগে। সিনিংফুর দেওয়ালের দরজাটি ভারতবর্ষীয় ব্যবসায়ীদের চীনে ঢোকার একমাত্র পথ। সিনিংফু থেকে তারতারি অঞ্চলের কালমাক মরুভূমি, মার্কোপোলো যাকে লোপ মরুভূমি নাম দিচ্ছেন, সেটি পেরিয়ে লাসা বা বারানতোলা (দলাই লামার পাটোলা প্রাসাদের ইওরোপিয় উচ্চারণ) অবদি আরও তিনমাসের রাস্তা। বারানতোলা হয়ে ককেসাসিয় পর্বত হয়ে নেপালের কুচি অবদি যাত্রাপথ আরও এক মাসের। কুচি থেকে কাঠমাণ্ডু ১১ দিনের রাস্তা। সেখান থেকে নেপালের হেতাউরা, তরাইএর মোরাং রাজ্য হয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথম শহর মোতিহারি পৌঁছতে ১৩ দিন লাগে। মোতিহারি থেকে পাটনা, বেনারস, কানপুর হয়ে আগরা পৌঁছতে লাগে আরও ৩৬ দিন। কিরচার বলছেন বিরতিহীনভাবে যাত্রা করলে পিকিং থেকে আগরা পৌঁছতে লাগছে ২১৪ দিন। কিন্তু আমরা যদি যাত্রাপথে বিশ্রামের সময় হিসেব করি, তাহলে এটি মোটামুটি ১৪ মাসের পথ। এটা বেশ ঘুর পথ। আমরা জানি সিচুয়ান থেকে উত্তর ভারত খুব বেশি হলে দু’মাসের রাস্তা।
তিস্তা-করতোয়া উপত্যকা ॥ মেন্দাবাড়ি আর ভিতরগড়
রাস্তায় রাস্তায় কাটাকুটি—সুরক্ষিত শহর এবং পথসংযোগপ্রান্ত
চীন থেকে মায়ানমার হয়ে ভারতবর্ষে আসা পথটি জলপাইগুড়ি জেলায় প্রবেশ করে তিস্তা-করতোয়া উপত্যকাকে রেশমপথে জুড়েছে। সে সময়ে রাস্তাটির সামরিক গুরুত্ব অসীম ছিল। উত্তরবঙ্গজুড়ে [আজকের বাংলাদেশের উত্তরাংশ নিয়ে] একের পর এক মাটির কেল্লাভিত্তিক সুরক্ষিত শহর ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ভিতরগড় এবং গড় মেন্দাবাড়ি নিয়ে বিশদে কাজ হয়েছে। মেন্দাবাড়ির শহর বিন্যাসের সঙ্গে সুই-তাং রাজধানী চাঙ্গানের শহর বিন্যাসের মিল থেকে মনে হয়, এই অঞ্চলের সঙ্গে তিব্বত হয়ে চীনের সরাসরি সংযোগ ছিল। শহরগুলি গুপ্ত আমলে গড়ে উঠেছিল কেল্লা, পরিখা আর ঘেরা দেওয়াল নির্ভর হয়ে। তথ্যগুলো থেকে মনে হয় গুপ্ত আমলে শহরগুলোর কাঠামো তৈরিই হয়েছিল প্রতিবেশী ইউনান, তিব্বত এবং নেপালের আক্রমন থেকে সুরক্ষিত থাকার ভাবনায়। সুরক্ষাভাবনা মূলত আত্মরক্ষামূলক। তাই ইয়ুনান থেকে প্রসারিত রাস্তাগুলো এই অঞ্চলের শহরগুলো ছুঁয়ে গেছে। পরের দিকে অঞ্চলটি খেন এবং কোচ সাম্রাজ্যের অংশ হয়। আওরঙ্গজেবের রাজত্বেও এই শহরের উদাহরণ পাচ্ছি, সে সময়ে বাংলার সুবাদার মীর জুমলা এই শহরগুলি পেরিয়েই আসাম আক্রমন করতে যাচ্ছেন। এরই কাছাকাছি সময়ে চীন বিশেষজ্ঞ কিরচার তার মানচিত্র তৈরি করছেন।
তিস্তা-করতোয়া উপত্যকা—আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্রীড়াঙ্গন
বহুকাল থেকেই তিস্তা-করতোয়া উপত্যকা বাঙলা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছাড়িয়ে বিস্তৃত অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠছিল। মেন্দাবাড়ি, ভিতরগড়ের মত আঞ্চলিক শহরগুলোর অবস্থানের জন্যেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ রণনৈতিক রাস্তার যোগাযোগের অন্যতম আঞ্চলিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এবং একদিকে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকা অন্যদিকে মধ্য ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাকে আন্তহিমালয় অঞ্চল, ভারত উপদ্বীপ, দক্ষিণপশ্চিম চীন এবং লাওস, কম্বোডিয়ার (ইতিহাসে চম্পা আর কোচিন চীন নামে খ্যাত) সঙ্গে জোড়ার কাজ করেছে। করতোয়া এবং তলমা নদীর মূল খাতের তীরে ভিতরগড় অবস্থিত হওয়ায় এই বন্দর-শহরের মাধ্যমে তিস্তার ধুমগড় বন্দর হয়ে সিকিম হয়ে তিব্বতে খুব সহজেই যাওয়া যেত। শাহানাজ হুসেন জাহান (Archaeological Investigations at Bhitargarh) লিখছেন …ভিতরগড় মগধের সঙ্গে জুড়েছিল …দক্ষিণপশ্চিম চীনকে ( ইয়ুনান, শেজুয়ান,টংকিং) ব্রহ্মপুত্র বেয়ে উজানি আসামে ঢুকে পূর্ব তিব্বতের নামকিন পর্বতমালা পেরিয়ে মেকংএর পশ্চিম অঞ্চল হয়ে বাতাং এবং মেকংএর পূর্বতীর অঞ্চলকে জুড়েছে।
জলপাইগুড়ির চণ্ডীরঝাড়ে বিজাপুর এবং গুলবর্গা অঞ্চলের প্রচুর সোনার মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে; ফলে মধ্যযুগে ভারতজোড়া বাণিজ্যপথ ব্যবস্থায় এই অঞ্চলের গুরুত্ব আন্দাজ করা যায়। অর্থাৎ হিমালয়ের দক্ষিণ পাদদেশ থেকে বাণিজ্য কাফেলা এই পথ বেয়ে দক্ষিণের দিকেও যেত।
বাংলার সঙ্গে কাম্বোডিয়া/লাওসের যোগাযোগের সূত্রটি আমরা পাচ্ছি দক্ষিণপশ্চিম রেশম পথের ফ্যাকড়া বেরিয়ে আসা বেশ কয়েকটা শাখা পথের কল্যাণে—প্রথম রাস্তাটি ছিল মায়ানমার-ভারত, দ্বিতীয়টি বিস্তৃত ছিল ভিয়েতনাম পর্যন্ত এবং তৃতীয়টি ইয়ুনানকে লাওসের সঙ্গে জুড়েছিল। দক্ষিণ ইয়ুনান, উজানি মায়ানমার এবং লাওসকে ভৌগোলিকভাবে, কৃষ্টিগতভাবে এবং জাতিগতভাবে আলাদা করা সম্ভব নয়—তাদের আন্তঃযোগাযোগের চরিত্র থেকে এই তথ্য প্রমানিত হয়। যদিও শুরু দিকের চীনা সূত্র স্থির সিদ্ধান্তে আসার জন্যে যথেষ্ট নয়, কিন্তু এই সময়ে আমরা দেখছি, তাং চীন সাম্রাজ্য থেকে আলাদা আলাদাভাবে দৌত্য যাত্রা আসছে লাওস, থাইল্যাণ্ড এবং কম্বোডিয়ায় এবং এই দৌত্যগুলো ব্যতিক্রমী উদ্যম নয়। দশম শতে সম্পাদিত জিন তাং শু (তাং সাম্রাজ্যের নতুন ইতিহাস) থেকে জানতে পারছি আনাম (ভিয়েতনাম) থেকে ভূমিপথ, নদীপথ এবং সমুদ্রপথ মিলিয়ে মিশিয়ে ভারতে (তাংঝু) আসার রাস্তা ছিল; শুরু হত উত্তর ভিয়েতনামের টংকিং থেকে প্রোম (শ্রীক্ষেত্র) হয়ে সোজা আসত ইয়ুনান থেকে মগধ অবদি।
ডেয়েলও তিন নম্বর পথটি সম্বন্ধে লিখছেন …একটি আলাদা, জনাকীর্ণ এবং জনপ্রিয় রাস্তা উজানি ইয়াংসি-মেকং-সালউইন নদী বেয়ে তিব্বতে ঢুকত। তারপরে ভূটান এবং নেপালের বিভিন্ন গিরিপথ পেরিয়ে কামরূপ এবং হিন্দুস্তানে পৌঁছচ্ছে। তিস্তা-করতোয়া অঞ্চলটি শুধু তিব্বত, ইয়ুনান বা সিচুয়ানের সঙ্গেই নানান এলাকার যোগসূত্র তৈরি করে নি, সে বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে জুড়েছিল লাওস আর কাম্বোডিয়াকেও। দশ শতে চন্দ্র রাজাদের ঢাকার কাছের রাজধানী বিক্রমপুরে খমের দৌত্য মিশনটি এসেছিল যতদূরসম্ভব সমুদ্র হয়ে। সমতটের সঙ্গে উপকূল অঞ্চল জুড়ে থাকায় সমুদ্র যোগাযোগের মস্ত সুবিধে বাঙলা পেয়েছে। এই দৌত্যকর্ম এবং আগামী দিনের আরও বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ দৌত্যের কৃষ্টিগত প্রভাব দুই দেশের ওপরে তীব্রভাবে পড়বে। ভাতেরায় আবিষ্কৃত চন্দ্র রাজাদের এগারো, বারো শতের দুটি শিলালিপিতে যথাক্রমে ৫৫ এবং ৩২টা লাইন ছিল সংস্কৃত এবং প্রাচীন বাঙলা অক্ষরে লেখা। একই অক্ষর আমরা দেখছি কম্বোডিয়ার খমের শিলালিপিতেও।
কোচ রাজত্বের তিস্তা-করতোয়া উপত্যকা ভ্রমণ করে ১৫৮৬তে রালফ ফিচ লিখছেন, উত্তরপূর্ব ভারত কোচিন-চীনের প্রতিবেশী, তিনি বিন্দুমাত্র ভুল লেখেন না। কিন্তু আমরা জানি না এই পথ দিয়ে তখনও কোচিন চীন বাণিজ্য পথ যেত কীনা, নাকী সেটা শুধুই গণস্মৃতি হয়ে উপকথায় পরিণত হয়েছিল। ফিচ মূলত ইতালিয় মানচিত্রবিদ ফ্রা মাউরোর ১৪৫০এ আঁকা বিশ্ব মানচিত্র অনুসরণ করেছিলেন, যেখানে বাংলাকে দেখানো হয়েছে বাংলা-মাচিন হিসেবে, বাঙলা মায়ানমার আর লাওসকে একই ভৌগোলিক এলাকা হিসেবে।
কী বুঝলাম
চীনের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার, বলা ভাল বাংলা এবং পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ সূত্র, বাণিজ্যপথ বিস্তৃতি ইত্যাদির বিষয়ে যে আলোচনা করলাম, তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট হল উপনিবেশিক সময়ে সীমান্ত নির্ভর দেশ ব্যবস্থার যে বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস চর্চা হয়েছে সেই ধরণের ইতিহাস আলোচনা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক ছিল। এক প্রান্তে ইউনান অন্য প্রান্তে তিস্তা-করতোয়ার মত অঞ্চলের মধ্যে সীমান্ত নিরপেক্ষ সংযোগ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে নতুন নতুন ধারণা বিকশিত হচ্ছে; দেড় হাজার বছরের প্রাচীন রেশমপথ আলোচনা আমাদের ইতিহাসের গ্রন্থি খুলে ধরার ক্ষেত্রে আজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি রাস্তাগুলি কখন স্থায়ী রূপ পাচ্ছে বা জনগণের ধারণায় কখন সেই পথ বা পথ ব্যবস্থাকে স্থায়ি হিসেবে গণ্য করে একটা মজবুত নেটওয়ার্ক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে? রাজপথগুলির সঙ্গে জুড়ে থাকা অপ্রাতিষ্ঠানিক শাখা রাস্তাগুলী কী অনেক বেশি স্থায়িত্ব অর্জন করছে পুরোনো রাস্তাগুলির তুলনায়? নতুন স্থানিকতা বা উপআঞ্চলিক একক নতুন রাস্তা তৈরি করছে। বাঙলা, লাওস, কম্বোডিয়াকে একই ভৌগোলিক কৃষ্টির অঞ্চল হিসেবে ভাবা আজকে মনে হচ্ছে ঐতিহাসিক ধারণা, সে সময়ে এটাই বাস্তবতা ছিল। ফ্রা মাউরোর ১৪৫০এর মানচিত্রটিতে বাঙলা, মায়ানমার আর লাওস অঞ্চলকে বাঙ্গালা-মাচিন অভিধা দেওয়া হচ্ছে। রাজনীতিও নতুন আঞ্চলিকতা তৈরি করছে—মিং চীনের রাজনীতি থেকে এই কৌশলের একটা উদাহরণ পাচ্ছি; নানা ধরণের ঘোষণা জারি করে, শান্তি-থানা তৈরি করে, কখনও প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরি করে আঞ্চলিকতার বিকাশ ঘটিয়েছে। ইয়ুনানকে ১৪১১য় কয়েকটা অঞ্চলে ভেঙ্গে ফেললে শতাব্দ প্রাচীন বাঙলা ইয়ুনান কড়ি রাস্তাটি কয়েকটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং এর পরে ইয়ুনান আজকের উত্তর ভিয়েতনাম সেদিনের লিন-আন থেকে কড়ি কিনতে বাধ্য হল। মিং রাজাদের অতিশয়োক্তি বা শান্তিবার্তা নতুন একক তৈরি করেছে; ১৫ শতে আভা, ইয়ুনান, আজকের লাওসের একাংশ এবং ভিয়েতনাম, ইয়ুনানের নতুন বৃহত্তর একক হিসেবে গণ্য হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের কাজ হল এই লুকোনো সংযোগসূত্রকে সামনে নিয়ে আসা।
এই আলোচনা থেকে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট হল, যুদ্ধ, গতায়াত, অভিবাসন, ব্যবসাপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে ভৌগোলিক জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটছে এবং নানান ধরণের রাজনীতির জন্ম দিচ্ছে, এবং এই নতুন ব্যবস্থায় নতুন বাণিজ্য বিকশিত হচ্ছে। আমরা দেখলাম সাত শতাব্দের দিকে চীন থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় আসতে সিন্ধু উপত্যকা পার করে আসতে হচ্ছে, কিন্তু পরের শতাব্দতেই পূর্ব ভারতে আসা যাচ্ছে নেপাল আর ইয়ুনান/মায়ানমার, কম রাস্তা হয়ে। জঙ্গল পরিষ্কার করার, রাস্তা তৈরি করার, নতুন পাহাড়ি গিরিপথ তৈরি করার নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ভূমিকাও এ প্রঙ্গে বলা যাক, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা খুব স্পষ্টভাবে দেখলাম, দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে নেপাল তিব্বত, মায়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম জুড়ছে বিস্তৃত সড়ক পথে। যদিও ইওরোপিয়দের প্রভাবে আমরা মনে করেছি আধুনিকতা তৈরি করেছে সমুদ্রপথ, কিন্তু সেই কোন কাল থেকে কিন্তু বাংলা ভূমিপথে গোটা এশিয়ার সঙ্গে জুড়ে থাকছে, বিকশিত হচ্ছে; বাঙলা শুধু জলপথই ব্যবহার করছে না, একই সঙ্গে বিস্তৃত সড়কপথজাল বিস্তৃত এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহার করায় বাঙলা শুধুই নদী/সমুদ্র নির্ভর ভূমিখণ্ড ছিল, এই ধারণাটি ভেঙে যাচ্ছে। একইভাবে উত্তরবঙ্গের নদী বন্দর, নানান গিরিপথ বাঙলা তথা দক্ষিণ এশিয়ার দরজা হয়ে উঠছে। পাহাড় অঞ্চল থেকে বাংলায় ঢোকার সময় ডালা বা নজরদারি থানা (চেক পয়েন্ট) যেমন চট্টগ্রামের কাছে সাগর কাটরা নির্ভর করে বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সমস্যা হল সমুদ্র যাত্রায় যেমন বেশ কিছু নথি আজও পাওয়া যায়, কিন্তু সড়ক পথে ব্যবসা বা প্রশাসনিক নথির অভাবে অচল সড়ক পথ খুঁজে বার করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ৯৬০ এবং ১১২৬এর মধ্যে অনামা সাম্রাজ্য থেকে, হয়ত নালন্দা থেকে চীনের সং সাম্রাজ্যে যাওয়া তিনটি সড়কপথের দৌত্যের নথি পাওয়া যায়, তবে তৃতীয়টি কিন্তু ভারতবর্ষ থেকে যায় নি, গিয়েছিল তিব্বত থেকে। নথি থাকলে চীন আর ভারতবর্ষের মধ্যে এধরণের আরও দৌত্যের সংবাদ নিশ্চই পাব।
আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে, ভারত নিয়ে চীন প্রচুর পরিমান বিজ্ঞপ্তি জারি করলেও সেই তুলনায় কেন ভারতবর্ষে চীন বিষয়ক বিজ্ঞপ্তির পরিমান যথেষ্ট নয়? উত্তরটা কী এরকম, যে ভারত যেহেতু বৌদ্ধপন্থের উদ্ভবস্থল, তাই চীন ভারতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভারতে এসেছে বৌদ্ধভূমিতে তীর্থ করতে, ভারত থেকে বৌদ্ধ বিদ্বান, মূর্তি, জ্ঞান গ্রহণ করেছে?
উপসংহার
কিছু প্রশ্ন তোলা যাক—চীন ভারত সড়ক পথ কোন সংগঠন দেখাশোনা করত? যদি ধরে নিই রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ ছিল সড়ক পথের বিকাশ, তাহলে পথের ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা কারা নিশ্চিত করত? পথে প্রাতিষ্ঠানিক দৌত্যে এবং ব্যবসা বহরে দস্যুদের আক্রমনের সংবাদ মিং রাজত্বের নথিতে প্রচুর পাওয়া যায়। বাহিনীর যাতায়াত ছাড়াও স্থানীয় আমলারা ব্যবসা/ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করত। সাম্রাজ্যের আমলা সেজে বহু ছদ্মবেশি দস্যু রাস্তায় সার্থবাহকে আক্রমনের পরিমানটা এত বেশি পরিমান হতে শুরু করে যে ১৪০২তে মিং বাধ্য হয় আমলাদের নির্দিষ্ট পরিচয়পত্র বহন করতে এবং ব্যবসা বাহিনীর ওপর ইউনান-আভা রাস্তার মত সামরিক শাখা রাস্তায় যে কোনও আক্রমন রোখার জন্যে নির্দেশনামা জারি করতে।
রাষ্ট্রীয় দুর্যোগে রাস্তার কী অবস্থা হত? ১৫৩০এর ১৬ ফেব্রুয়ারির তথ্য থেকে জানছি ইয়ুনান-আভা রাস্তায় দামি পাথর পাওয়া যায় বলে, পথটি অনিরাপদ হয়ে উঠছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও সমস্যা বাড়ত। ১৫১৫র ১৭ জুন থেকে একমাসজুড়ে ইয়ুনানে ভূমিকম্পে ইয়ুনানের ভূপ্রকৃতি পাল্টে যায়। ১৮ আগস্ট ১৫২০, ২১ মে ১৫২৬, ৮ আগস্ট ১৫৩৯, ৩১ জানু ১৫৪৫, ২১ মে ১৫৫২, ৯ সেপ্টে ১৫৭১ এবং ১২৩ মার্চ ১৫৭৭এ ইয়ুনানে ভূমিকম্পের নথি পাচ্ছি। এই ভূমিকম্প সপ্তদশ শতক অবদি চলতে থাকে। ১৬০৯এ ফেব্রুয়ারিতে ইয়ুং-চ্যাংএ আরেকটা ভূমিকম্পের নথি পাচ্ছি।
১৫৩৩ থেকে উপদ্রুত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে ইয়ুং-চ্যাংএ শান্তি প্রশাসকের অধীনে থানা, এবং ১৫৩৪এর ডিসেম্বর থেকে সামরিক গুদাম তৈরি করায়। ১৫৭৯এর ফেব্রুয়ারিতে ঠিক হয় গুয়াং-ডিং/গুয়াংজির বিদ্রোহ দমনে ‘বাজ-আঘাত’ কায়দায় ঝটিকা আক্রমন করা হবে; শেষ সিদ্ধান্ত থেকে গুয়াং-ডিং/গুয়াংজি শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধির আন্দাজ করা যায়। ১৫৭৭এর ৭ জুলাই ইয়ুনানের একাংশকে শান্ত রাখা যাচ্ছিল না। বিদ্রোহ চলে ১৫৭৮ অবদি। ১৫৮৩-৮৩ থেকে টুঙ্গু সাম্রাজ্যের পতনের ফলে ইয়ুনান-আভা অঞ্চলে গণ্ডগোলের সংবাদে মন পেগু সাম্রাজ্য, মধ্য এবং উজানি মায়ানমার দখল নেয়। ১৫৮৫র ৭ মার্চ ৬টা চিঠি পাঠানোর জন্যে ডাক হরকরা কেন্দ্র এবং ১৩টা কেল্লা তৈরি করে ইয়ুনানে সেনাবাহিনী চলাচলের সুগম ব্যবস্থা করা হয়। সে বছরের ২৭ মার্চ ইয়ুনান-আভাকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চীনারা দেগে দিল। ১৬০৪এও অবস্থা স্বাভাবিক হয় নি। মান-মো (ভামো)—আভা-বার্মা থেকে সড়ক এবং জলপথ এসে এই শহরে মিলেছে ফলে যুদ্ধ পরিকল্পনায় এই শহরের গুরুত্ব অপরিসীম। এই শহরের পতন হলে রাস্তায় পণ্য চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৬০৫এ মান-মো (ভামো) উদ্ধার হয়। ১৬০৬এ ইয়ুনান-ভারত রাস্তায় আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ শহর মু-বাংএর (সেনউই) পতন হয় এবং ইউনান-আভা রাস্তায় গোলযোগ চলতেই থাকে ১৬০৯ পর্যন্ত। ১৬১৪য় বলা হল …‘আভা-বার্মা ‘ইয়ি’ বহু বছর ধরে ইয়ুনানের মাথাব্যথার কারন হয়ে উঠেছে। আভা-বার্মার কাছের লং-চুয়ান ক্ষেত্রটি প্রাচীন কালের লু-চুয়ান। পশ্চিম ইয়ুনান আসার দরজা এই অঞ্চল। এই অঞ্চলের তিন প্রশাসক যদি সমস্যায় পড়ে, তাহলে তেং-চং এবং ইয়ং-চ্যাংকে রক্ষা করা যাবে না’।
১৬২৭এর মে মাসে টুউঙ্গো বার্মার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া সূত্রে মিং পঞ্জিকা লিখছে …আভা-বার্মা চীনের ‘ইয়ি’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এখন তারা সেনা বাহিনী ব্যবহার করে অন্যদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে, ফলে বর্তমানে সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করে দুর্বিনীতদের শাস্তি দেওয়া ছাড়া আর অন্য কোনও পথ খোলা থাকল না। ইয়ুনানের দূরত্ব ৮০০০ লি-র থেকেও বেশি, ফলে ইয়ুনান আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হালকা আলোচনায় সম্ভব নয়। আমরা যদি এই বিপদ বিষয়ে চিন্তাভাবনা না করি, তাহলে আভা-বার্মার ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়ুনানের দুর্যোগও বাড়বে। ভবিষ্যৎ কী হবে বলা যাচ্ছে না’।
১৬ শতকের শেষের সময় থেকে মিং রাজত্বের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ঢিলে হতে থাকে। ফুজিআন এবং গুয়াংডং উপকূলে জলদস্যুদের আক্রমন বাড়তে থাকে এবং বেআইনি সমুদ্র বাণিজ্য ফুলেফেঁপে ওঠে। চীন ইয়ুনান, আনাম এবং লাওসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ১৬০৪এর ফুজিআন প্রদেশ প্রধান যুদ্ধ মন্ত্রককে জানায় ‘লাল পাখা’ সমুদ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তাদের দমন করার ব্যবস্থা করতে হবে, উপকূলকে মুক্ত করতে হবে, ১৬০৮এ ফুজিআন থেকে বার্তা পাঠিয়ে বলা হচ্ছে, ‘লাল ইয়ি’ নতুন করে আবার উদয় হয়ে শ্রেষ্ঠী এবং ধীবরদের খুন করে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৬২০ নাগাদ মিং রাজত্বের উপকূল নিয়ন্ত্রণ মিথে পরিণত হল এবং ১৬৩১এর সরকারি নথিতে বলা হচ্ছে সমুদ্র পথে ইওরোপিয়দের ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকায় ফুজিআন উপকূলের মানুষেরা জলদস্যুতার পথ বেছে নিচ্ছে।
ফলে ভারতে আসার ইয়ুনান-আভা রাস্তার নিয়ন্ত্রণ কখনও সরকারের হাতে যাচ্ছে, কখনোও বা বিদ্রোহীদের হাতে থাকছে। এই পথ দ্বিতীয় খ্রি পূর্বাব্দে আবিষ্কৃত হলেও এক শতকের মধ্যে তৃতীয় শতাব্দে নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়। সাত শতাব্দে মধ্য এশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, ৮৩২এ পিয়ুর পতন, নয়-দশ খ্রিতে আইনশৃংখলার অবনতি, ৮৪০এ বাগানের উত্থান, ৯০২তে নাঞ্ঝাওর পতন, ৯০৭এ তাংএর উৎখাত এগুলি সবই সড়ক পথে চলাচলের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। বাগান-সং আলাপ আলোচনা শুরু হচ্ছে ১০০৪এ। তের শতাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে এবং সড়ক যোগাযোগের জন্যে খুবই খারাপ সময়। ১২৫৬তে মোঙ্গলেরা ইয়ুনানের দখল নেয়, বাগান দখল নেয় ১২৮৭তে। এই সময়ের ঠিক আগে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক একক কামরূপ তিনভাগে ভাগ হচ্ছে কাছারি রাজত্ব (১০৮৬-১৮৩০), শ্রীহট্ট (১৭শত), এবং অহোম রাজ্যে (১৩ শতের প্রথম সময়)। খেন রাষ্ট্র তিস্তা করোতোয়া উপত্যকায় টিকেছিল ১১৮৫ থেকে ১৪৯৮ পর্যন্ত, তারা কামরূপের হারানো গৌরব ফেরানোর চেষ্টা করেছিল, পারে নি। তের শতে ত্রিপুরী রাজ্য সবল হল; কিন্তু বাংলার প্রাক্তন মুঘল আমলের স্মৃতিবাহী উত্তর পূর্বের ছোট ছোট রাজ্য যেমন উদেশ এবং তরফ (Udessa, Tarap) এগারো আর ১৩ শতকে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ১৪৩৬ থেকে ১৪৫৬, ২০ বছর ধরে লুচুনের নেতা সি রেন-ফা আর তার ছেলে সি জি-ফা-কে চীন সাম্রাজ্যের দমনে করার উদ্যমে ইয়ুনান থেকে আভা আসার রাস্তা অসুরক্ষিত হয়েপড়ে এবং দুই বিদ্রোহী পিতাপুত্র আভায় পালিয়ে সেখান থেকে চীন বিরোধী যুদ্ধ চালিয়ে যায়। লুচুনের আরেক নাম মং মাও এবং খাতায় কলমে পং—এটি তের থেকে ১৫ শত পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, ১৪৫৬য় তাদের দমন করার আগে তারা ইয়ুনান দখলের চেষ্টা চালিয়ে যায়। ১৪৯৯ থেকে ১৫০৬এর মধ্যে সি রেন-ফার উত্তরাধিকারী সি লু, হারানো রাজত্ব উদ্ধারের চেষ্টায় ইয়ুনান-আভা রাজপথের একটা বড় অংশে যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। ফলে সতের শতে ইয়ুনান থেকে বেরোনো সব রাস্তা অব্যবহার্য হয়ে পড়ে। তো আমাদের প্রশ্ন এই রাষ্ট্রনৈতিক বিপর্যয়ের সময় মানুষ আর বাণিজ্যের ওপর কী প্রভাব পড়ত?
এছাড়াও প্রশ্ন তোলা যাক, স্থানীয় প্রশাসন কতটা আঞ্চলিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করত? কীভাবে তারা রাজস্ব আদায় করত ইত্যাদি? জনপ্রিয় রাস্তাগুলো ক্রমশ ভাগ ভাগ হয়ে বাড়তে থাকলে, সেই রাস্তা ধরে বহু রাষ্ট্র গজিয়ে উঠতে থাকে। প্রত্যেক রাষ্ট্র বাড়তে থাকা সীমান্ত বাণিজ্যে অংশ নিতে উৎসাহী হয়। এখানে ‘রাস্তার রাজনীতি’ও দেখতে পাই। ১০৪৭এ তিব্বতি প্রধান সিয়া-চান সং চীনের রাজস্বদায়ী রাস্তায় একটা স্বাধীন দেওয়াল শহর গড়ে তুললেন। রাজস্বদায়ি রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকায় এবং সিয়া-চানএর ভয়ে সং সাম্রাজ্য স্বাধীন দেওয়াল শহরে দূত পাঠালে নতুন করে নতুন করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়। ১১১৬য় কুয়াং-চাউ এবং হু-নামের আমলাদের মধ্যে তিং-চাউএর পুরোনো, নতুন রাস্তা নিয়ে একটা অলিখিত সমঝোতার অভিযোগ ওঠে। দালি থেকে রাজস্বদায়ি বাণিজ্য দূতিয়ালি যাত্রাকে কুয়াং-চাউএর আমলারা নিজেদের শহরের বাণিজ্য সুবিধে পাওয়ার জন্যে তান-চাউন হয়ে পুরোনো রাস্তায় ঘুরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে—অথচ এই রাস্তাটি পার হতে অনেক বেশি সময় লাগে এবং খরুচেও। বিষয়টা এখানেও শেষ হল না—১১২০র অক্টোবরে বোঝা গেল তথাকথিত দালি দূতিয়ালিতে ঘোড়া বাণিজ্যের বণিকেরাও ছিল। এর থেকে প্রমান হয় মূল সড়ক রাজপথের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমলাদের শহরের মধ্যে দিয়ে যাওয়া নানান ধরণের শাখা পথের বিকাশ করে সামগ্রিকভাবে মূল রাজপথের বিকাশ নিয়েও আমলারা ভাবনাচিন্তা করছিলেন। কিন্তু সড়ক পথগুলি যেহেতু পরস্পরের ওপর নির্ভশীল, তাই পথের কোনও অংশ যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্যান্য কারনে অব্যবহার্য হয়ে পড়লে সামগ্রিক সড়ক পথের অবস্থা কি হত?
যে সব সড়ক পথ একের বেশি দেশ যেমন ভারতবর্ষ চীনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে সেখানে কী কী সমস্যা দেখা যেত? টলেমির ভারত মানচিত্রে আমরা দেখি সড়কপথ ভারতবর্ষ, মায়ানমার এবং চীনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে; এই রাস্তাপথ আবার এগারো-তেরো শতে বৌদ্ধ কুমিল্লা ময়নামতি অঞ্চলে পাট্টিকেরা এবং ষোল শতে শ্রীহট্টের তরফ রাজত্বের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এইসব বহুদেশিয় রাস্তায় কীভাবে রাজস্ব আদায় করা হত, কেইবা সিদ্ধান্ত নিত, কীভাবেইবা রাজস্ব আদায় হত এবং সেগুলি ভাগ হত?
প্রশ্ন তোলা যাক, যে সব অঞ্চলে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সক্রিয়তার অভাব ছিল অথবা ধাতু মুদ্রার উপস্থিতি থাকত না, সে সব এলাকায় কীভাবেই বা ব্যবসা চলত? খেন এবং কাছারি রাজত্বে খুব বেশি ধাতু মুদ্রা পাওয়া যায় নি। সেখানে পণ্য হাত বদল হত কী করে? সেখানে কী পণ্য বদল করা নীতি মানা হত, না কী স্থানীয় কোনও মান্য মুদ্রা/পণ্য ব্যবহার হত? যেমন রেশম পথের বিভিন্ন শহরে, যেমন ইয়ুনানেও রেশম পণ্য বদলের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হত। সেখানে বাণিজ্য কী ধরণের আর্থিক বা অর্থনৈতিক যুক্তি মেনে সাধন হত? এই সব এলাকায় কারা ওজন, মাপ, মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন?
তাছাড়া রেশম বা পশম রাজপথ মূলত হিমালয় সীমান্ত এলাকা দিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার সময় এমন কিছু অঞ্চল দিয়ে যেত, যেখানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেই। সেই সব এলাকায় রাস্তা দেখাশোনা করত কোন সংগঠন? বাজার ব্যবস্থা, বিশ্রাম কাঠামো, রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে ডাক ব্যবস্থা সামলানো, মুসাফিরদের জন্যে নানান সুযোগসুবিধে তৈরি হত রাস্তার শুরুতে, এবং নানান ধরণের সামরিক প্রয়োজনের এলাকায়। বৌদ্ধ যুগে বিহারগুলি মুসাফির ব্যবসায়িকদের সাময়িক বাসস্থান, ডাক ব্যবস্থা পরিচালনের কাজে ব্যবহৃত হওয়া থেকে আমরা বুঝতে পারি এই অঞ্চলগুলো মোটেই পরিত্যক্ত এলাকা ছিল না। বাজার, কাটরা, গড় নামধারী এলাকায় মন্দির, মঠ বা মসজিদ এবং সরাইখানায় মালবাহী পশু এবং সার্থবাহদের রাত কাটানো এবং বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে বহু প্রাচীন কাল থেকে চৈনিকেরা, মধ্য যুগ থেকে মুসলমানেরা মালপরিবহনে ভারবাহী পশু (যেমন খচ্চড়, উট এবং ঘোড়া) ব্যবহার, শস্য ভাণ্ডার, আইনরক্ষক, সরাইখানা (খাদ্য, জল, বিছানা) তৈরি করেছে। ডাক ব্যবস্থার বিস্তার মোঙ্গল আমলেই বেড়েছে।
ব্যবসার কাঠামো তৈরি করার জন্যতে বড় রাষ্ট্রগুলো প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এবাবদে ছোট রাষ্ট্রগুলো কী করত? কীভাবে তথ্য আদানপ্রদান (ক্যারাভান, নৌকো, দাম ইত্যাদি), আতিথেয়তা এবং যোগাযোগ রাখা হত? ১৭১১য় কোনও রকম সরাইখানার কাঠামো না থাকায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার দরুন অহোম এবং ত্রিপুরী দূতেদের আসাম থেকে ত্রিপুরায় নিরাপদে পৌঁছনোর জন্যে কাছারি রাজত্বের হাদাম্বা রাজা তাদের রাস্তায় নিরাপত্তা দিয়েছিলেন এবং খাসপুরে ১৯ দিনের আতিথ্য দিয়ে নৌকো করে ত্রিপুরায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। অরাষ্ট্রীয়, অনিয়ন্ত্রিত এলাকায় যখন রাষ্ট্র তার কাঠামো নিয়ে প্রবেশ করে, সে সব এলাকায় তৈরি হওয়া নানা কাঠমো, বিশেষ করে খরুচে ধার্মিক কাঠামো কখন এবং কীভাবে রাষ্ট্রের অধীনে যায়?
এই রাস্তায় কীভাবে রাষ্ট্র তার বাহু বাড়ানোকে আমরা চিহ্নিত করব? আবার আমাদের চীনের উদাহরণে ফিরে যেতে হবে—সং এবং মিং চীনে রাজস্বদায়ী রেশমপথের উদাহরণ আমাদের আলোচনা সহায়ক হবে। বিভিন্ন মিথ্যা দূতিয়ালি বন্ধ করতে সং সাম্রাজ্য তাদের চিহ্নিত দূতাবাসগুলোয় নুনের ভাউচার দিয়েছিল, যাতে চীনের যাওয়া নানান প্রতিনিধি ভূখণ্ডে ঢুকে খাদ্য কিনতে পারে। ব্যবসায়ীরা মাঝেমধ্যেই নুনের ভাউচার বিদেশি দূতেদের বিক্রি করত; ধরা পড়লে উভয়ের শাস্তি হত। তাছাড়া রাস্তায় আমলাদের সাহায্য না করলে শাস্তি দেওয়া হত। সং চীন বিদেশি দূতেদের চীন থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং খোতান এবং সি-চাউ এলাকা ছাড়া তাদের ব্যবসায়ীরা যাতে চীনে ব্যবসা করতে না পারে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়। ১০১৭য় আরব ব্যবসায়ীরা তা-শিহ (আরব, পারসিক?) ছদ্মবেশে প্রবেশ করলে তাদের কোনও কর ছাড় দেওয়া হয় না। ১০২৪এ তা-শিহরা সড়ক পথে ঢুকলে, এর পর থেকে তাদের সমুদ্র পথে এসে কুয়াং-চাউতে নামার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১০৯৬-৯৭তে খোটানি এবং তা-শিহদের সি-চাউতে রাজস্ব দিতে বলা হয় এবং রাজধানীতে ঢুকতে মানা করা হয়। সং রাজকীয় নির্দেশাবলী সূত্রে জানতে পারছি তারা কোনও কোনও রাস্তার কোনও কোনো অঞ্চল কোনও দেশের জন্যে, নির্দিষ্ট সময় সাপেক্ষে সংরক্ষিত রেখেছিল, হয়ত অবৈধ ব্যবসা আটকানোর জন্যে।
মিং চিন ধার্মিক এলাকাগুলি নিয়ন্ত্রণ করত, ব্যবসা রাস্তায় কনফুসিয়, দাওপন্থী এবং বৌদ্ধ বিদ্যালয়গুলো নথিকরণ করা হয়। ধার্মিক পন্থ কোনও কোনও সময় রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করার উদাহরণ পাচ্ছি আ-চি-লি বৌদ্ধ গোষ্ঠীর দালি রাজত্বে নথিতে। ‘দুর্বৃত্ত’ সি রেন-ফাদের নিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে তাদের সদস্যদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। অন্যান্য রাষ্ট্র একইভাবে ধার্মিক সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে?