প্রেম বিষয়টি অনুভূতির। দেখা যায় না। জীবনের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করার নাম প্রেম/ভালোবাসা। সৌন্দর্য যেখানে ভাব। সুন্দর তার রূপরস। সীমার মাঝে অসীমের লীলা।
প্রেম বিষয়টি রহস্য-মোড়কে জড়ানো। রহস্যভেদ অত্যন্ত কঠিন। তবে আনন্দের। যা উপলব্ধির বিষয়। মানব সমাজ তো ছোট অংশ, প্রাণী জগতেও নিছক প্রেম বলে কিছু নেই। মিলনের আদি ইচ্ছার ভদ্রোচিত প্রকাশের নাম প্রেম। প্রেম শরীর আর মনের খেলা।
প্রেমহীন জীবন কষ্টের। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘প্রেম আমাদিগকে ভিতর হইতে বাহির লইয়া যায়। আপন হইতে অন্যের দিকে লইয়া যায়, এক হইতে অন্যের দিকে অগ্রসর করিয়া দেয়। এ জন্যেই তাহাকে পথের আলো বলি।’
মানব জীবন জটিল ও সহজ। স্ববিরোধিতায় ঠাসা। প্রেমের প্রকাশও নানা রকমের। শরীর নির্ভর হলেও শরীর অতিক্রম করে প্রেম পথ চলে। আছে মিলনের আনন্দ, তেমনি বিরহের যন্ত্রণা।
প্রেম কখনো প্রভুত্বের শক্তি দিয়ে অর্জন করা যায় না। প্রেম থেকেই প্রেমের জন্ম। দরকার হয় শ্রদ্ধা ও যত্ন। এবং জ্ঞান। প্রেমে দরকার মনের স্নিগ্ধতা। তা হলেই উপভোগ্য হয়। মিলন-ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য আমরা পরস্পর প্রেম-অনুভূতি বিতরণ করি এবং একজন অন্যজনের চেতনায় বাসা বাঁধি। নান্দনিক ভাষায় মনোবাস। একজনের মনে আরেকজন। ক্রমে আবিষ্কার হতে থাকে পরস্পরের রহস্যময় প্রেমানুভূতি। অনেকটা শিহরণ।
আত্মপ্রেম থেকে অন্যকে ভালোবাসা বা তার প্রতি প্রেমের-বীজ অঙ্কুরিত হয়। ফ্রয়েড অবশ্য উল্টো কথা বলেছেন। আত্মপ্রেম না থাকলে অন্যের প্রেমে পড়া যায় না, আবার অন্যকে যদি নিজের মতো করে ভালোবাসা না যায়, তাহলে প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতির মধ্যে ঘাটতি থেকে যায়। প্রেম ও আত্মপ্রেম একই। নিজের প্রতি যে প্রেম তার অংশবিশেষ বা পুরোভাগে যখন কাউকে জায়গা করে দেওয়া হয়, তখন প্রেম মাটি-পানি পেয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আগে নিজের প্রতি প্রেমমগ্নতা, পরে সেই প্রেমরসে অন্যকে ভেজানো। আবেগ অনুভূতি বিতরণ এবং নিবেদন করার মাধ্যমে দুজনের আত্মপ্রেম এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। কোনো ব্যক্তি শুধু তার আত্মপ্রেম নিজের ভেতর ধারণ করতে পারে না। হয়তো কোনো কারণে প্রেমের প্রকাশ না ঘটালেও মনঃসমীক্ষণে তা অন্যকে আত্মপ্রেম বিতরণ করার জন্য মনের ভেতরে তা কখনো জাগ্রত, আবার কখনো অর্ধজাগ্রত অবস্থায় থাকে। কিন্তু আত্মপ্রেমের কোনো অংশ যদি কাউকে না দেওয়ার ইচ্ছা থাকে, তাহলেও বলা যাবে না তার প্রেমঅনুভূতিগুলো মৃত। অনুভূতির মৃত্যু নেই।
প্রেম কেবল নারী-পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নানাভাবে নানারূপে মা-বাবা, ঈশ্বর ও প্রকৃতির সঙ্গেও প্রেম ঘটে। সবকিছুর মূলে আত্মপ্রেম। বিষয়ভেদে প্রেমের উপস্থাপন নানারকম হতে পারে। কিন্তু অনুভূতি এক। নারী-পুরুষের প্রেম ছাড়া অন্যসকল প্রেমে যৌনমিলন না থাকলেও মিলন-অনুভূতির সূক্ষ্ম ক্রিয়া কাজ করে শরীর ও মনে।
শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাইরের জগতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ হলেও মাতৃপ্রেমের জন্য বিশেষ কোনো উপায় অবলম্বন করতে হয় না। এমনিতেই তা লাভ করা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রেমের বিষয় বৈচিত্রের পরিবর্তন হতে থাকে। জন্মের পর থেকে সবাই একটু-একটু করে স্বাধীন হতে শেখে। শর্তহীন মাতৃপ্রেম বা পিতৃপ্রেম থেকে সে নতুন কারও প্রেম অর্জন করতে চেষ্টা করে। কৈশোর প্রেম হলো, আমি ভালোবাসি যেহেতু ভালোবাসা পাই। আর প্রাপ্তবয়স্ক প্রেম হলো, তোমাকে আমার প্রয়োজন যেহেতু আমি তোমাকে ভালোবাসি।। তবে বয়স যতই বাড়ুক না কেনো, সকলেই মাতৃপ্রেম ও পিতৃপ্রেম পেতে আগ্রহী থাকে।
মাতৃপ্রেম প্রকৃতির মতো। মা তার সন্তানদের নিশ্চিন্ত চিত্ত গঠন করে। পিতৃপ্রেম জগতের সবকিছু নতুন করে ভাবতে শেখায়। পিতা সন্তানকে চারপাশের সামাজিক সমস্যাগুলো অতিক্রম করতে শেখায়। এই কাজে বাবার ভূমিকাগুলো তুলনামূলক শক্ত মনে হয়। সেজন্য বাবা অপেক্ষা মায়ের প্রতি আকর্ষণ-অনুভূতি অধিক স্নিগ্ধ। মাতৃপ্রেম ও পিতৃপ্রেম বিপরীতধর্মী হয়ে গেলেও হরমোনগত কারণে কন্যাশিশুরা পিতৃপ্রেম বেশি উপভোগ করে। পুত্রশিশুরা মাতৃপ্রেম।
বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের প্রেমের মতো ঈশ্বর প্রেম একই অনুভূতি তৈরি করে। ঈশ্বরের সঙ্গেও প্রেম হয়। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অন্যসকল প্রেমের মতো ঈশ্বর প্রেমও একই। উত্তেজনা-অনুভূতির মাধ্যমে প্রেমের পথ ধরে মুক্তির ইচ্ছা। যে অনুভূতির ভেতর দিয়ে প্রেমিককে কাছে পাওয়া যায়, ঈশ্বরকে কাছে পাওয়ার অনুভূতিও একই সমান্তরাল পথ ধরে এগিয়ে যায়। ঈশ্বরকে ধরা যায় না, অনুভবে তাঁকে ভেতরে ধারণ করতে হয়। ঈশ্বরের সঙ্গে সরাসরি মিলন ঘটে না, কিন্তু ধ্যান-উপাসনার মাধ্যমে অনুভব-অনুভূতির বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রেমের মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় অনুভূতি মনস্তত্ত্বের চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। ঈশ্বর প্রেমে কাম নেই, তবে প্রার্থনার মাধ্যমে কল্পনায় এক ধরনের মিলন ঘটে যায়, যা যৌনমিলন অনুভূতির চেয়ে কোনো অংশে কম উত্তেজনার নয়। প্রেমের মাধ্যমে মহাশক্তির প্রার্থনায় পাওয়া যায় প্রশান্তি। এবং মহাশক্তির অংশ হিসেবে আপন শক্তিও বাড়ে।
একইভাবে যখন প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে নিজের প্রেম বিলিয়ে দেওয়া হয়, তখন তা চিত্তে দেয় এক অনাবিল প্রশান্তি। প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পায় বিশ্বসত্তা।
নারী-পুরুষের প্রেমের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের প্রেম আর আমাদের জনপদের মানুষের প্রেম এক নয়। পুরোপুরি উল্টো। আমাদের প্রেমে আছে শৈল্পিক অনুভূতির মিশ্রণ। মিলনের ইচ্ছার প্রবলতা থাকলেও মনোজগতে প্রেম থাকে স্নিগ্ধতার রূপ ধরে। অথচ পাশ্চাত্যের মানুষের কাছে প্রেম-অনুভূতির প্রাবল্য কম। বেশি থাকে দৈহিক মিলনের সুখ ভাগাভাগির অংশীদারিত্ব। এমনকি প্রেমের বিষয়টি প্রাচীনকালেও পাশ্চাত্যে তাৎপর্যময় বিষয় হিসেবে তেমন গৃহীত হয়নি। উল্লেখ্য যে, প্রেম-ভালোবাসার উপর বিখ্যাত গ্রিক রচনা প্লেটোর ‘সিম্পোজিয়াম’। এই গ্রন্থে স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসার কথা একটিবার মাত্র উল্লেখ করা হয়েছে।
অথচ প্রাচীন আমল হতেই আমাদের শিল্প-সাহিত্যে প্রেমের শৈল্পিকতা দেখতে পাই। প্রাচীন ভারতের কাব্যনাটকের শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাস, রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (৩৭৫-৪১৫ খ্রি.) নবরত্নের একরত্ন। যৌবন ও প্রেমের কবি কালিদাস। মহাকবি কালিদাস তাঁর রঘুবংশম্-এ বলেছেন, প্রেম পরাস্পরাশ্রয়ম। হৃদয় সংবেদনের সঙ্গে প্রেমরসের প্রথম কথা শোনান মহাকবি কালিদাস। বললেন, মানুষের আনন্দময় আদি ইচ্ছা প্রকৃতির ছয় ঋতুর সঙ্গে প্রেম ও মিলন একসূত্রে গাঁথা। ঋতু আবর্তনের প্রথম কাজ প্রেম জাগানো। কালিদাস তাঁর রঘুবংশম্ ও কমারসম্ভবম্ কাব্যে প্রেম ও মিলনকে দেখান চিরন্তন সৌন্দর্য ও পরমপ্রাপ্তি হিসেবে। যেখানে ইচ্ছার প্রাবল্য থাকবে সৌন্দর্যের ভাষা হয়ে। কিন্তু তা যেন কখনোই জোরের বিষয় না হয়। স্নিগ্ধতার রূপ যেন হিংস্রতার রূপ না হয়। তাঁর মেঘদূতম্ কাব্যও প্রীতিরসে স্নিগ্ধ, জীবন রসে ভরপুর।
চর্যাগীতিতে প্রেম রাগ-অনুরাগ, বিবাহ-মিলন, সুখ-দুঃখ মিলিয়ে বিচিত্র অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। আবার বৈষ্ণব পদাবলির পুরোটাই প্রেমমনস্তত্ত্ব। বৈষ্ণব কবিরা ছিলেন প্রেমের কারিগর। কেবল ভাবজগতে তাদের বিচরণ। জ্ঞানে নয়। দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতক থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শ’ বছর ধরে সংস্কৃত, মৈথিলী, ব্রজবুলি এবং বাংলা ভাষায় রচিত বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের প্রায় পুরো অংশ গভীর প্রেমের আখ্যান, অমর প্রেমকথা। যা বিস্ময়ের। এই বিস্ময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও স্পর্শ করেছে। তাই কবির ভাষায়, ‘সত্য করে কহ হে বৈষ্ণব কবি। কোথা হতে পেয়েছিলে এই প্রেমছবি। কোথা হতে তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান, বিরহ তাপিত। হেরি কাহার নয়ান রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে? বিজন বসন্ত রাতে মিলন শয়ানে’।
রাজা লক্ষণ সেনের (১১৭৯-১২০৫ খ্রি.) পঞ্চরত্নের একজন কবি জয়দেব। বৈষ্ণব কবি জয়দেবের সৃষ্টি প্রেম স্বর্গীয় রূপ হয়ে জনপদের মানুষের মননে প্রবেশ করেছে। জয়দেব তার গীতগোবিন্দ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার যে বর্ণনা করেছেন, তা অতুলনীয়। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলারসের প্রথম গান শোনান কবি জয়দেব ও তার ভাবশিষ্য কবি বিদ্যাপতি। জয়দেব তুলে ধরলেন, মানুষের মনের বাসনা ও আবেগ নীতিশাস্ত্র দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। আলোর ঝর্ণা ধারার মতো তা বয়ে চলে।
জয়দেবের পর চন্ডীদাস তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে নতুন রস যোগ করলেন। চন্ডীদাস সে সময়ের মানুষের ভাব জগৎ ও প্রাকৃত জীবনের অলৌকিক প্রেমকথা ও প্রেমলীলা প্রধান বিষয় হিসেবে তুলে ধরেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হলো বিরহ-বেদনার আকুতি। কাব্যের রাধা মানবিক নারী। যা কবি চন্ডীদাসের সৃষ্টি। লৌকিক প্রেমলীলা সৃষ্টির উন্মাদনায় রক্তমাংসের জীবন প্রতিমা। আর এ সবের নানাবিধ উদ্ধৃতি দিয়ে অসাধারণ সব বিশ্লেষণ করেছেন শেখ সাদী।
এভাবেই যুগ-যুগ ধরে প্রেম তার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে অনন্তের পথ ধরে হেঁটে চলেছে। যা মানুষকে করে তৃপ্ত-প্রাশান্ত, আবার কখনো-কখনো বিরহ-বেদনায় করে অতৃপ্ত-অশান্ত।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রেম চিরন্তন কি-না? একমাত্র মাতৃপ্রেম ছাড়া আর কোনো প্রেমই আদি, অকৃত্রিম, চিরন্তন নয়। দশ হাজার বছর পূর্বেও সন্তান জন্মদানে পিতার ভূমিকা জানা ছিল না। ফলে পিতার কোনো স্বীকৃতি ছিল না। সে কারণে তার পূর্বে পিতৃপ্রেম উদ্ভূত হতে পারেনি। অথচ মানুষ বৃক্ষ পরিত্যাগ করে চল্লিশ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে এখানে পৌঁছেছে। কল্পনায় দেব-দেবীর আকার দিয়ে ঈশ্বর প্রেমের বিকাশ ঘটেছে। দশ হাজার বছর আগেও দেব-দেবীর আবির্ভাব ঘটেনি। আর এক ঈশ্বরের ধারণা তো পাঁচ হাজার বছর আগেও সৃষ্টি হয়নি। প্রকৃতি প্রেমও চিরন্তন নয়। মানুষ এক প্রকৃতিতে চিরদিন থাকে না। আর প্রকৃতি চির পরিবর্তনশীল। অন্যদিকে নারী-পুরুষের প্রেম, এঙ্গেলস যাকে যৌনপ্রেম বলেছেন, সে প্রেমও তুলনায় অতি সাম্প্রতিক। দশ হাজার বছর আগে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উদ্ভব হওয়ায় এবং পুরুষ তার মালিকত্ব অর্জন করায় এবং সে সম্পদ নিজের সন্তানের উত্তরাধিকারত্বে দিয়ে যাওয়ার বাসনায় একগামিতার উদ্ভব হয়। একগামিতা নারী-পুরুষের প্রেম হতে উদ্ভূত হয়নি, তবে একগামিতার অনুষঙ্গ হিসেবে নারী-পুরুষের প্রেম বিকশিত হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এটা পাঁচ হাজার বছরের বেশি নয়। ভবিষ্যতে সম্পদের মালিকত্বের ধরন পরিবর্তনে এতেও গুণগত পরিবর্তন সাধিত হবে। তা ছাড়া এ প্রেম একঘেয়েমিতায় নিষ্পিষ্ট হতে থাকে। এ প্রেম জীবনে বারবার আসতে পারে। এমনকি একই সময়ে একাধিক প্রেমও সৃষ্টি হতে পারে। এসব পর্যালোচনায় বলা যায়, একমাত্র মাতৃপ্রেম আদি, অকৃত্রিম, চিরন্তন, চিরসজীব।