হরিকেল প্রাচীন পূর্ববঙ্গের একটি জনপদ। খ্রিস্টীয় ‘সপ্তম শতকের’ প্রাচীন ভারতীয় লেখকগণ পূর্বভারতীয় একটি অঞ্চলকে হরিকেল বলে উল্লেখ করেন। তৎকালীন হরিকেল জনপদটি বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ভারতের ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের সিলেটের কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল বলে ধারণা পাওয়া যায়।
অষ্টম শতকে লেখা আর্য্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প বইয়ে বঙ্গ, সমতট ও হরিকেল নামের রাজ্যগুলোর কথা উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, সপ্তম-অষ্টম থেকে দশম-একাদশ শতক পর্যন্ত বঙ্গ (চন্দ্রদ্বীপ ও বঙ্গ) ও সমতটের সংলগ্ন, কিন্তু স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল হরিকেল। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের চন্দ্রদ্বীপ অধিকারের পর থেকে বঙ্গের অংশ বলে গণ্য হতে থাকে হরিকেল।
রাজা কান্তিদেবের সময় হরিকেলের রাজধানী ছিল বর্ধমানপুরায়। তখনকার চৈনিক পরিব্রাজক ইৎ সিং হরিকেলের অবস্থান বলছেন পূর্ব ভারতের পূর্বসীমায়। চট্টগ্রাম নগরের নাসিরাবাদ এলাকার একটি প্রাচীন মন্দিরে প্রাপ্ত তাম্রলিপি হরিকেল সম্পর্কে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য দলিল। সেটি নবম শতকের।
কান্তিদেবের আমলের। এতে পরিষ্কার বলা আছে, মহারাজাধিরাজ কান্তিদেব হরিকেলের শাসক ছিলেন।
মুদ্রা-কথা
গুপ্ত-পরবর্তী যুগে বাংলায় রৌপ্য মুদ্রার পুনরাবির্ভাব হয় হরিকেল মুদ্রার মধ্য দিয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জোবরা গ্রামে একটি মাটির পাত্রে দুই রকমের ৩৬টি মুদ্রা পাওয়া গেছে।
এগুলোর মধ্যে ৩৫টিতে হরিকেল প্রতীক। একটিতে প্রাচীন আরাকান রাজ প্রীতিচন্দ্রের প্রতীক আঁকা। শুরুর দিকে হরিকেলে রাজত্ব করতেন খড়গ বংশের রাজারা। তারপর অভ্যুদয় ঘটে দেব বংশের। তবে অষ্টম শতকে এ অঞ্চল শাসন করত আকর নামের এক রাজবংশের লোকেরা।
তাদের সময়কালের প্রাপ্ত মুদ্রাগুলোয় রাজার নাম—ললিতাকর, রম্যাকর, প্রদ্যুম্মাকর, অন্তাকর বা অন্যাকর। হরিকেল মুদ্রার বড় ভাণ্ডার পাওয়া গেছে ময়নামতি ও ত্রিপুরার বিলোনিয়ায়। গবেষকরা ধারণা করেন, হরিকেল ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। হরিকেল মুদ্রা মূলত সপ্তম ও অষ্টম শতকের দিকে এখনকার সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লার ময়নামতি ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ব্যবহৃত হতো। সিলেট থেকে ৩০-৪০টি হরিকেল মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আটটি আছে এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। ময়নামতির আনন্দবিহারে প্রাপ্ত মুদ্রাগুলোর মধ্যে ৬৩টি আছে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে। বিলোনিয়ায় পাওয়া মুদ্রাগুলো আকারে ছোট।
আরো কথা
হরিকেল মুদ্রা পাওয়া গেছে বিভিন্ন ওজনের ও আকারের। প্রায় সব মুদ্রাই গোলাকার। প্রথম দিককার মুদ্রাগুলোর ওজন ছিল ৬৪ রতি বা ৭.৫ গ্রাম। পরের দিকের মুদ্রাগুলোর ওজন কম। কোনোটি ৬০ রতি, কোনোটি বা ৫০ রতি। তবে কিছু বিশেষ রকমের মুদ্রা পাওয়া গেছে, যেগুলোর ওজন ৪.৩১ গ্রাম। দৈঘ্য ৫.৯৫ সেন্টিমিটার। গবেষকরা বলছেন, এগুলোতে আব্বাসীয় মুদ্রার প্রভাব রয়েছে।
মুদ্রা তৈরি পদ্ধতি
হরিকেল মুদ্রা রুপার তৈরি। রৌপ্য মানও উন্নত। রুপার সঙ্গে সোনা, সিসা ও তামা মিশ্রিত থাকত। আগে থেকে ওজন করা ধাতুর গুটি ব্যবহৃত হতো মুদ্রা তৈরিতে। গুটিকে পরে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নির্দিষ্ট চাকতিতে পরিণত করা হতো। তারপর মুদ্রার ছাঁচে নিয়ে আবার পিটিয়ে চিত্রাঙ্কন করা হতো।
মুদ্রার বৈশিষ্ট্য
মুদ্রার একদিকে আছে অর্ধশায়িত বৃষ। বৃষের গলায় কখনো কখনো ঘণ্টা দেখা যায়। ব্রাহ্মী অক্ষরে হরিকেল লিপিও রয়েছে। মুদ্রার আরেক দিকে আছে ত্রিশূল। অনেক মুদ্রায় হরি লেখাটি পড়তে পারা যায়।
মুদ্রাগুলো যে কাজে লাগত
হরিকেল মুদ্রাগুলো আরাকানের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রকাশ করে। হরিকেলের বণিকরা শ্যামদেশের নানচাও ও ব্রহ্মদেশের শান প্রদেশের বডউইন খনি থেকে উত্তোলিত রৌপ্য আমদানি করতেন। পরে সেগুলো আবার উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করতেন। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরেও হরিকেল রাজ্যের রৌপ্য মুদ্রা সংরক্ষিত আছে। উল্লেখ্য, মুদ্রার আবিষ্কার হয় দুই হাজার ৭০০ বছর আগে। ইজিয়ান সাগর তীরে ছোট্ট একটি রাষ্ট্র ছিল, নাম লিডিয়া। ব্যবসা-বাণিজ্যে মশহুর ছিল। লিডিয়াবাসীই প্রথম মুদ্রার কথা ভাবে। এর পরপরই ধাতব মুদ্রার ধারণা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে গ্রিসে। গ্রিসের প্রতিটি নগররাষ্ট্রের নিজস্ব মুদ্রা ছিল।
সংযুক্ত ছবিতে হরিকেলের পাঁচটি রৌপ্যমুদ্রা রয়েছে। মুদ্রাগুলোর মুখ্যদিকে অর্ধশায়িত বৃষের মূর্তি রয়েছে। বৃষের গলায় কখনও কখনও ঘণ্টা বা ঘুঙুরের ব্যবহারও দেখা যায় এবং প্রাচীন বাংলার ব্রাহ্মী ভাষায় লেখা ‘হরিকেল’ জনপদের নাম। গৌণ দিকে ত্রিশূল আকৃতি চিহ্ন রয়েছে।