[ সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয়ে আজকাল অনেক কিছু লেখা হলেও সেই লেখাগুলিতে তথ্যসূত্রের চিহ্নমাত্র খুঁজে পাইনি, সেই কারণেই এই লেখা ]
প্রাচীন যুগ
সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী প্রথম সহস্রাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিবাহের জন্য দিনের কোন সময়কে শুভ বলে বিশ্বাস করত, তা আজ নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। বৈদিক ঐতিহ্যের গৃহ্যসূত্রগুলির শাস্ত্রীয় অনুশাসন থেকে বোঝা যায় সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী কয়েক শতকে উপমহাদেশের উল্লেখনীয় অংশে বৈদিক অনুষ্ঠানরীতির অনুসারী উচ্চবর্গীয় সমাজে দিনের বেলায় বিবাহ অনুষ্ঠানের রীতি প্রচলিত ছিল। পারস্করগৃহ্যসূত্র (১.৮.৭) ও কাঠকগৃহ্যসূত্রে (২৫.৪৩) বিবাহের মূল অনুষ্ঠানের সমাপ্তির পর বর কর্তৃক বধূকে সূর্যদর্শন করানোর নির্দেশ থেকে বিবাহ যে দিনের বেলায় সম্পন্ন হত তা স্পষ্ট। কাঠকগৃহ্যসূত্রে (২৫.৪৪) কোন কারণে মূল বিবাহ অনুষ্ঠান সূর্যাস্তের মধ্যে সম্পন্ন না হলে সূর্যের পরিবর্তে অগ্নি দর্শন করানোর নির্দেশ থেকে এটা আরও পরিষ্কার। ভারদ্বাজগৃহ্যসূত্রেও (১.১২) বলা হয়েছে, পূর্বাহ্ণ দেবতাদের, মধ্যাহ্ন ঋষিদের এবং অপরাহ্ণ পিতৃগণের কাল, তাই এই তিনবেলাতেই কেবল বিবাহ সম্ভব। এর পরবর্তীকালে, সাধারণাব্দের চতুর্থ-পঞ্চম শতকে কালিদাসও তাঁর ‘কুমারসম্ভব’ মহাকাব্যে (৭.৬) শিব ও পার্বতীর বিবাহ অনুষ্ঠানের সূচনার ক্ষণ ‘মৈত্র মুহূর্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন। মৈত্র মুহূর্ত সূর্যোদয়ের পর তৃতীয় মুহূর্ত (সূর্যোদয়ের ১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট পর থেকে শুরু), অর্থাৎ সকালবেলায়।
কিন্তু, এই কালপর্বেই সামগ্রিকভাবে পূর্ব ভারতে এবং অন্যত্র নিম্নবর্গীয় সমাজে বিবাহ যে সন্ধ্যাবেলায় অনুষ্ঠিত হত, তা প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের জ্যোতিষ বিষয়ক শাস্ত্রগ্রন্থগুলির বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়। যেহেতু, বৈদিক অনুষ্ঠানরীতির অনুসারীরা সমস্ত শুভকার্য সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে, বিশেষ করে, পূর্বাহ্ণে করা উচিত বলে মনে করতেন, তাই, তাঁদের কাছে এই আচার যথাযথ বলে মনে হত না। সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে লেখা নীলকণ্ঠভট্টের ‘সংস্কারময়ূখ’ ও অন্ত-মধ্যযুগের একাধিক ধর্মনিবন্ধ গ্রন্থে অত্রি রচিত বলে জ্ঞাত একটি লুপ্ত জ্যোতিষগ্রন্থ থেকে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে,—
“মুখ্যো বিবাহঃ পূর্বাহ্ণে মধ্যাহ্নে চোত্তমোত্তমঃ।
নিশায়াং মধ্যমঃ প্রোক্তস্ত্বপরাহ্ণে তু গর্হিতঃ॥”
অর্থাৎ, “বিবাহের মুখ্যকাল পূর্বাহ্ণ, মধ্যাহ্নও অতি উত্তম, নিশাকালকে [বিবাহের জন্য] মধ্যম বলা হয় কিন্তু অপরাহ্ণে বিবাহ নিন্দনীয়।” অত্রি এবং তাঁর শিষ্য গর্গের জ্যোতিষ বিষয়ক রচনা থেকে ষষ্ঠ শতক সাধারণাব্দের প্রথমার্ধে বরাহমিহির উদ্ধৃত করেছেন। অতএব এই অভিমতকে সাধারণাব্দের প্রথম কয়েক শতকের বৈদিক বিবাহ রীতির অনুসারী শাস্ত্রকারদের অভিমত বলে অনুমান করা যায়।
রাজা টোডরমলের রচনা বলে পরিচিত ‘টোডরানন্দ’ (আনুমানিক ১৫৭০-১৫৮৯ সাধারণাব্দ) গ্রন্থের ‘বিবাহসৌখ্য’ খণ্ডে বরাহমিহিরের বলে একটি শ্লোক উল্লেখ করা হয়েছে, যা বর্তমানে তাঁর কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এই শ্লোকেও প্রাচীন বৈদিক রীতির অনুসারীদের অভিমত লক্ষণীয়, “প্রাতর্বিবাহঃ শুভদো দ্বিজানাং মধ্যংদিনে ক্ষত্রকুলোদ্ভবানাম্।/ বৈশ্যাহ্বয়ানামপরাহ্ণকালে প্রদোষকালে খলু শূদ্রজাতেঃ॥” অর্থাৎ, “দ্বিজদের (অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের) বিবাহের জন্য প্রাতঃকাল শুভ, ক্ষত্রিয়দের [বিবাহের] জন্য মধ্যাহ্ন, বৈশ্যদের [বিবাহের] জন্য অপরাহ্ন শুভ এবং কেবলমাত্র শূদ্রদের [বিবাহের] জন্য সন্ধ্যাবেলা শুভ।”
ষষ্ঠ শতক সাধারণাব্দের প্রথমার্ধে বরাহমিহির রচিত জ্যোতিষ বিষয়ক ‘বিবাহপটল’ গ্রন্থের একটি সংস্করণ ১৯৭৮ সালে কাঠমাণ্ডুর রাষ্ট্রিয় অভিলেখালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই মুদ্রিত গ্রন্থের ৮২-৮৩ শ্লোক থেকে অনুমান করা যায়, এই গ্রন্থ রচনার পূর্বেই পূর্বভারতের অধিবাসীদের মধ্যে সর্বত্র এবং ভারতের অন্যত্র নিম্নবর্গীয় সমাজে সন্ধ্যাবেলায় বিবাহ প্রচলিত ছিল এবং ‘বিবাহপটল’ এই প্রচলিত প্রথাকে স্বীকার করে নিয়েছে। এই দুই শ্লোকে বলা হয়েছে,
“প্রাচ্যা প্রায়োঃ ন্যূনবর্ণাঃ [হীনবর্ণাঃ]1 সগোপাঃ সন্ধ্যাকালং প্রাহুরিষ্টং ন শেষম্ [তু শেষম্]।
যাবচ্ছান্তং [যাবচ্ছান্তিং] গোরজো নাভ্যুপৈতি তাবত্তেষাং চিত্তশুদ্ধির্বিবাহে॥
গোপৈর্যষ্ট্যাহতানাং [গোপৈর্যষ্টয়াহতানাং] খুরপুটদলিতা যা তু ধূলির্দিনান্তে সোদ্বাহে সুন্দরীণাং বিপুলধনসুতারোগ্যসৌভাগ্যকর্ত্রী [বিপুলধনসুতাশ্চআয়ুরারোগ্যসম্পৎ]।
তস্মিন্ কালে ন চ ঋক্ষং ন চ তিথিকরণং নৈব লগ্নং ন যোগঃ খ্যাতঃ পুংসাং সুখার্থং শময়তি দুরিতান্যুত্থিতং গোরজস্তু॥”
অর্থাৎ, “সাধারণত প্রাচ্য (অর্থাৎ, পূর্ব ভারতের অধিবাসী), হীনবর্ণের ও গোপদের বিবাহে সন্ধ্যাকাল ইষ্টপ্রদ বলা হয়; যাবৎকাল গোরজ (গরুর খুরের আঘাতে উত্থিত ধুলো) শান্ত না হয়, তাবৎকাল পর্যন্ত বিবাহে চিত্তের শুদ্ধি হয়। দিনের শেষে, গোপদের যষ্টির আঘাতে আহত [গৃহের প্রতি ধাবমান] গরুদের খুরের দলনে [ভূমি থেকে উত্থিত] ধুলা সুন্দরী কন্যাদের বিবাহের পক্ষে শুভকারী। এই [ধুলা, ঐ কন্যাকে] বিপুল ধন, পুত্র, আরোগ্য ও সৌভাগ্য প্রদান করে। ঐ (অর্থাৎ, গোধুলি) কালে, নক্ষত্র, তিথি, করণ, লগ্ন বা যোগ দেখার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, গরুর খুরের দলনে উত্থিত ধুলো প্রত্যেক পুরুষকে সুখ প্রদান করে ও পাপ দূর করে বলে খ্যাত।”
আদি-মধ্যযুগ
ষষ্ঠ শতক সাধারণাব্দের প্রথমার্ধে বরাহমিহির রচিত ‘বৃহৎসংহিতা’র ১০২তম (বা ১০৩তম) অধ্যায়ও ‘বিবাহপটল’ নামে পরিচিত। ‘বৃহৎসংহিতা’র ‘বিবৃতি’(ব্যাখ্যা)কার ভট্ট উৎপলের (নবম শতক সাধারণাব্দের প্রথমার্ধ) মতে এই অধ্যায়টি প্রক্ষিপ্ত এবং বিন্ধ্যবাসী নামের পরবর্তী কালের জনৈক লেখকের রচনা বলে মনে করা হয়। ষষ্ঠ থেকে নবম শতকের মধ্যে লেখা এই ‘বিবাহপটল’ অধ্যায়ের ১৩ সংখ্যক শ্লোক বরাহমিহিরের ‘বিবাহপটল’ গ্রন্থের ৮৩ সংখ্যক শ্লোকের পুনরাবৃত্তি। সন্ধ্যাবেলার গোধূলি লগ্নে বিবাহ এই কালপর্বে উত্তর ও পূর্ব ভারতে শাস্ত্রীয় স্বীকৃতি অর্জন করতে শুরু করেছে বলে বোঝা যায়।
শ্রীহর্ষ দ্বাদশ শতাব্দী সাধারণাব্দের শেষে তাঁর ‘নৈষধচরিত’ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি কন্নৌজের গাহড়বাল বংশের রাজা জয়চন্দ্রের সমকালীন। ‘নৈষধচরিত’ গ্রন্থে (১৬.৪) রাজা নলের বিবাহের শোভাযাত্রা রাত্রে শুরু হযেছিল বর্ণিত হয়েছে। আদি মধ্যযুগের শেষে বর্তমান উত্তরপ্রদেশে শাস্ত্রীয় বিবাহ যে রাত্রে হত, এই বর্ণনা থেকে তা স্পষ্ট।
সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী পঞ্চম শতক থেকে সাধারণাব্দের পঞ্চম শতক পর্যন্ত রচিত বৈদিক অনুষ্ঠানরীতি অনুসারী শাস্ত্রগ্রন্থে বিবাহের শুভ মূহুর্তের গণনায় ক্রমশ জটিলতার বৃদ্ধি পায়। সাধারণাব্দের পূর্ববর্তী কয়েক শতকে শুধু মাস, তিথি ও নক্ষত্রে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে যোগ, করণ, লগ্ন প্রভৃতি গণনায় স্থান পায়। এই পরিস্থিতিতে শুভ মুহূর্ত গণনার সহজ পন্থার সন্ধান শুরু হয়, যার প্রতিফলন আদি-মধ্যযুগের জ্যোতিষ বিষয়ক গ্রন্থগুলিতে দেখা যায়। এই সময়কার জ্যোতিষ গ্রন্থগুলিতে দুটি শুভ মুহূর্ত উল্লেখ করা শুরু হয়, একটি সকালবেলায়, অভিজিৎ লগ্ন ও অন্যটি সন্ধ্যাবেলায় গোধুলি বা গোধুলিকা লগ্ন। আদি মধ্যযুগের এই জ্যোতিষ গ্রন্থগুলিতে পূর্ব ভারতের অধিবাসীদের বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য সন্ধ্যাবেলার মুখ্য শুভ মুহূর্ত হিসাবে গোধুলি বা গোধুলিকা লগ্ন স্বীকৃতি লাভ করে। পাশাপাশি, ভারতের অন্য অধিবাসীদের জন্য সকালবেলার মুখ্য শুভ মুহূর্ত হিসাবে অভিজিৎ লগ্নও স্বীকৃতি লাভ করে। আধুনিক বিদ্বানদের অনুমান নারদপুরাণ নবম থেকে দশম শতক সাধারণাব্দের মধ্যে বিদ্যমান রূপ পরিগ্রহণ করেছিল। নারদপুরাণের পূর্বভাগের দ্বিতীয় পাদের ৫৬ অধ্যায়ের তিনটি শ্লোকে (৫১২-৫১৪) বিবাহের এই দুটি লগ্নের মুখ্য শুভ মুহূর্ত হিসাবে স্বীকৃতির পরিচয় রয়েছে। নারদপুরাণে বলা হয়েছে,
“চতুর্থমভিজিল্লগ্নমুদয়র্ক্ষাচ্চ সপ্তমম্।
গোধূলিকং তদুভয়ং বিবাহে পুত্রপৌত্রদম্॥
প্রাচ্যানাং [প্রাচ্যা ন/প্রখ্যানং] চ কলিঙ্গানাং মুখ্যং গোধূলিকং স্মৃতং।
অভিজিৎসর্বদেশেষু মুখ্যো দোষবিনাশকৃৎ॥
মধ্যংদিনগতে ভানৌ মুহূর্তোঽভিজিদাহ্বয়ঃ।
নাশয়ত্যখিলান্দোষান্পিনাকী ত্রিপুরং যথা॥”
অর্থাৎ, সুর্যোদয়ের [লগ্নের] পর চতুর্থ লগ্ন অভিজিৎ ও সপ্তম লগ্ন গোধূলিকা উভয়েই [মঙ্গলদায়ক এবং দম্পতিকে] পুত্র ও পৌত্র প্রদান করে। গোধূলিকা প্রাচ্য (পূর্ব ভারত) ও কলিঙ্গ [অঞ্চলের অধিবাসীদের] জন্য মুখ্য লগ্ন বলে জ্ঞাত এবং [সমস্ত জ্যোতিষিক] দোষের বিনাশকারী অভিজিৎ সর্বদেশে (সমস্ত অঞ্চলে) মুখ্য লগ্ন বলে জ্ঞাত। সূর্য যখন মধ্য দিবসে (অর্থাৎ সর্বোচ্চবিন্দুতে) অবস্থানরত, সেই মুহূর্ত (অর্থাৎ ৪৮ মিনিট কাল) অভিজিৎ। যেভাবে পিনাকী (শিব) ত্রিপুর ধ্বংস করেছিলেন, সেভাবে অভিজিৎ লগ্ন সমস্ত দোষ বিনাশ করে।”
নারদ ঋষি রচিত বলে কথিত জ্যোতিষ বিষয়ক গ্রন্থ ‘নারদসংহিতা’ সম্ভবত আদি মধ্যযুগের একেবারে শেষদিকের রচনা। ‘নারদসংহিতা’য় (২৯.১৪৪-১৪৭) শাস্ত্রীয় বিবাহের শুভ মুহূর্ত প্রসঙ্গে নারদপুরাণের তিনটি শ্লোকের পুনরাবৃত্তির পর একটি অতিরিক্ত শ্লোক রয়েছে। সম্ভবত অভিজিৎ লগ্নের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে এই সংযোজন:
“মধ্যংদিনগতে ভানৌ সকলং দোষসঞ্চয়ম্।
দহত্যেবাভিজিল্লগ্নং [করোতি দোষমভিজিতৎ] তূলরাশিমিবানলঃ॥”
অর্থাৎ, “সূর্য যখন মধ্যদিবসে অবস্থানরত, অনল যেমন তুলোর রাশিকে [দগ্ধ করে,] অভিজিৎ লগ্ন তেমনই সমস্ত সঞ্চিত দোষকে দহন করে।”
একাদশ শতকের গণিতবিদ শ্রীপতিভট্ট বর্তমান মহারাষ্ট্রের বুলঢাণা জেলার রোহিণখেড় গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর আনুমানিক ১০৫০ সাধারণাব্দে লেখা ‘জ্যোতিষরত্নমালা’ গ্রন্থে গোধুলি লগ্ন সম্পর্কে আদি-মধ্যযুগের দাক্ষিণাত্যের উচ্চবর্গের শাস্ত্রকারদের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘জ্যোতিষরত্নমালা’য় (১৭.৩১) লেখা হয়েছে,
“প্রায়েণ গোপাঃ সহ হীনবর্ণৈঃ প্রাচ্যাশ্চ সন্ধ্যা সময়ে বিবাহম্।
শংসন্তি যাবৎসমুপৈতি শান্তিং ন গোখুরোৎখাতরজোবিতানম্॥”
অর্থাৎ, “সাধারণত গোপ সমেত হীনবর্ণ ও প্রাচ্যদের সন্ধ্যাবেলা বিবাহ [হয়]; যাবৎকাল পর্যন্ত গরুর খুর থেকে উত্থিত রজ (ধুলো) শান্ত না হয়, সেই সময় পর্যন্ত [এঁদের জন্য বিবাহ লগ্ন] প্রশংসিত।”
অন্ত-মধ্যযুগ
পশ্চিম বাংলার নবদ্বীপের অধিবাসী ধর্মনিবন্ধকার রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ১৫৬৭ সালে তাঁর ‘জ্যোতিষতত্ত্ব’ গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি বিবাহের লগ্ন নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমে গোধূলি লগ্নে অর্থাৎ সন্ধ্যাবেলায় বিবাহের সমর্থনে তিনটি শ্লোক উল্লেখ করেছেন,
“গোধূলিং ত্রিবিধাং বদন্তি মুনয়ো নারীবিবাহাদিকে হেমন্তে শিশিরে প্রয়াতি মৃদুতাং পিণ্ডীকৃতে ভাস্করে।
গ্রীষ্মেঽর্ধাস্তমিতে বসন্তসময়ে ভানৌ গতে দৃশ্যতাম্।
সূর্যে চাস্তমুপাগতে চ নিয়তং প্রাবৃট্ শরৎকালয়োঃ॥
লগ্নং যদা নাস্তি বিশুদ্ধমন্যদ্ গোধূলিকাং তত্র শুভাং বদন্তি লগ্নে বিশুদ্ধে সতি বীর্যযুক্তে গোধূলিকা নৈব ফলং বিধত্তে।
নাস্মিন্ গ্রহা ন তিথয়ো ন চ বিষ্টিবারা ঋক্ষাণি নৈব জনয়ন্তি কদাপি বিঘ্নম্।
অব্যাহতঃ সততমেব বিবাহকালে যাত্রাসু চায়মুদিতো ভৃগুজে ন যোগঃ॥
মার্গে গোধূলিযোগে প্রভবতি বিধবা মাঘমাসে তথৈব পুত্রাযুর্ধনযৌবনেন সহিতা কুম্ভে স্থিতে ভাস্করে।
বৈশাখে সুখদা প্রজাধনবতী জ্যৈষ্ঠে পতের্মানদা আষাঢ়ে ধনধান্যপুত্রবহুলা পাণিগ্রহে কন্যকা॥”
অর্থাৎ, “মুনিরা বলেন, নারীদের বিবাহাদি অনুষ্ঠানের জন্য গোধূলি তিন প্রকার – হেমন্ত ও শীতে সূর্যকে যখন তেজহীন গোলাকৃতি দেখায়; বসন্তে সূর্য অদৃশ্য হলে ও গ্রীষ্মে সূর্যবলয়ের অর্ধেক অস্তমিত হলে; এবং বর্ষা ও শরৎকালে সূর্য অস্তমিত হলে গোধূলি হয়। বিশুদ্ধ লগ্ন না পাওয়া গেলে গোধূলি শুভ, বিশুদ্ধ লগ্ন থাকলে গোধূলি ফলদান করতে পারে না। এই গোধূলি কালে গ্রহ, তিথি, বিষ্টি, বার বা নক্ষত্র কোনও রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে না। এই কারণে ভার্গব ঋষি বিবাহকাল ও যাত্রার জন্য অব্যাহত এই গোধূলি যোগের নির্দেশ দিয়েছেন। কন্যার বিবাহ অগ্রহায়ণ ও মাঘ মাসে গোধূলি যোগে হলে বিধবা হয়; সূর্য যখন কুম্ভ রাশিতে অবস্থান করেন (অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে), তখন গোধূলি যোগে হলে পুত্র, আয়ু, ধন ও যৌবনযুক্ত হয়; বৈশাখে গোধূলি যোগে হলে পতির সুখদায়িনী, সন্তান ও ধনবতী হয়; জ্যৈষ্ঠে গোধূলি যোগে হলে পতির মানদায়িনী এবং আষাঢ় মাসে গোধূলি যোগে হলে ধন, ধান্য ও পুত্রযুক্তা হয়।” এরপর, তিনি দিনের বেলায় বিবাহ অনুষ্ঠানের বিপক্ষে ‘জ্যোতিঃসারসংগ্রহ’ নামের একটি গ্রন্থ থেকে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, “বিবাহে তু দিবাভাগে কন্যা স্যাৎ পুত্রবর্জিতা।/ বিবাহানলদগ্ধা সা নিয়তং স্বামীঘাতিনী [স্বামীঘাতিনৌ]॥” অর্থাৎ, “দিবাভাগে বিবাহ হলে কন্যা পুত্রবর্জিত এবং বিবাহের অগ্নির দ্বারা দহনের কারণে স্বামীঘাতিনী (স্বামীর মৃত্যুর কারণ) হন।”2
সপ্তদশ শতক সাধারণাব্দের প্রথমার্ধে উত্তর ভারতের ধর্মনিবন্ধকার মিত্রমিশ্র তাঁর লেখা ‘বীরমিত্রোদয়’ গ্রন্থের ‘সংস্কারপ্রকাশ’ খণ্ডে বিবাহের শুভ মূহুর্ত প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে প্রথমে নারদপুরাণের পূর্বে উল্লিখিত তিনটি শ্লোক ও তারপর নারদসংহিতার পূর্বে উল্লিখিত অতিরিক্ত শ্লোকটিও উদ্ধৃত করেছেন।3
অনুমান করা যায়, অন্ত-মধ্যযুগে পূর্ব ও উত্তর ভারতের ধর্মনিবন্ধকাররা নিম্নবর্গের রাতের লগ্নকে শাস্ত্রসম্মত বিবাহের শুভ মুহূর্ত বলে সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু, দাক্ষিণাত্য ও সুদূর দক্ষিণের উচ্চবর্গীয় শাস্ত্রকাররা নিম্নবর্গীয়দের বিবাহ লগ্নকে বিন্দুমাত্র স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না।
দাক্ষিণাত্যে ও সুদূর দক্ষিণের উচ্চবর্গীয় সমাজে অন্ত মধ্যযুগেও প্রাচীন বৈদিক অনুষ্ঠান রীতির অনুসরণ করা হয়েছে। নারায়ণভট্ট দৈবজ্ঞ (অর্থাৎ, জ্যোতিষী) ১৫৭১ সালে তাঁর ‘মুহূর্তমার্তণ্ড’ গ্রন্থ রচনা করেন। ইনি বর্তমান মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গাবাদ জেলার টাপরগাঁওয়ের অধিবাসী ছিলেন। গোধুলি লগ্ন সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য (মুহূর্তমার্তণ্ড ৪.৩৮) অন্ত-মধ্যযুগের দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ শাস্ত্রকারদের মনোভাবের পরিচায়ক: “গোধূলং পদজাদিকে শুভকরং পঞ্চাঙ্গশুদ্ধৌ রবেরর্ধাস্তাৎপরপূর্বতোঽর্ধঘটিকং তত্রেন্দুমষ্টারিগম্।/ সোগ্রাঙ্গং কুজমষ্টমং গুরুযমাহঃ পাতমর্কক্রমং জহ্যাদ্বিপ্রমুখেঽতিসঙ্কট ইদং সদ্যৌবনাআদ্যে ক্বচিৎ॥” অর্থাৎ, “সূর্যবিম্বের অর্ধাংশের অস্তের আগে ও পরে মিলিয়ে, মোট ১/২ ঘটিকা (১২ মিনিট) কাল গোধুলি লগ্ন; [এই লগ্ন, কেবলমাত্র] শূদ্রাদিদের জন্য শুভকর; [লগ্ন যদি,] পঞ্জিকা অনুযায়ী শুদ্ধ [হয়, তাহলে সব বর্ণের জন্য শুভকর]। [গোধুলি লগ্নের ক্ষেত্রে] লগ্ন থেকে ষষ্ঠ বা অষ্টম স্থানে চন্দ্র, পাপগ্রহযুক্ত লগ্ন, অষ্টমস্থ মঙ্গল, বৃহস্পতিবার ও শনিবার, মহাপাতদোষ ও সূর্যের সংক্রান্তি [সংক্রান্ত দোষ] ত্যাগ করা যায়। ব্রাহ্মণ ও অন্য বর্ণের কন্যা যদি যৌবনপ্রাপ্ত হয়, তবে, এইরকম সঙ্কটের ক্ষেত্রে, [এই লগ্ন তাঁদের জন্যও] শুভ।”
কথাশেষ
১৭৯০ সালে বর্তমান মহারাষ্ট্রের শোলাপুর জেলার পণ্ঢরপুরের অধিবাসী কাশীনাথ উপাধ্যায়ের লেখা ‘ধর্মসিন্ধু’ গ্রন্থে ‘মুহূর্তমার্তণ্ডে’র এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি থেকে অনুমান করা যায়, আধুনিক যুগের প্রারম্ভেও দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণদের মনোভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি। এখনও দাক্ষিণাত্য ও সুদূর দক্ষিণের উচ্চবর্গীয় সমাজের শাস্ত্রীয় বিবাহ দুই সহস্রাব্দেরও বেশি প্রাচীন রীতি অনুসরণ করে দিনের বেলাতেই অনুষ্ঠিত হয়। এই অঞ্চলের নিম্নবর্গের অধিকাংশও বর্তমানে উচ্চবর্গের বিবাহ রীতিই গ্রহণ করেছেন।
তথ্যসূত্র:
- R. Gopal, ‘India of Vedic Kalpasūtras’; Delhi: National Publishing House, 1959, p. 216.
- K.K. Handiqui translated, ‘Naiṣadhacarita of Śrīharṣa’; Poona: Deccan College Post Graduate Research Institute, 2nd edition, 1956, p. 229.
- লক্ষ্মণশাস্ত্রী জোশী সম্পাদিত, ‘ধর্মকোশঃ, সংস্কারকাণ্ডম্, দ্বিতীয়ো ভাগঃ’; পুণা: প্রাজ্ঞ পাঠশালা মণ্ডল, ১৯৮০, পৃ. ১০৩৩-১০৩৮।
- P.V. Kane, “VARĀHAMIRA and UTPALA: their works and predecessors” in ‘Journal of the Bombay Branch of the Royal Asiatic Society, Vol. 24-25, 1948-49’; Bombay, 1949, pp. 1-32.
- P.V. Kane, “History of Dharmaśāstra, Vol. V, Part I”; Poona: Bhandarkar Oriental Research Institute, 1958, pp. 613-614.
- সত্যেন্দ্র মিশ্র সম্পাদিত ও অনূদিত, ‘শ্রীনারায়ণদৈবজ্ঞ বিরচিতঃ মুহূর্তমার্তণ্ডঃ’; বারাণসী: কৃষ্ণদাস অকাদমী, ১৯৯৭, পৃ. ১২২-১২৩।
- V.S. Sastri, ‘Varahamihira’s Brihat Samhita with an English Translation and Notes’; Bangalore: V.B. Soobbiah & Sons, 1946, p. 764-768.
- বসতিরাম শর্মা অনূদিত ও সম্পাদিত, ‘নারদসংহিতা (জ্যোতিষগ্রন্থঃ)’; মুম্বই: খেমরাজ শ্রীকৃষ্ণদাস, 1906, পৃ. ১৮১।
- খেমরাজ শ্রীকৃষ্ণদাস সম্পাদিত, ‘শ্রীনারদীয়মহাপুরাণম’; নঈ দিল্লী: রাষ্ট্রিয় সংস্কৃত সংস্থানম, পুনর্মুদ্রণ, ২০০২, পৃ. ১১৩।
- G.V. Tagare translated, ‘The Nārada Purāṇa, Part II, Ancient Indian Tradition & Mythology, Vol. 16’; Delhi: Motilal Banarsidass, 1996 [1950], p. 829.
পাদটীকা
- যেহেতু, এখানে উদ্ধৃত অধিকাংশ সংস্কৃত গ্রন্থের কোন সমীক্ষাত্মক সংস্করণ প্রকাশিত হয় নি, সেই কারণে কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন মুদ্রিত সংস্করণের মধ্যে পাঠান্তর বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
- জীবানন্দ বিদ্যাসাগর সম্পাদিত, ‘স্মৃতিতত্ত্বস্য প্রথমো ভাগঃ, মহামহোপাধ্যায় শ্রীরঘুনন্দনভট্টাচার্য্য বিরচিতঃ’; কলিকাতা: নারায়ণ যন্ত্র, দ্বিতীয় সংস্করণম্, ১৮৯৫, পৃ. ৬১০-৬১১।
- Parvatiya Nityananda Pant edited, ‘বীরমিত্রোদয়ঃ, সংস্কারপ্রকাশস্যোত্তরার্ধং বিবাহাদি সমাপ্তিপর্যন্তম্, মহামহোপাধ্যায়শ্রীমিত্রমিশ্রবিরচিতম্’, Vīramitrodaya by Mahāmahopādhyāya Paṇḍita Mitra Miśra’; Benares: Chowkhamba Sanskrit Book-Depot, 1913, p. 783.