স্কন্দপুরাণের আরও রূপ
স্কন্দপুরাণের অংশ বলে উল্লিখিত বেশ কয়েকটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখনীয় অম্বিকা খণ্ড ও রেবা খণ্ড নামের দুটি গ্রন্থ। অম্বিকা খণ্ডের এখনও পর্যন্ত ৭টি কাগজের পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে রয়েছে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত দেবনাগরী ও বাংলা লিপিতে লেখা দুটি তারিখবিহীন পাণ্ডুলিপি1, বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত দেবনাগরী লিপিতে লেখা একটি তারিখবিহীন পাণ্ডুলিপি2, বারাণসীর সংস্কৃত কলেজে সংরক্ষিত দেবনাগরী লিপিতে লেখা একটি তারিখবিহীন পাণ্ডুলিপি,3 কলকাতার সংস্কৃত কলেজে সংরক্ষিত ১৯৫৫ বিক্রম সংবতে (১৮৯৮ বা ১৮৯৯ সাধারণ অব্দে) দেবনাগরী লিপিতে লিপিবদ্ধ একটি পাণ্ডুলিপি4, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত বাংলা লিপিতে লেখা একটি তারিখবিহীন পাণ্ডুলিপি এবং যোধপুরের মহারাজা মানসিংহ পুস্তক প্রকাশ গ্রন্থগারে সংরক্ষিত ১৮৭৭ বিক্রম সংবতে (১৮১৯ বা ১৮২০ সাধারণ অব্দে) দেবনাগরী লিপিতে লিপিবদ্ধ একটি পাণ্ডুলিপি। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও শহরে ১৬৮২ সাধারণ অব্দে লিপিবদ্ধ বাংলা লিপিতে লেখা রেবা খণ্ডের একটি মাত্র কাগজের পাণ্ডুলিপি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত আছে।5 এই রেবা খণ্ড গ্রন্থটি আবন্ত্য খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত রেবা খণ্ডের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই দুটি গ্রন্থের আসল পরিচিতি সম্পর্কে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
এই দুটি গ্রন্থ ছাড়া তাপী খণ্ড (বা তাপী মাহাত্ম্য), ভীমা খণ্ড, পর্বত খণ্ড, অযোধ্যা খণ্ড, মথুরা খণ্ড, পাতাল খণ্ড, নির্বাণ খণ্ড, উমা খণ্ড, পরশুরাম খণ্ড, ভূ খণ্ড প্রমুখ এমন কয়েকটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া যায়, যে গ্রন্থগুলির পুষ্পিকায় স্কন্দ পুরাণের অংশ বলে উল্লিখিত হয়েছে। মহাবালেশ্বর মাহাত্ম্য, শ্রীমাল মাহাত্ম্য (বা শ্রীমাল খণ্ড), বিশ্বামিত্রী মাহাত্ম্য, সিংহাচলক্ষেত্র মাহাত্ম্য, বিরজা মাহাত্ম্য সমেত বেশ কয়েকটি মাহাত্ম্য পর্যায়ের গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে গ্রন্থগুলিকে স্কন্দপুরাণের অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। করতোয়া মাহাত্ম্য গ্রন্থটির ১৮৬২ সালে লিপিবদ্ধ একটি পাণ্ডুলিপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। ১৮৯১ সালে এই গ্রন্থটি রাজচন্দ্র ন্যায়পঞ্চাননের বাংলা অনুবাদ সমেত প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯২৯ সালে প্রভাস চন্দ্র সেনের লেখা ‘মহাস্থান অ্যান্ড ইটস এনভায়রনস’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট হিসাবে আবার প্রকাশিত হয়। ৮৫টি শ্লোক বিশিষ্ট করতোয়া মাহাত্ম্যের পুষ্পিকায় গ্রন্থটিকে উত্তর পৌণ্ড্র খণ্ডের অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।6 কার্তিকেয় ব্রতকথা, উপাঙ্গললিত ব্রতকথা, অনন্ত ব্রতকথা, বটসাবিত্রী ব্রত বা অদুঃখনবমী ব্রত গ্রন্থের মতো কয়েকটি ব্রত বা ব্রতকথা নামে অভিহিত গ্রন্থের পুষ্পিকাতেও গ্রন্থগুলিকে স্কন্দপুরাণের অংশ বলে উল্লিখিত হয়েছে। মাহাত্ম্য বা ব্রতকথা নামে অভিহিত এই গ্রন্থসমূহ বা তাদের কোনও প্রাচীনতর রূপ বিগত সহস্রাব্দের কোনও সময় স্কন্দপুরাণের কোনও রূপের অঙ্গীভূত ছিল কিনা আজ বলা কঠিন।
নেপালের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিসমূহ
উনিশ শতকের শেষে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নেপালে স্কন্দপুরাণের একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপির আবিষ্কার প্রথম ইঙ্গিত করে স্কন্দপুরাণের ৭টি খণ্ড বা ৬টি সংহিতা বিশিষ্ট রূপের সূত্রপাত সম্ভবত অন্ত-মধ্যযুগে। ১৮৯৮-১৮৯৯ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কাঠমান্ডুতে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগারে বেশ কিছু সংখ্যক তালপাতার সংস্কৃত পাণ্ডুলিপির সন্ধান পান। এরই মধ্যে একটি পুথি স্কন্দপুরাণের এখনও পর্যন্ত জ্ঞাত সর্বপ্রাচীন পাণ্ডুলিপি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর প্রতিবেদনে এই পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে, স্কন্দপুরাণের এই পাণ্ডুলিপির কোনও পুষ্পিকাতেই কোনও খণ্ডের নামের উল্লেখ নেই। এর ভিত্তিতে তিনি অনুমান করেন স্কন্দপুরাণের বহুসংখ্যক খণ্ড ও মাহাত্ম্যে বিভাজন এক ক্রমিক বিবর্তন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও সংস্কৃত বিদ্বান সেসিল বেন্ডাল পাণ্ডুলিপির লিপির গড়ন বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, স্কন্দপুরাণের এই পাণ্ডুলিপিটি পরমেশ্বরতন্ত্র গ্রন্থের ৮৫৯ সাধারণ অব্দে লিপিবদ্ধ একটি পাণ্ডুলিপির অন্তত দুই শতাব্দী আগে লেখা, অতএব ৬৫৯ সাধারণ অব্দ বা তার পূর্বে লিপিবদ্ধ।7 এখানে উল্লেখ্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও সেসিল বেন্ডাল পরমেশ্বরতন্ত্র গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির তারিখ হর্ষ সংবতের ২৫২ সন ধরে এই গণনা করেছিলেন। কিন্তু আসলে এই পাণ্ডুলিপির তারিখ মানদেব (অর্থাৎ অংশুবর্মন) সংবতের ২৫২ সন, অর্থাৎ ৮২৯ সাধারণ অব্দ।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উল্লিখিত স্কন্দপুরাণের এই তালপত্রের পাণ্ডুলিপিটি (সংগ্রহ সংখ্যা ২-২২৯) বর্তমানে নেপালের কাঠমান্ডুতে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় অভিলেখালয়ে সংরক্ষিত আছে। পরবর্তী কালে এই পাণ্ডুলিপিটির পুষ্পিকায় সমাপ্তির তারিখ কোনও অজ্ঞাত পঞ্জিকার ২৩৪ সনের চৈত্র মাসের শুক্লা দ্বাদশী বলে উল্লেখ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এই অজ্ঞাত পঞ্জিকাটি মানদেব (অর্থাৎ অংশুবর্মন) সংবত ধরে নিয়ে এই পাণ্ডুলিপিটি ৮১১ (বা ৮১০) সাধারণ অব্দে লিখিত বলে আধুনিক বিদ্বানরা মনে করেন।8 এই পুথিটিই এখনও পর্যন্ত নেপালে প্রাপ্ত তারিখযুক্ত সংস্কৃত পাণ্ডুলিপির মধ্যে প্রাচীনতম। পরবর্তী কালে সংগৃহীত স্কন্দপুরাণের আরও দু’টি তালপত্রের গুপ্তোত্তর বা লিচ্ছবি লিপিতে লেখা প্রাচীন তারিখবিহীন পাণ্ডুলিপি (সংগ্রহ সংখ্যা ১-৮৩১ এবং ৪-২২৬০) বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অভিলেখালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে। আধুনিক বিদ্বানরা লিপির বিশ্লেষণ করে এই দু’টি পাণ্ডুলিপিটিও প্রায় সমান প্রাচীন বলে উল্লেখ করেছেন। কৃষ্ণপ্রসাদ ভট্টরাই তাঁর ১৯৮৮ সালে সম্পাদিত ‘স্কন্দপুরাণস্য অম্বিকাখণ্ড’ গ্রন্থটির জন্য স্কন্দপুরাণের এই তিনটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ব্যবহার করেন। স্কন্দপুরাণের সমীক্ষাত্মক সংস্করণের জন্য এই তিনটি পাণ্ডুলিপির সাথে অক্সফোর্ডের বোদলেইয়ান লাইব্রেরিতে ১৯৯২ সালে সংগৃহীত আর একটি তালপত্রের গুপ্তোত্তর বা লিচ্ছবি লিপিতে লেখা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি (সংগ্রহ সংখ্যা স্যাংস্ক.এ.১৪ (আর)) ব্যবহৃত হয়েছে। বোদলেইয়ান লাইব্রেরির স্যাংস্ক.এ.১৪ (আর) সংখ্যক পাণ্ডুলিপি ও কাঠমান্ডুর রাষ্ট্রীয় অভিলেখালয়ে সংরক্ষিত ৪-২২৬০ সংখ্যক পাণ্ডুলিপি একই মূল পাণ্ডুলিপির দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশ।
[ক্রমশঃ]
তথ্যসূত্র:
- Heinrich von Stietencron, Angelika Malinar, K.-P. Gietz, A. Kollmann, P. Schreiner and M. Brockington edited, ‘Epic and Purāṇic Bibliography (up to 1985) annotated and with indexes, Part II S-Z, Indexes’; Wiesbaden: Otto Harrassowitz, 1992, pp. 1160-1170.
- Ludo Rocher, ‘The Purāṇas’; Wiesbaden: Otto Harrassowitz, 1986, pp. 228-237.
- R.C. Hazra, ‘Studies in the Purāṇic Records on Hindu Rites and Customs’; Dacca: The University of Dacca, 1940, pp. 157-166.
পাদটীকা
- Haraprasāda Shāstrī, ‘A Descriptive Catalogue of Sanskrit Manuscripts in the Government Collection under the Care of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V Purana Manuscripts’, p. 579 and Rajendralala Mitra, ‘Notices of Sanskrit MSS. Vol. VI’; Calcutta: The Baptist Mission Press, 1882, pp. 117-121.
- Julius Eggeling edited, ‘Catalogue of the Sanskrit Manuscripts in the Library of the India Office, Part VI’, pp. 1321-1323.
- Kubernath Shukla, ‘A Descriptive Catalogue of the Sanskrit Manuscripts Acquired for and Deposited in the Government Sanskrit College Library, Sarasvatī Bhavana, Varanasi, during the years 1791-1950, Vol. IV Purāna-Itihāsa and Gitā MSS’; Allahabad: The Superintendent of Printing and Stationery, Government of Uttar Pradesh, 1957, pp. 10-11.
- Hrīshikeśa Śastrī and Śiva Chandra Gui, ‘Descriptive Catalogue of Sanskrit Manuscripts in the Library of the Calcutta Sanskrit College, Vol. IV’, pp. 186-187.
- Haraprasāda Shāstrī, ‘A Descriptive Catalogue of Sanskrit Manuscripts in the Government Collection under the Care of the Asiatic Society of Bengal, Vol. V’, pp. 568-572.
- Prabhas Chandra Sen, ‘Mahasthan and its Environs (with a Map and Illustrations)’; Rajshahi: Varendra Research Society, 1929, pp. 25-28.
- Hara Prasad Sastri, ‘A Catalogue of Palm-Leaf and Selected Paper Mss. Belonging to the Durbar Library, Nepal’; Calcutta: The Baptist Mission Press, 1905, p. lii.
- Kengo Harimoto, “In Search of the Oldest Nepalese Manuscript” in ‘Rivista Degli Studi Orientali, Vol. 84, No. 1/4′; Sapienza – Universita di Roma, 2011, pp. 85–106.