নজরুল সংগীতের সুরবিকৃতির সমস্যাটি অনেকদিন ধরে চলছে। কবির সুস্থাবস্থায় গ্রামোফোন শিল্পীদের কণ্ঠে যে সুরে গান রেকর্ড করা হয়েছিল, পরবর্তীকালের অনেক শিল্পীরাই সেই সুর বজায় রাখেননি। নজরুলের প্রাথমিক শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন আব্বাসউদ্দিন, হরিমতী দেবী, কে মল্লিক, আঙুরবালা, ইন্দুবালা প্রমুখ যাদের রেকর্ডেড সুর প্রামাণ্য বলে মনে করা হয়।
বিশিষ্ট নজরুলসংগীতশিল্পী ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র ১৯৯১ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন “বর্তমানে নজরুলসংগীত যখন তার বাণী এবং বিশেষ করে সুরগুলি বিকৃত হয়ে অতীত গৌরব হারিয়ে বসেছে তখন ব্যথিত চিত্তে শুধু ভাবি কবি আজ বেঁচে থাকলে তাঁর গানের দুর্দশা দেখে কতটা মানসিক যন্ত্রণা পেতেন সেটা অনুধাবন করা সহজ নয়।”
নজরুলের স্বরলিপিকার এবং গানপ্রশিক্ষক নিতাই ঘটক বলেছিলেন ” কোন কোন শিল্পী নিজের সুরে নজরুলগীতি গেয়ে থাকেন। আমি নিজে কবির কাছে যে গান যে সুরে ও তালে শিখেছি, আজ শুনি সেই গান সম্পূর্ণ অন্য সুরে অন্য তালে গাওয়া হচ্ছে। এসব শিল্পীরা প্রায় সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত, ফলে এঁরা যা গাইবেন সেটাই লোকে আসল বলে মেনে নেবেন।”
স্বয়ং নজরুল যাদেরকে নিজের গান শিখিয়েছেন তাদের একজন হলেন আঙুরবালা। তিনি বলেছেন “কয়েকজন বাদ দিয়ে অধিকাংশ শিল্পী যে যার মত নিজের সুরে গান গাইছেন। এসব গানকে নজরুলগীতি বলে মেনে নিতে আমার ঘোর আপত্তি আছে। আজ কাজীদা (নজরুল) বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ হতেন তাঁর সুর বিকৃতি শুনে।”
এই যুগের এ আর রহমানের আগে যারা নজরুলের গানের বিকৃতি ঘটিয়েছেন তাদের একজন হলেন জনপ্রিয় গায়ক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। সত্যি বলতে গেলে মানবেন্দ্র নজরুলগীতি রেকর্ড করায় নজরুলের বেশ কিছু গান শ্রোতৃমণ্ডলে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পায়। তবে গায়ক সুরের বেলায় অনেকাংশে নজরুলের সুর পাল্টেছেন। উনার মনোভাব হল “আমি নাকি নজরুলগীতিকে মানবগীতি করে দিচ্ছি। …. নজরুলগীতি আমার পৈতৃক সম্পত্তি নয়, আমি গাইছি, অন্যেরাও গেয়ে সঠিক পথটা দেখালেই তো হয়। সমঝদার শ্রোতারা যেটা নেবার বেছে নেবেন। এটা ত একধরনের স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা হতে পারে।”
প্রকৃত সুর পরিবর্তন সমর্থন করেন এমন একজন ছিলেন বিমান মুখোপাধ্যায়। তার দৃষ্টিভঙ্গি হল ” বিকৃতি কেন হবে, নব্বই সালে এসে (নব্বই এর দশক) উনিশশো কুড়ি সালের স্টাইল চলবে না কি, শুনবে কেন লোকে।”
কিংবদন্তি নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমও স্বীকার করেছেন কিছু গানে সুর একটু হেরফের করে রেকর্ড করায় তা জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি নিজেই কমল দাশগুপ্তের করা সুরে এমন কয়েকটি গান রেকর্ড করেন। এপ্রসঙ্গে ফিরোজা বলেছেন “কমল দাশগুপ্ত কাজী সাহেবের সংগীত চিন্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন বলে তাঁর পক্ষে যা করা সম্ভব, সবাইতো সে কাজের যোগ্য নন। ফলে স্বাধীনতার অপব্যবহার করে যে যার স্বার্থসিদ্ধি করে চলেছেন।”
একথা স্বীকার করতেই হয় যে রাগপ্রধান গানসমূহে গায়কের সুরবিহারের স্বাধীনতা থাকে। দুজন শিল্পী একই রাগসংগীত হুবুহু গাইবেন না। কিন্তু মূলসুর বা মূলভাবনাটি ক্ষুণ্ন করা অনধিকার চর্চা।
সম্প্রতি এ আর রহমান নজরুলের ভাঙার গান এর সুর ভেঙে খানখান করে দিয়েছেন। এই গানটি লেখা হয় শত বছর আগে ১৯২১ সালে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রায় গ্রেপ্তার হলে তার স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে নজরুল এটি রচনা করেন। উদ্দীপনাময় বীররসাত্মক গানটি সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। ১৯৪৯ সালে গিরীন চক্রবর্তী গানটি প্রথম রেকর্ড করেছিলেন।
সুরকার এ আর রহমান গানটির দ্রুতলয় ও তেজোময় সুর পরিহার করে এতে বাঁশির লালিত্য যোগ করেছেন, যা গানের বাণীর ভার বহনের জন্য নিতান্তই অনুপযুক্ত। নজরুলের সুর নিয়ে অনেকেই খেলা করেছেন, কিন্তু এ আর রহমানের সুর এই রক্তশিহরণজাগানিয়া গানটিকে একেবারে অখাদ্য বানিয়ে ছেড়েছে।