স্কন্ধপুরাণ

» স্কন্দপুরাণ – সার্ধ সহস্রাব্দের বিবর্তন : পঞ্চম পর্ব

প্রাবন্ধিক :

স্কন্দপুরাণের রচনাকাল

চারটি প্রাচীন নেপালি পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে সমীক্ষাত্মক সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর এখন আধুনিক বিদ্বানরা এই রূপটিই যে স্কন্দপুরাণের আদিরূপের সবচেয়ে নিকটবর্তী রূপ এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ। স্কন্দপুরাণের সমীক্ষাত্মক সংস্করণের সঙ্গে যুক্ত বিদ্বানরা মনে করেন এই আদিরূপের রচনার কালপর্ব ৫৭০ থেকে ৬২০ সাধারণ অব্দের মধ্যবর্তী সময়। আদিরূপের রচনার সূত্রপাত কন্নৌজের মৌখরী শাসক শর্ববর্মন বা অবন্তীবর্মনের আমলে আর সমাপ্ত হয় হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে। এই আদিরূপটির একটি স্বল্প বিবর্তিত রূপ ৬৭০-৭০০ সাধারণ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে এবং আরও কিছুটা বিবর্তিত একটি রূপ ৭৭০-৮০০ সাধারণ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে উত্তর ভারত থেকে নেপালে পৌঁছায়।1

স্কন্দপুরাণের সমীক্ষাত্মক সংস্করণের দ্বিতীয় অধ্যায়ে (২.৩-২৯) প্রদত্ত অনুক্রমণিকার সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে গ্রন্থটিতে বর্ণিত বিষয়সমূহ ও বর্ণনার ক্রমের পার্থক্য আছে। সম্ভবত অনুক্রমণিকা অংশটি স্কন্দপুরাণের আরও প্রাচীন কোনও রূপ থেকে অপরিবর্তিত অবস্থায় নেপালি পাণ্ডুলিপিগুলিতে স্থান লাভ করেছে। অনুক্রমণিকায় উল্লিখিত বিষয়সূচি থেকে বোঝা যায়, প্রথম থেকেই স্কন্দপুরাণ রচনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের, বিশেষত উত্তর ও পশ্চিম ভারতের তৎকালীন জনপ্রিয় শৈব তীর্থগুলির সঙ্গে যুক্ত পৌরাণিক কাহিনিসমূহের বর্ণনার মাধ্যমে শৈব ধর্ম ও শৈবতীর্থগুলির মহিমামণ্ডন। এই তীর্থক্ষেত্রগুলির মধ্যে অবশ্য স্কন্দপুরাণে সবচেয়ে গুরুত্ব লাভ করেছে বারাণসী। এই গ্রন্থের ২৬-৩১ অধ্যায়ে বারাণসীর যে মাহাত্ম্য কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তা অত্যন্ত প্রাচীন এবং এখানে বর্ণিত পুরাকথার কিছু অংশ পরবর্তী কালে মত্স্যপুরাণে উল্লিখিত হয়েছে। এই অংশে বর্ণিত যক্ষ পূর্ণভদ্রের পুত্র যক্ষ পিঙ্গল বা হরিকেশকে শিব কর্তৃক বারাণসীর ক্ষেত্রপাল নিয়োগের কাহিনির এক বিস্তারিত রূপ পরবর্তী কালে স্কন্দপুরাণের ৭ খণ্ডের রূপের কাশীখণ্ডে (পুর্বার্ধ।৩২) দেখতে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের ৩২তম অধ্যায়ে বর্ণিত দক্ষযজ্ঞের কাহিনিতে উল্লিখিত কয়েকটি ঘটনা অন্য কোনও বিদ্যমান গ্রন্থে দেখা যায় না। স্কন্দপুরাণের সমীক্ষাত্মক সংস্করণের ৩৭-৫০ অধ্যায়ে ১৩টি নরকের বর্ণনা আছে। এই বর্ণনার সঙ্গে বিদ্যমান ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থসমূহের পার্থক্য ও সাধারণ অব্দের প্রথম কয়েক শতকে রচিত বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহের বর্ণনার মিল লক্ষণীয়। অন্ধকাসুর বধের কাহিনি এই গ্রন্থের এক বিশাল অংশ (৭৩-১১২ অধ্যায় ও ১৩০-১৫৭) অধ্যায় জুড়ে ব্যাপ্ত। এই পুরাণ গ্রন্থে বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার ও বরাহ অবতারের কাহিনি শৈব ভাবনা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাই অবতার শব্দের পরিবর্তে রূপ, বপু প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এই গ্রন্থে স্কন্দ অর্থাৎ কার্তিকেয় দেবের জন্ম থেকে তারকাসুর বধ পর্যন্ত কাহিনির বিস্তারিত উল্লেখের কারণে যে গ্রন্থটিকে স্কন্দপুরাণ নামকরণ করা হয়েছে তাও বোঝা যায়।

গুপ্ত সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ার পর ষষ্ঠ শতক সাধারণ অব্দের প্রথম দিকে মগধের (গয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার) মৌখরী বংশীয়রা এবং এর কয়েক দশক বাদে কান্যকুব্জের (কন্নৌজ) মৌখরী বংশীয়রা বর্তমান বিহার ও উত্তর প্রদেশে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করেন। ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকার উপর কান্যকুব্জের মৌখরীদের রাজত্ব বিস্তৃত হয়। কিন্তু ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে মৌখরী রাজত্বের পূর্ব দিকের কিছু অংশ পরবর্তী গুপ্তবংশীয় বলে অভিহিত শাসকদের অধিকারে চলে যায়। ষষ্ঠ শতকের শেষে বা সপ্তম শতকের শুরুতে পরবর্তী গুপ্তবংশীয়দের অধীনস্থ এক সামন্ত শাসক শশাঙ্ক গৌড়ের স্বাধীন শাসক হিসাবে রাজত্ব করতে শুরু করেন।ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধে মৌখরী বংশীয়দের রাজত্বের পশ্চিম দিকের এলাকায় থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশীয়দের উত্থান ঘটে। সপ্তম শতকের শুরুতে পুষ্যভূতি বংশীয় শাসক হর্ষবর্ধনের আমলে মৌখরীরা তাঁর সামন্ত শাসকে পরিণত হন, শশাঙ্ক পরাভূত হন, কার্যত সমস্ত উত্তর ভারত হর্ষবর্ধনের অধীনে চলে আসে। গুপ্ত বংশীয় শাসকরা বৈষ্ণব মতাবলম্বী ছিলেন, তাঁদের রাজত্বকালে উত্তর ভারতে বৈষ্ণব ধর্ম ব্যাপকতা লাভ করে। সাংখ্য দর্শন প্রভাবিত পাঞ্চরাত্র দর্শনের জনপ্রিয়তা উত্তর ভারতে বৃদ্ধি পায়। রামায়ণের রাম এবং মহাভারত ও হরিবংশের কৃষ্ণের বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্মকরণ চূড়ান্ত রূপ গ্রহণ করে। প্রাচীন বৈষ্ণব পুরাণ গ্রন্থ বিষ্ণুপুরাণও সম্ভবত গুপ্ত আমলের রচনা। গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসানের পর উত্তর ও পূর্ব ভারতে শৈব ধর্মের উত্থান ঘটে। শৈব পাশুপত সন্ন্যাসীদের সাংখ্য দর্শন প্রভাবিত পাশুপত দর্শনের ভাবনা উত্তর ও পূর্ব ভারত থেকে শুরু করে নেপাল পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়। মৌখরী বংশীয় শর্ববর্মন ও অবন্তীবর্মন শৈব ছিলেন, শশাঙ্কও শৈব ছিলেন। হর্ষবর্ধনও শৈব ছিলেন। এই কালপর্বে মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম শৈব ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়। শৈব ধর্মের এই উত্থানের যুগে শৈব ধর্ম বা বিশেষ করে পাশুপত মতাবলম্বীদের তীর্থস্থলগুলিকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে স্কন্দপুরাণের আদি রূপের রচনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে মনে হয়। এর পাশাপাশি নতুন জনপ্রিয় শৈব ধর্মকে বর্ণাশ্রমধর্মের সঙ্গে যুক্ত করাও স্কন্দপুরাণের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয়।

স্কন্দপুরাণের বিবর্তন

অম্বিকা খণ্ড ও রেবা খণ্ড গ্রন্থদ্বয়ের পাণ্ডুলিপির বিষয়ে আগেই উল্লেখ করেছি। এশিয়াটিক সোসাইটি গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত এই দুটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে মন্তব্য করেছিলেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, রেবা খণ্ডের এই পাণ্ডুলিপিটি বেঙ্কটেশ্বর প্রেস সংস্করণের স্কন্দপুরাণের রেবা খণ্ড থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। তিনি এই পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তু, অধ্যায়গুলির বিন্যাস ও অধ্যায়গুলির নামের সঙ্গে তাঁর নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে আবিষ্কৃত স্কন্দপুরাণের প্রাচীন পাণ্ডুলিপির সঙ্গে এত বেশি মিল খুঁজে পান যে এই রেবা খণ্ড গ্রন্থটিকে ঐ স্কন্দপুরাণেরই একটি রূপ বলে অভিহিত করেন। তিনি অম্বিকা খণ্ডের দুটি পাণ্ডুলিপির সঙ্গেও স্কন্দপুরাণের প্রাচীন পাণ্ডুলিপির প্রচুর মিল খুঁজে পান। তাঁর মনে হয়েছিল, স্কন্দপুরাণের প্রাচীন পাণ্ডুলিপির সঙ্গে এই দুই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির গভীরভাবে তুলনা করলে স্কন্দপুরাণের বিভিন্ন অংশে বিভাজন সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে।2

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দিশানির্দেশ অনুসরণ করে কোনও আধুনিক বিদ্বানকে স্কন্দপুরাণের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করতে দেখা যায়নি। দীর্ঘদিন বাদে কৃষ্ণপ্রসাদ ভট্টরাই তাঁর ১৯৮৮ সালে সম্পাদিত ‘স্কন্দপুরাণস্য অম্বিকাখণ্ড’ গ্রন্থটির জন্য নেপালের প্রাচীন তিনটি স্কন্দপুরাণের পাণ্ডুলিপির সাথে সাথে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত দেবনাগরী লিপিতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি ব্যবহার করেন। এরপর স্কন্দপুরাণের সমীক্ষাত্মক সংস্করণের সম্পাদকরা রেবা খণ্ডের পাণ্ডুলিপি ও অম্বিকা খণ্ডের পাণ্ডুলিপিসমূহ অধ্যয়ন করে নিঃসন্দেহ হন, এই দুটি গ্রন্থ প্রাচীন স্কন্দপুরাণেরই পরবর্তীকালের কিছুটা বিবর্তিত রূপ। তাই স্কন্দপুরাণের সমীক্ষাত্মক সংস্করণের প্রস্তুতির জন্য তাঁরা স্কন্দপুরাণের চারটি প্রাচীন নেপালি পাণ্ডুলিপির সাথে রেবা খণ্ডের পাণ্ডুলিপি ও অম্বিকা খণ্ডের ৭টি পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করছেন। সমস্ত পাণ্ডুলিপির প্রথম থেকে ১৬২তম অধ্যায় পর্যন্ত পাঠ প্রায় একই রকম, কিন্তু পরবর্তী অংশে স্কন্দপুরাণের প্রাচীন নেপালি পাণ্ডুলিপিগুলির সঙ্গে রেবা খণ্ডের পাণ্ডুলিপি ও অম্বিকা খণ্ডের পাণ্ডুলিপিগুলির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।

স্কন্দপুরাণের সমীক্ষাত্মক সংস্করণের সঙ্গে যুক্ত বিদ্বানরা এই পাণ্ডুলিপিসমূহ ও মধ্যযুগের স্মৃতিনিবন্ধ গ্রন্থগুলিতে উদ্ধৃত স্কন্দপুরাণের শ্লোকগুলির তুলনামূলক অধ্যয়ন করে স্কন্দপুরাণের বিবর্তনের ধারা সম্পর্কে মোটামুটিভাবে একটি ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। স্কন্দপুরাণের আদি রূপে কোনও খণ্ডের বিভাজন ছিল না। তাই যে নিবন্ধকাররা এই অখণ্ড রূপটি উদ্ধৃত করেছেন তাঁরা কোনও খণ্ডের উল্লেখ করেননি। অনুমান করা হয়েছে, দ্বাদশ শতক সাধারণ অব্দের পূর্ববর্তী কোনও সময়ে (খুব সম্ভবত নবম শতক সাধারণ অব্দে) স্কন্দপুরাণের এই অখণ্ড রূপের এক বড় রকমের পরিবর্তন করা হয়। এই পরিবর্তনের ফলে ১৬২তম অধ্যায়ের পূর্ববর্তী কিছু অধ্যায় বাদ যায়, আর ১৬২তম অধ্যায়ের পরবর্তী অংশ আকারে বৃদ্ধি পায়। এই পরিবর্তন সম্ভবত পূর্ব ভারতের কোথাও করা হয়েছিল।

ভট্ট লক্ষ্মীধর কন্নৌজের গাহড়বাল বংশীয় শাসক গোবিন্দচন্দ্রের সান্ধিবিগ্রহিক (যুদ্ধমন্ত্রী) ছিলেন। দ্বাদশ শতক সাধারণ অব্দের প্রথমার্ধে তিনি তাঁর কৃত্যকল্পতরু নামের ধর্মনিবন্ধ গ্রন্থের ১৪টি কাণ্ড রচনা করেছিলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে স্কন্দপুরাণের কোনও খণ্ড বিভাজনের কথা উল্লেখ করেননি। কৃত্যকল্পতরু গ্রন্থের নিয়তকালকাণ্ড অংশে স্কন্দপুরাণ থেকে এক দীর্ঘ উদ্ধৃতি রয়েছে। এই উদ্ধৃত শ্লোকগুলি প্রাচীন নেপালি পাণ্ডুলিপিতে নেই, কিন্তু অম্বিকা খণ্ড ও রেবা খণ্ডের পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়। আবার কৃত্যকল্পতরু গ্রন্থের ব্রতকাণ্ড ও রাজধর্মকাণ্ড অংশে উদ্ধৃত শ্লোকগুলি প্রাচীন নেপালি পাণ্ডুলিপিতে বিদ্যমান।3 এর ভিত্তিতে অনুমান করা হয়েছে, দ্বাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভট্ট লক্ষ্মীধর স্কন্দপুরাণের যে পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করেছেন, তা নেপালি পাণ্ডুলিপির বৃহৎ পরিবর্তনের পরবর্তী এবং অম্বিকা খণ্ড ও রেবা খণ্ড উভয়েরই নিকট পূর্বসূরি কোনও পাণ্ডুলিপি।4 কৃত্যকল্পতরু গ্রন্থের তীর্থবিবেচনকাণ্ড অংশেও স্কন্দপুরাণ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এই উদ্ধৃত অংশের সঙ্গে রেবা খণ্ডের মিল বেশি।5 দ্বাদশ শতক সাধারণ অব্দের দ্বিতীয়ার্ধে, ১০৯১ শকাব্দে অর্থাৎ ১১৬৮ বা ১১৬৯ সাধারণ অব্দে বল্লালসেন তাঁর দানসাগর গ্রন্থ রচনা করেন। এখানে তিনি (উপক্রমণিকা।৬২) স্কন্দপুরাণের তিনটি খণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন – পৌণ্ড্র, রেবা ও অবন্তী খণ্ড, কিন্তু তিনি অপ্রামাণিক বলে এই খণ্ড তিনটি ব্যবহার করেননি।দানসাগর গ্রন্থে তিনি স্কন্দপুরাণের কোনও একটি অখণ্ড সংস্করণের পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃত করেছেন এবং এই পাণ্ডুলিপিটি অম্বিকা খণ্ড ও রেবা খণ্ড উভয়েরই পূর্বসূরি কোনও পাণ্ডুলিপি। বল্লালসেন তাঁর অদ্ভুতসাগর গ্রন্থে স্কন্দপুরাণের একটি শ্লোকার্ধ উদ্ধৃত করেছেন। এই শ্লোকার্ধটি অম্বিকা খণ্ড ও রেবা খণ্ড উভয় গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতেই পাওয়া যায়।6 চণ্ডেশ্বর ঠক্কুর মিথিলার কর্ণাট রাজবংশের শাসক হরিসিংহদেবের সান্ধিবিগ্রহিক ছিলেন। চতুর্দশ শতক সাধারণ অব্দের প্রথম দিকে তিনি ৭টি অংশে বিভক্ত ধর্মনিবন্ধ গ্রন্থ স্মৃতিরত্নাকর রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থের কৃত্যরত্নাকর অংশে স্কন্দপুরাণের কোনও অখণ্ড সংস্করণের পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং লক্ষ্মীধর উদ্ধৃত করেননি অথচ নেপালি পাণ্ডুলিপিতে আছে এমন শ্লোক চণ্ডেশ্বরকে উদ্ধৃত করতে দেখা গিয়েছে। সম্ভবত লক্ষ্মীধর ও চণ্ডেশ্বর অম্বিকা খণ্ড ও রেবা খণ্ডের পূর্বসূরি কোনও একই পাঠযুক্ত পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করেছেন।7 ষোড়শ শতক সাধারণ অব্দে রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ২৮টি অংশ বিশিষ্ট তাঁর স্মৃতিতত্ত্ব গ্রন্থের আহ্নিকতত্ত্ব, মলমাসতত্ত্ব ও একাদশীতত্ত্ব অংশে কাশী খণ্ড থেকে, তিথিতত্ত্ব ও শ্রাদ্ধতত্ত্ব অংশে নাগর খণ্ড থেকে এবং তিথিতত্ত্ব, মলমাসতত্ত্ব ও শ্রাদ্ধতত্ত্ব অংশে প্রভাস খণ্ড থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন।8 এই সময় কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত স্কন্দপুরাণই ধর্মনিবন্ধকারদের কাছে বেশি পরিচিত ছিল, বুঝতে অসুবিধা হয় না।

এ কথা অনুমান করলে ভুল হবে না, দ্বাদশ শতক সাধারণ অব্দের শেষার্ধেই স্কন্দপুরাণের খণ্ডে বিভাজন ও সম্প্রসারণ শুরু হয়ে গিয়েছিল কিন্তু চতুর্দশ শতক সাধারণ অব্দ পর্যন্ত স্মৃতিনিবন্ধকাররা পুরোনো অখণ্ড সংস্করণকেই প্রকৃত স্কন্দপুরাণ বলে জানতেন। কিন্তু তারপর ধর্মনিবন্ধকাররা নতুন খণ্ডাত্মক সংস্করণকে প্রকৃত স্কন্দপুরাণ বলে ব্যবহার করতে শুরু করলেন, পুরোনো সংস্করণটির পাণ্ডুলিপির লিপিকররা একে রেবা খণ্ড ও অম্বিকা খণ্ড নামে পুষ্পিকায় অভিহিত করতে শুরু করলেন। সম্ভবত তাঁরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, পুরোনো পাণ্ডুলিপির পুষ্পিকায় কেবল স্কন্দপুরাণ বলে উল্লেখ থাকলেও গ্রন্থটি সম্ভবত স্কন্দপুরাণের তাঁদের অজ্ঞাত কোনও একটি খণ্ড। এমনই করে ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেল সার্ধ সহস্রাব্দ প্রাচীন অখণ্ড সংক্ষিপ্ত স্কন্দপুরাণ, তার স্থান গ্রহণ করল নবীন ৭টি খণ্ডে বিভক্ত বিশাল স্কন্দপুরাণ। আজ এই বিবর্তনের ইতিহাসের উপর থেকে যবনিকা একটু একটু করে উত্তোলিত হচ্ছে। কীভাবে স্কন্দপুরাণের এই বিশাল বিবর্তন ঘটেছিল, সেই বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। প্রাচীন স্কন্দপুরাণে বর্ণিত পুরাকথার সঙ্গে নবীন স্কন্দপুরাণে তার বিবর্তিত রূপের তুলনামূলক গবেষণার ফলে অন্ত-মধ্যযুগের ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ম ভাবনার বিবর্তন সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

(সমাপ্ত)

তথ্যসূত্র:

  1. Hans T. Bakker, ‘Origin and Growth of the Purāṇic Text Corpus, With Special Reference to the Skandapurāṇa’; Delhi: Motilal Banarsidass, 2004.
  2. Hans T. Bakker, ‘The World of the Skandapurāṇa: Northern India in the Sixth and Seventh Centuries’; Leiden: Brill, 2014.
  3. Peter C. Bisschop, ‘Early Śaivism and the Skandapurāṇa: Sects and Centres’; Groningen: Egbert Forsten, 2006.
  4. R. Adriaensen, H.T. Bakker, and H. Isaacson, “Towards A Critical Edition of the Skandapurāṇa” in ‘Indo-Iranian Journal, Vol. 37, Issue 4 (Jan 1994)’; Brill, 1994, pp. 325—331.

পাদটীকা

  1. Hans T. Bakker, ‘The World of the Skandapurāṇa: Northern India in the Sixth and Seventh Centuries’; Leiden: Brill, 2014, pp. 137-138.
  2. Haraprasāda Shāstrī, ‘A Descriptive Catalogue of Sanskrit Manuscripts in the Government Collection under the Care of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V’, p. clxxviii.
  3. Kengo Harimoto, “Some Observations on the Revā- and the Ambikākhaṇḍa Recensions of the Skandapurāṇa” in Hans T. Bakker edited, ‘Origin and Growth of the Purāṇic Text Corpus, With Special Reference to the Skandapurāṇa’; Delhi: Motilal Banarsidass, 2004, pp. 41-64.
  4. Kengo Harimoto, “The Original Skandapurāṇa, Lakṣmīdhara and Caṇḍeśvara” in ‘Indo-Iranian Journal, Vol. 49, Issue 1/2 (Spring 2006)’; Brill, 2006, pp. 23-38.
  5. Peter Bisschop, “On a Quotation of the Skandapurāṇa in the Tīrthavivecanakāṇḍa of Lakṣmīdhara’s Kṛtyakalpataru” in ‘Indo-Iranian Journal, Vol. 45, No. 3 (2002)’; Brill, 2002, pp. 231-243.
  6. Yuko Yokochi, “The Relation between the Skandapurāṇa and the Āvantyakhaṇḍa” in Hans T. Bakker edited, ‘Origin and Growth of the Purāṇic Text Corpus, With Special Reference to the Skandapurāṇa’; Delhi: Motilal Banarsidass, 2004, p. 79.
  7. Kengo Harimoto, “The Original Skandapurāṇa, Lakṣmīdhara and Caṇḍeśvara”, pp. 35-36.
  8. Bhabatosh Bhattacharya, ‘Raghunandana’s Indebtedness to his Predecessors’; Calcutta: The Asiatic Society, 1955, pp. 133-134.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *