স্কন্ধপুরাণ

» স্কন্দপুরাণ – সার্ধ সহস্রাব্দের বিবর্তন : দ্বিতীয় পর্ব

প্রাবন্ধিক :

স্কন্দপুরাণের সাত খণ্ড

স্কন্দপুরাণের ৭ খণ্ড বিশিষ্ট রূপটির সম্পর্কে নারদ পুরাণের পূর্বার্ধের ১০৪তম অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। নারদ পুরাণে (১০৪.১৪২-১৬৭) বর্তমান নাগর খণ্ডের বিস্তারিত উল্লেখ থেকে এই বিবরণটি সপ্তদশ শতাব্দী সাধারণ অব্দ বা তারও পরবর্তী কালে রচিত বলে অনুমান করা যায়। তবে, এখানে বর্ণিত স্কন্দপুরাণের রূপের সঙ্গে ভারতে মুদ্রিত সংস্করণগুলির রূপের কিছু পার্থক্য আছে।

প্রথম মাহেশ্বর খণ্ডের সূত্রপাত উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথ তীর্থের মাহাত্ম্য গ্রন্থ ৩৫ অধ্যায় বিশিষ্ট কেদার খণ্ডের মাধ্যমে। ১৯০৬ সালে বম্বইয়ের বেঙ্কটেশ্বর প্রেস থেকে কেদার খণ্ডের একটি মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কুমারিকা খণ্ড বা কৌমারিকা খণ্ড ৬৬ অধ্যায়ে গুজরাতের আনন্দ জেলায় অবস্থিত মহীসাগরসঙ্গম তীর্থের মাহাত্ম্য বর্ণনা। সপ্তদশ শতক সাধারণ অব্দে এই গ্রন্থটি রচিত। সব শেষে অরুণাচল খণ্ড তামিলনাড়ুর তিরুবান্নামালাই শহরের অরুণাচল পর্বতের তীর্থসমূহের মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত। অরুণাচল খণ্ড দু’টি অর্ধে বিভক্ত – এর পূর্বার্ধে ১৩টি অধ্যায় ও উত্তরার্ধে ২৪টি অধ্যায় আছে।

দ্বিতীয় বিষ্ণু বা বৈষ্ণব খণ্ডের শুরু অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলার তিরুপতি বা বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরের জন্য পরিচিত তিরুমালা, শেষাচল বা বেঙ্কটাচল পর্বতের তীর্থ নিয়ে ৪০টি অধ্যায়ে সম্পূর্ণ বেঙ্কটাচল মাহাত্ম্য গ্রন্থের মাধ্যমে। এরপর ওড়িশার পুরী নিয়ে লেখা পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য বা উত্কল খণ্ড। বেঙ্কটেশ্বর প্রেস সংস্করণের পুরুষোত্তমক্ষেত্র মাহাত্ম্য ৪৯টি অধ্যায় বিশিষ্ট, বঙ্গবাসী প্রেস সংস্করণের উত্কল খণ্ড ৫৭টি অধ্যায় বিশিষ্ট আর গুরুমণ্ডল গ্রন্থমালা সংস্করণের উত্কল খণ্ড ৬০টি অধ্যায় বিশিষ্ট। পরবর্তী ৮ অধ্যায়ের বদরিকাশ্রম মাহাত্ম্য উত্তরাখণ্ডের বদ্রিনাথ তীর্থের বিষয়ে রচিত। এরপর কার্তিক, মার্গশীর্ষ (অগ্রহায়ণ) ও বৈশাখ, এই তিন মাসে করণীয় বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে যথাক্রমে ৩৬, ১৭ ও ২৫ অধ্যায় বিশিষ্ট তিনটি গ্রন্থ সংযোজিত। এর মাঝে ভাগবত পুরাণ পাঠ ও মথুরার মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করে ৪ অধ্যায়ের ভাগবত মাহাত্ম্য নামের একটি গ্রন্থও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোনও মুদ্রিত সংস্করণেই নারদ পুরাণ (১০৪.৪০) উল্লিখিত ১০ অধ্যায় বিশিষ্ট মাঘমাস মাহাত্ম্য গ্রন্থটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পরবর্তী গ্রন্থ অযোধ্যা মাহাত্ম্য ১০ অধ্যায়ে সমাপ্ত উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার বিভিন্ন তীর্থস্থল নিয়ে লেখা গ্রন্থ। সর্বশেষ বাসুদেব মাহাত্ম্য গ্রন্থটি সমুদ্রমন্থন, পৃথিবী বর্ণনা ও বর্ণাশ্রম ধর্ম নিয়ে লেখা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রচনা। ৩২ অধ্যায়ের এই গ্রন্থটি বেঙ্কটেশ্বর প্রেস ও গুরুমণ্ডল গ্রন্থমালা সংস্করণে আছে, বঙ্গবাসী প্রেস সংস্করণে নেই। নারদ পুরাণেও এই গ্রন্থটির কোনও উল্লেখ নেই।

তৃতীয় ব্রহ্ম বা ব্রাহ্ম খণ্ডের শুরুতেই আছে তামিল নাড়ুর রামনাথাপুরম জেলার রামেশ্বরম তীর্থের মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত সেতু মাহাত্ম্য নামের ৫২ অধ্যায়ের একটি গ্রন্থ। পরবর্তী গ্রন্থ ৪০ অধ্যায়ের ধর্মারণ্য খণ্ড বা ধর্মারণ্য মাহাত্ম্য ঠিক কোন তীর্থের বর্ণনা তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত এই তীর্থটি গুজরাতের পাটন জেলায় অবস্থিত সিদ্ধপুর। ১৯৬০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত গুরুমণ্ডল গ্রন্থমালা সংস্করণে এরপর বর্ষা ঋতুর চার মাসে করণীয় বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে ৩২টি অধ্যায় বিশিষ্ট চাতুর্মাস্য মাহাত্ম্য সংযোজিত হয়েছে। সব শেষে ব্রহ্মোত্তর খণ্ড বা উত্তর খণ্ড শিবের মাহাত্ম্য নিয়ে রচিত ২২ অধ্যায়ের একটি পৌরাণিক কাহিনি সংকলন। ৪৩টি অধ্যায়বিশিষ্ট বৃহদ্-ব্রহ্মোত্তর খণ্ড নামের একটি গ্রন্থেরও পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

চতুর্থ কাশী খণ্ড দ্বাদশ শতক সাধারণ অব্দের পরে কোনও সময় রচিত। অন্ত-মধ্যযুগের সংস্কৃত বিদ্বানদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই গ্রন্থের জয়রাম ও রামানন্দ রচিত দুটি টীকা গ্রন্থ বিদ্যমান। অন্ত-মধ্যযুগের একাধিক ধর্মনিবন্ধ গ্রন্থে কাশী খণ্ড থেকে উদ্ধৃত অংশ দেখতে পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে বারাণসী বা কাশীর বিস্তারিত ভৌগোলিক বিবরণ পাওয়া যায়।মুদ্রিত সংস্করণে এই গ্রন্থের পূর্বার্ধে ৫০টি ও উত্তরার্ধে ৫০টি অধ্যায় রয়েছে। ১৮৬৮ সালে বারাণসী থেকে কাশী খণ্ডের একটি মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

পঞ্চম আবন্ত্য খণ্ডের প্রথমে ৭১ অধ্যায়ের অবন্তীক্ষেত্র মাহাত্ম্য মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার তীর্থস্থলের বিবরণ সমৃদ্ধ। গুরুমণ্ডল গ্রন্থমালা সংস্করণে অবন্তীক্ষেত্র মাহাত্ম্য ৮৩ অধ্যায় বিশিষ্ট। পরবর্তী গ্রন্থ ৮৪ অধ্যায়ের চতুরশীতিলিঙ্গ মাহাত্ম্য ‘মহাকাল বন’ নামে পরিচিত মধ্যপ্রদেশের এই এলাকায় স্থাপিত ৮৪টি লিঙ্গের বিবরণ। এই চতুরশীতিলিঙ্গ মাহাত্ম্য গ্রন্থটির কথা কিন্তু নারদ পুরাণে উল্লেখ করা হয়নি। সব শেষে রেবা খণ্ড বা নর্মদা খণ্ড এক বিশাল গ্রন্থ, নর্মদা নদীর তীরবর্তী মন্দির ও তীর্থসমূহের বিবরণ। এই গ্রন্থের বেঙ্কটেশ্বর প্রেস সংস্করণে ২৩২টি অধ্যায় এবং বঙ্গবাসী প্রেস সংস্করণ ও গুরুমণ্ডল গ্রন্থমালা সংস্করণে ২৩৬টি অধ্যায় আছে। বঙ্গবাসী প্রেস ও গুরুমণ্ডল গ্রন্থমালা সংস্করণের শেষের চারটি অতিরিক্ত অধ্যায়ে সত্যনারায়ণ কথা বর্ণিত হয়েছে। নারদ পুরাণে রেবা খণ্ডের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না।

২৭৯ অধ্যায়ে সমাপ্ত ষষ্ঠ নাগর খণ্ডের বিষয়বস্তু গুজরাতের মেহসানা জেলার বডনগর শহরে সপ্তদশ শতকে নির্মিত হাটকেশ্বর মহাদেব মন্দির এবং গুজরাতের নাগর ব্রাহ্মণদের বডনগর থেকে উদ্ভবের পৌরাণিক কাহিনি। গুজরাতি ভাষা প্রভাবিত সংস্কৃতে রচিত বর্তমান নাগর খণ্ডের রচনাকাল সপ্তদশ শতক সাধারণ অব্দ বা তারও পর। তবে এই গ্রন্থের বেশ কিছু অংশ নিঃসন্দেহে কোনও প্রাচীনতর গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি থেকে সংগৃহীত।

সপ্তম প্রভাস খণ্ডের প্রথমে প্রভাসক্ষেত্র মাহাত্ম্য ৩৬৫ অধ্যায় বিশিষ্ট গুজরাতের সোমনাথ মন্দির ও সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের অন্যান্য তীর্থের বিবরণ।পরবর্তী বস্ত্রাপথগিরনারক্ষেত্র মাহাত্ম্য বা বস্ত্রাপথক্ষেত্র মাহাত্ম্য ১৯ অধ্যায়ে গুজরাতের জুনাগড় জেলার গিরনার পর্বত এলাকার তীর্থসমূহের বিবরণ। এরপর অর্বুদ খণ্ড ৬৩ অধ্যায়ে রাজস্থানের সিরোহি জেলার আবু পর্বতস্থিত তীর্থসমূহের বর্ণনা। সবশেষে ৪৪ অধ্যায় বিশিষ্ট দ্বারকা মাহাত্ম্য গুজরাতের দ্বারকা তীর্থের বিবরণ।

[ক্রমশ]

তথ্যসূত্র

  1. Heinrich von Stietencron, Angelika Malinar, K.-P. Gietz, A. Kollmann, P. Schreiner and M. Brockington edited, ‘Epic and Purāṇic Bibliography (up to 1985) annotated and with indexes, Part II S-Z, Indexes’; Wiesbaden: Otto Harrassowitz, 1992, pp. 1160-1170.
  2. Ludo Rocher, ‘The Purāṇas’; Wiesbaden: Otto Harrassowitz, 1986, pp. 228-237.
  3. R.C. Hazra, ‘Studies in the Purāṇic Records on Hindu Rites and Customs’; Dacca: The University of Dacca, 1940, pp. 157-166.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *