মান্তু গুনগুন করছিল, ‘… আমার সুরগুলি পায় চরণ…’
বুতান জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা দাদু, চরণ মানে তো পা তাহলে সুর কী করে পা পাবে?’
– একটা শব্দের অনেকগুলো মানে হতে পারে। আর সেই শব্দগুলো বাক্যে প্রয়োগ না হলে তার মানে বোঝা যাবে না। যদি বলি, ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’ অথবা ‘কেন বঞ্চিত হব চরণে’ তবে এই বাক্য দুটোতে চরণ শব্দের অর্থ পা বা পদ। আবার ‘কবিতার চরণ’, এখানে কিন্তু চরণ মানে পা নয়, কবিতার পদ বা লাইন। আবার ‘পদ’ শব্দটার আরও অনেক মানে হয়। ‘অভিজিৎবাবু পদমর্যাদায় অনেক ওপরে’, এখানে ‘পদ’ মানে অবস্থা বা আধিপত্য ইত্যাদি। ‘আমি শিক্ষক পদপ্রার্থী’ এখানে কিন্তু ‘পদ’ মানে চাকরি। আবার রান্নার পদও কিন্তু হয়। এছাড়াও ব্যাকরণে একটা পদ আছে।
– আমিও ভাবছিলাম যে কখন তুমি ব্যাকরণে আসবে। ব্যাকরণের পদ তো আমরা জানি। শব্দ হল পদ। – বুতান জাহির করতে চায়।
– না, শব্দই কিন্তু পদ নয়। কোন শব্দ যখন বিভক্তি লাগাবার পর বাক্যে প্রবেশ করার ছাড়পত্র পেল এবং বাক্যে ব্যবহার করা হল তখনই তা একটা পদ হল। আবার শুধু শব্দই নয়, ধাতুও যখন বিভক্তিযুক্ত হয়ে বাক্যে প্রবেশ করল তখন সেটাও কিন্তু ‘পদ’। এটা কেমন জানিস? ধর, আলু আর পটল এগুলো আনাজ। এগুলো দিয়ে যখন আলু-পটলের ডালনা তৈরি করা হল তখন তা রান্নার একটা পদ হয়ে গেল। তেমনি শব্দ বা ধাতু বিভক্তি যোগ করে বাক্যে ব্যবহার করলে তা হবে পদ।
– তার মানে ধাতু থেকেও পদ হয়? – এবার মান্তুর প্রশ্ন।
– হয় বৈকি। তাকে বলে ক্রিয়াপদ। মনে রাখিস যে পদ দু-রকমের হয় – নামপদ আর ক্রিয়াপদ। অনেক সময় নামপদ থেকেও ক্রিয়াপদ তৈরি হয় আবার ক্রিয়াপদ থেকেও নামপদ তৈরি করা যায়। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। আগে পদ কত রকমের হয় তা তোদের বলি।
– সে তো তুমি এখনই বললে যে পদ দুই রকমের হয়। – বুতান বলল।
– সে কথা ঠিক। তবে নামপদেরও আবার কতকগুলো ভাগ আছে। আচ্ছা, তার আগে বোধ হয় শব্দ কত রকমের হয় সেকথা তোদের বলা দরকার।
– শব্দও অনেক রকম হয় বুঝি? – মান্তুর প্রশ্ন।
– হ্যাঁ। তোরা তো জানিস যে শব্দমূলের বা ধাতুমূলের সঙ্গে প্রত্যয় যোগ করে নতুন শব্দ তৈরি করা যায়। প্রত্যয় যোগ করে যখন শব্দ তৈরি হয় সেই শব্দকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যৌগিক, রূঢ় এবং যোগরূঢ়।
যে শব্দগুলোর অর্থ প্রকৃতি এবং প্রত্যয়ের মানে যোগ করে পাওয়া যায় তাকে যৌগিক শব্দ বলে।
– একটু সহজ করে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দাও। – মান্তুর আর্তি।
– বেশ। লক্ষ্ একটা ধাতু। এর সঙ্গে একটা ‘অ’ প্রত্যয় লাগালে (ধাতু) লক্ষ্+অ = ‘লক্ষ’ শব্দটা পাবি যার মানে এক শত হাজার। আবার (ধাতু) লক্ষ্+অ = লক্ষ এই ক্রিয়াটাও পাবি যার মানে দেখা। আবার ‘অনীয়’ প্রত্যয় যোগ করলে পাবি ‘লক্ষণীয়’ শব্দটা যা একটা বিশেষণ। এখন এই যে ক্রিয়া (লক্ষ) আমরা পেলাম আর যে বিশেষণ (লক্ষণীয়) আমরা পেলাম এদের সঙ্গে লক্ষ্ ধাতুর তো একটা সম্পর্ক আছে। এই ধরণের শব্দকে যৌগিক শব্দ বলে।
তোদের আগেও বলেছি, এই সুযোগে আবারও বলছি যে ‘লক্ষ’ যেখানে একটা ক্রিয়া যেমন, লক্ষ করা এই শব্দটার সঙ্গে কখনও ‘য-ফলা’ যোগ করবি না। য-ফলা যোগ করলেই শব্দটা হয়ে যাবে বিশেষণ। লক্ষ্+য। আবার অনীয় প্রত্যয় লাগালে কখনও য-ফলা দিবি না। লক্ষ্+অনীয় = লক্ষণীয়।
– কিন্তু ‘অনীয়’ প্রত্যয়ে তো ‘ন’। তাহলে ‘লক্ষণীয়’ শব্দে ‘ণ’ কেন? – আবারও মান্তু জিজ্ঞেস করে।
– তোরা কি ণত্ববিধি ভুলে গেছিস? এখানে ণত্ববিধি অনুযায়ী ‘ণ’ এসেছে।
আর কখনও কখনও প্রত্যয় যোগ করার পর এমন সমস্ত শব্দ পাওয়া যায় যার অর্থের সঙ্গে প্রকৃতি বা প্রত্যয়ের অর্থের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই সেই শব্দগুলোকে রূঢ় (বা রূঢ়ি) শব্দ বলে। যেমন ‘লক্ষ’ যার মানে শত সহস্র যার সঙ্গে প্রকৃতি বা প্রত্যয়ের অর্থের কোন সম্পর্ক নেই। আবার ধর, ‘মণ্ড’ এই শব্দটার মানে হল ভাতের ভাড়া। তাহলে এই শব্দের সঙ্গে যদি (ধাতু) পা+ক জুড়ে দিস তবে একটা নতুন শব্দ পাবি – মণ্ডপ যার মানে চাঁদোয়া ঘেরা স্থান বা দেবালয়, যে অর্থের সঙ্গে ভাতের মাড়ের কোন সম্পর্ক নেই। এই ধরণের শব্দকে রূঢ় (বা রূঢ়ি) শব্দ বলে। মণ্ডল, মণ্ডূপ, মণ্ডন, ইত্যাদি এই ধরনের শব্দ।বাংলায় অবশ্য এই ধরনের শব্দের সংখ্যা কম।
– আর যোগরূঢ় শব্দ কাকে বলে? এ দু ধরনের শব্দ মিলিয়ে নিশ্চয়ই। – বুতান।
– ঠিক ধরেছিস। বেশ কিছু শব্দ আছে যেগুলো যৌগিক শব্দও মনে করতে পারিস আবার রূঢ় শব্দও মনে করতে পারিস।
– সে আবার কী? হয় যৌগিক হবে আর নয়তো রূঢ় হবে। দুটোই আবার কী করে হয়? – বুতানের সংশয় আর যায় না।
– ‘মধুপ’ মানে কী? যে মধু পান করে। অর্থাৎ প্রকৃতি এবং প্রত্যয়ের সঙ্গে এর অর্থের সম্পর্ক আছে। তাই এটা যৌগিক শব্দ। আবার তোরা তো জানিস যে মধুপ মানে মৌমাছিও বোঝায়। অর্থাৎ এটা তখন রূঢ় শব্দ। তাই এই ধরনের শব্দকে যোগরূঢ় শব্দ বলে। ‘পঙ্কজ’, ‘সরোজ’ , ‘সরসিজ’, ইত্যাদি অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
এ তো গেল শব্দের প্রকার। পদ কত রকম বলতে হলে সাধারণভাবে বলা যায় বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ, অব্যয় আর ক্রিয়া এই পাঁচ রকম হল পদ।