আমি আবদুল্লাহ। অবশ্য এটি আমার প্রকৃত নাম নয়। তাতে কী, বাপ-মায়ের দেওয়া নামটা ঠিক ইসলামিক ছিল না, এই জন্য সেটি নিজে নিজেই পাল্টে নিয়েছি। শুধু নাম নয়, কীভাবে নিজেকে আপাদমস্তক বদলে ফেলেছি সেই কথা বলছি একে একে।
আমি খুব হযবরল জীবন যাপন করতাম। জীবনের কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল না; যেনতেন প্রকারে রোজগার করা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম আর সুযোগমতো আমোদ-ফূর্তি করে সময় কাটানোই ছিল আমার প্রাত্যহিক জীবনের কর্মসূচি। হঠাৎ একদিন এক দুর্ঘটনায় আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। উপলব্ধি করি এভাবে জীবন চলতে পারে না, চলা উচিত না। ধীরে ধীরে ধর্মের দিকে ঝুঁকতে থাকি। যতই দিন যায়, আমার পূর্ব জীবনের গ্লানি আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলে যাওয়া শুরু করি, হুজুরদের কথা শুনি, ধর্মীয় নসিহতের বই পড়ি, ইসলামের জানা-অজানা সব নিয়ম পালন করতে চেষ্টা করি।
কিন্তু চতুর্দিকে বিধর্মী ইহুদি-নাসারা আর নাস্তিকদের ষড়যন্ত্র, এর মধ্যে ইসলাম পালন করা যায়? তাই নিজের ঈমান-আমল বাঁচাতে হিজরতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। পরিবারের সদস্যরা আমার সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হওয়ায় সবাইকে রেখেই একদিন দেশত্যাগ করি। ভাবছেন নিজের দেশ ত্যাগ করে এখন অন্য কোনো রাষ্ট্রে আছি? না, আমি ভিন্ন কোনো দেশে যাইনি, বাংলাদেশেই আছি। তবে রাজনৈতিক কারণে এই যে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, আমেরিকা ইত্যাদি নামে কত-শত দেশ হয়েছে, সেইটা অস্বীকার করেছি মাত্র! কেন করব না, একজন হিন্দু কবির লেখা গান যে দেশের জাতীয় সঙ্গীত, সেই দেশকে স্বীকার করা কি সম্ভব? এই জমিন আল্লাহর, তাই পুরো পৃথিবীটাই একটা দেশ আমার কাছে।
পুরো বিশ্বের কথা ভাবলেও বাড়ি ছেড়ে খুব বেশি দূর যেতে পারিনি। কীভাবে যাব, আমার কাছে যে টাকা-পয়সা নেই। নেই মানে আমি আমার সমস্ত টাকা-পয়সা পরিত্যাগ করেছি। কেন করব না, টাকার মধ্যে মানুষের ছবি। মানুষ, জীবজন্তুর ছবি তো হারাম, এই হারাম জিনিস পকেটে রেখে কি নামাজ হবে?
আমার অবশ্য পকেটও নাই; মানে পকেট থাকবে জামা-পাজামা-পাঞ্জাবির, আমার ওসব কিছু নেই। নেই মানে পরিত্যাগ করেছি। কেন করেছি? এই জামা-কাপড় কোন বিধর্মীর মিল-ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয়েছে তা তো আর জানি না। আমি বিধর্মীদের তৈরি কোনো জিনিস ব্যবহার করি না। যদিও বাংলাদেশে মুসলমানই বেশি, হতে পারে কোনো মুসলিমের টেক্সটাইল মিলের পোশাক – হোক, মিল-কারখানার যন্ত্রপাতি তো আর আমাদের তৈরি না। ওগুলি ইহুদি-নাসারাদের দেশ থেকে আমদানি করা হয়, অতএব বাদ!
লজ্জা নিবারণের জন্য এখন গাছের ছাল-পাতা ব্যবহার করছি। একটু কষ্ট হয় যদিও, তা হোক, দীনের পথে চলতে চাইলে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কষ্টটা বেশি হয় বৃষ্টি এলে, আমার যে ঘর-বাড়ি নেই। আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে জংলা জায়গাটায় গাছের ডাল-পাতা দিয়ে একটা কুটির মতো বানিয়েছি, সেখানেই শরীর পেতে ঘুমাই। কষ্ট হলেও মনে সান্ত্বনা, কোনো বিধর্মীর তৈরি উপকরণ এখানে নেই, কোনো অমুসলিম মিস্ত্রীর হাতের স্পর্শ নেই!
যেহেতু আমি সযত্নে, সচেতনভাবে বিধর্মীদের এড়িয়ে চলি, প্রশ্ন উঠতে পারে খানাপিনা করি কী? হাহ্, আল্লাহর দুনিয়ায় কি খাবারের অভাব? নদী তীরের এই জঙ্গলে বুনো ফলমূল পাওয়া যায়, সেগুলো খাই। যখন এগুলো না থাকে ঘাস-পাতা, কন্দ যা পাই, তা-ই খাই। মাঝে মাঝে নদীতে হাত পেতে মাছ ধরে খাই, যদিও এভাবে মাছ ধরা খুব কষ্টকর, বেশিরভাগ দিনই পাই না। দীনের পথে থাকতে হলে এটুকু কষ্ট তো মেনে নিতেই হয়।
অবশ্য এখানে আসার পথে পদ্মার ধারে আস্তানা করার মতো দারুণ একটা জায়গা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে থাকিনি, কারণ ওই। পদ্মাবতী দেবীর নামে যে নদী, সেখানে থেকে কি আর ঈমান রক্ষা হয়? যদিও আড়িয়াল খাঁ পদ্মা থেকে বের হওয়া একটা শাখা — তা হোক, আমরা তো হিন্দু-বৌদ্ধ থেকে বের হয়েই মুসলিম হয়েছি নাকি? সালাম, আড়িয়াল খাঁ নদ তোমাকে। তুমি মুসলিম, আমিও মুসলিম।