হঠাৎ করেই পার্বত্যাঞ্চলে বড় পরিসরে জাতিগত সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে সরাসরি হামলা, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, গোলাগুলির ঘটনায় অনেক হতাহতের খবর প্রকাশ হয়েছে। ঘটনার সুত্রপাত খাগড়াছড়ি সদর, সেখান থেকে একদিনের ব্যবধানে বারুদের মতো পুরো খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। অপর পার্বত্য জেলা বান্দরবানে এই উত্তাপের আঁচ সেভাবে স্পর্শ না করলেও শঙ্কা রয়ে গেছে। তবে এই সংঘাত, এই দাঙ্গা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়; যুগ যুগ ধরে চলে আসা নরক কুণ্ডের বিষ নিঃশ্বাস!
পার্বত্য চট্টগ্রামে পক্ষ মোটা দাগে দুটি। একটি বাঙালি অন্যটি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, কুকিসহ নানান ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। দুই পক্ষ থেকেই নানান উষ্কানি ও গুজব ছড়িয়ে আগুনে ঘি ঢালার কাজটা ঠিকমতোই করা হয়। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় গড়ে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি করে না। আর নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান, মুভমেন্ট কেন্দ্রিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার উত্থান-পতনের বিষয় তো আছেই। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে, উত্তরণের পথে আছে কেবল চর্বিত চর্বন।
পার্বত্যাঞ্চলে আন্তরিকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সমস্যার গভীরে গিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হবে। পাহাড়, উপকূল, মরুভূমি, সীমান্ত আর চরাঞ্চলের মানুষ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি বেপরোয়া হয়ে থাকে, এইটা সারা দুনিয়াতেই। কারণ তাদের সংগ্রাম করে বেড়ে উঠতে হয়। বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলা, জীবন ধারণের উপায়-উপকরণ সংগ্রহ, নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম তাদের কিছুটা স্বাধীনচেতা বানায়। আমাদের পার্বত্য এলাকার মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। ট্যুরিস্টের চোখ দিয়ে এগুলো দ্যাখা যায় না। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে, তারা জানেন এক গ্লাস পানি সেখানে কতটা মূল্যবান। জুম চাষ করে পরিবারের জন্য ফসল উৎপাদন কতটা কষ্টসাধ্য। দুই টাকা, পাঁচ টাকা বিনিময় মূল্য হিসেবে কত মমতায় গ্রহণ করা হয়। বিশ-পঞ্চাশ টাকা দামের কাপড়টা কত যত্নে গায়ে জড়িয়ে রাখে। কথাগুলো অবাস্তব শোনালেও সত্যি। যান্ত্রিক কোলাহল এড়িয়ে, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেটের জাল ভেদ করে, দুর্গম-নির্জন পাহাড়ের চূড়ায়, টং ঘরে চাঁদের আলোয় নিশি যাপন করা আমার-আপনার ফ্যান্টাসি; কিন্তু সেখানে দুই দিনের জায়গায় পাঁচদিন কাটাতে হলে দেখা যাবে, শরীরের আরো কয়েকটি আউটলেট দিয়ে নিঃশ্বাস বেরোনো শুরু হয়েছে।
সংসারের রসদ মাথায় চাপিয়ে মাইলের পর মাইল চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দিন গুজরান করে চলা মানুষগুলো যখন দেখল, তাদের ওপর বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে; তাদের চিন্তা-চেতনায় বিদ্রোহ দানা বাঁধল। পাকিস্তান শাসনামলে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কিছু জনপদ বিলীন হয়ে যাওয়ায় তারা আগে থেকেই সংক্ষুব্ধ ছিল। নয়া রাষ্ট্রে তাদের ওপর এলো জাতিসত্তায় আঘাত। কিছু মানুষ সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করল। সময়ের পরিক্রমায় সেই আন্দোলন সশস্ত্র রূপ ধারণ করল। দেশের নিরাপত্তা বাহিনী সেই সশস্ত্র সংগ্রাম ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছিল। গ্রাউন্ড সাপোর্ট লাভের আশায় সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যায় বাঙালি পুনর্বাসন করা হলো। নিজেদের চিরচেনা পাহাড়-টিলা ছেড়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠী।
মানুষ মাটি ফুঁড়ে বের হয় না। প্রকৃতির নিয়মে স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়ায় মানুষের বংশবিস্তার হয়। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যায়, বসতি গড়ে। পাহাড়ে বাঙালি, চাকমা , মারমা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও এভাবেই সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তুলেছে শত শত বছর ধরে। কিন্তু অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আমদানি করা কম্যুনিটির কারণই মূলত পাহাড়ে সংঘাতের ভিত শক্ত করেছে।
হাঁ, পাহাড়ে বেশ কিছু সশস্ত্র সংগঠন আছে। স্বাধীন জুম ল্যান্ডের স্বপ্ন গড়ার কারিগর ও আছে কিছু। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষেরও অভাব নেই। সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ইন্ধন থাকাটাও খুব স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসীদের প্রকৃত সংখ্যা কত? একটা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সবাই কি সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয়দাতা? প্রায়শ যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়, সেখানে হতাহত হয় কারা, ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারা? জনপদে বাস করা সাধারণ কর্মজীবী মানুষ নয়? এই পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলো সাধারণ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের কাছে জবরদস্তি করে চাঁদা আদায় করে না? তাহলে এদের কাছে কে নিরাপদ?
দেশের মানচিত্রের বিষয়ে কোনো আপোষ নয়, কিন্তু তার প্রতি অনুগত রাখতে সকল পক্ষের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অভিযোগ আছে, পাহাড়ে প্রশাসনিক সেবা সংশ্লিষ্টতায় বাঙালির তুলনায় উপজাতিরা বেশি সুবিধা পায়। এই বেশি পাওয়ার গ্রাউন্ডটা তো আমরাই তৈরি করে দিয়েছি। উপজাতি কোটা নিয়ে অনেকের আপত্তি; যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, অথচ বাংলায় পড়ালেখা করতে হচ্ছে – এটুকু ছাড় তাকে দিতে পারেন না? তাদের যে উপজাতি বা ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠি বলে নিজের বড়ত্ব জাহির করছেন। এইটুকু ছাড় না দিলে বড়ত্ব আর থাকে কোথায়? আমাদের ভাষা আন্দোলনের গর্ব থাকে কোথায়? পৃথিবীতে কেউ ধোয়া তুলসী পাতা না, দোষ কমবেশি সকলের আছে, তবে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
ক্ষুদ্র, দুর্বল ও হীনমন্যতায় আক্রান্তরা নিজের চারদিকে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তুলে রাখে। ভীত বা স্বন্ত্রস্ত প্রাণী জীবন বাঁচাতে আক্রমণ করে বসে। আর ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায় – সুতরাং কাদা ছোড়াছুড়ি না করে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে আস্থায় নিয়ে আসতে হবে। ওপর ওপর তত্ত্ব কথার গালভরা বুলি আওড়ে আর এখানে সেখানে নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে সমাধান আসবে না। আজ পর্যন্ত বন্দুকের নল দিয়ে পৃথিবীর কোথাও স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। যদি তা-ই হতো, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান থেকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া লাগত না। সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।