পর্তুগীজ এবং আরাকানী মগ জলদস্যুদের হাত থেকে রাজধানী ঢাকাকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো সোনাকান্দা জলদুর্গ। বন্দর,নারায়ণগঞ্জ।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন ইসলাম খান।স্বাধীন বাংলার বার ভূইয়ারা তখনও দিল্লীর কাছে মাথা নত করেনি।মধ্যযুগ থেকে বাংলাকে বলা হত বিদ্রোহের নগরী,সুবাদার ইসলাম খানকে বাংলার বার ভূইয়াদের দিল্লীর বশ্যতা স্বীকারের জন্য পাঠানো হলো। ১৬০৮ সালে তিনি বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন এরপর তার রনকৌশলের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন বাংলার বার ভূইয়াগণ।এরপর বহু বছর কেটে যায় – ১৬৬০ সালে বাংলার সুবাদার হলেন মীরজুমলা ওদিকে দিল্লীর মসনদে বসা সম্রাট আওরঙ্গজেব।তখন বাংলার রাজধানী ছিলো রাজমহল মীর জুমলা সেই রাজধানী স্থানান্তর করলেন ঢাকায়।তিনি বাংলার সুবাদার হওয়ার আগ মূহুর্তে দিল্লীর মসনদে বসা নিয়ে সম্রাট শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলো তখন বাংলার সুবাদার ছিলো শাহজাদা শাহ সুজা-উত্তরাধীকার এই গৃহযুদ্ধে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের পক্ষ নেন এবং সুজাকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন এবং পরবর্তীতে তিনিই বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন পর্তুগীজ এবং আরাকানী মগ জলদস্যুরা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় লুটতারাজ চালাতে থাকলো মূলত পর্তুগীজ এবং আরাকানী জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করতেই রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানন্তর করেছিলেন।
মীর জুমলা এখানেই থেমে থাকেননি তিনি রাজধানীকে রক্ষা করার জন্য তিনটি দুর্গ নির্মাণ করলেন-১/ইদ্রাকপুর দুর্গ ২/সোনাকান্দা দুর্গ ৩/হাজীগঞ্জ দুর্গ যদিও এই হাজীগঞ্জ দুর্গ নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে অনেকে মনে করেন ঈসা খায়ের ঐতিহাসিক খিজিরপুর দুর্গই হলো হাজীগঞ্জ দুর্গ।
আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে যাইহোক এবার মূল আলোচনায় আসি-ঐতিহাসিক সোনাকান্দা দুর্গ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে বন্দর নগরীতে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক দুর্গ। হাজীগঞ্জ দুর্গ বা খিজিরপুর দুর্গের বিপরীত দিকে এই দুর্গের অবস্থান।মূলত এই দূর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিলো জলদস্যুদের হাত থেকে রাজধানী ঢাকাকে রক্ষার জন্য।এই জলদুর্গ নির্মাণের সঠিন ইতিহাস এখনো জানা যায়নি। তবে মীর জুমলার আমলে নির্মিত বলে অনেক ইতিহাসবীদ মনে করেন।
প্রতিরক্ষা দেওয়াল এবং শক্তিশালী কামান স্থাপনার জন্য উত্তোলিত মঞ্চটি এখনও পূর্বের অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে।চতুর্ভুজাকৃতির এই দুর্গটিতে প্রবেশের জন্য পাচ খাঁজবিশিষ্ট খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ রয়েছে। কামান স্থাপনার উঁচু মঞ্চে শক্তিশালী কামান নদীপথে আক্রমণকারীদের দিকে তাক করা থাকত। এটি মুগল জলদুর্গের একটি নতুন বৈশিষ্ট্য।মূলত এইসব বৈশিষ্ট্যের কারনেই একে মুঘল আমলের স্থাপনা বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন।
দুর্গটিতে দুটি প্রধান অংশ আছে। একটি অংশ বিশাল আয়তনের মাটির ঢিবিসহকারে গঠিত দুর্গপ্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত, যার মধ্যে গোলা নিক্ষেপের জন্য বহুসংখ্যক প্রশস্ত-অপ্রশস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে। অপর অংশটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, যা দুর্গের অভ্যন্তরে পশ্চিমাংশে নির্মিত। সুরক্ষিত দেওয়ালের অভ্যন্তরে উঁচু মঞ্চটি ব্যতীত আর কোন স্থায়ী ইমারতের সন্ধান পাওয়া যায় নি। দুর্গপ্রাচীরের সর্বত্র গুলি ছোড়ার ব্যবস্থাসহ মারলোন দ্বারা সজ্জিত; এ মারলোনগুলির গড় উচ্চতা ১ মিটার।
দুর্গটিকে প্রবেশ করার জন্য উত্তর দিকে একটিমাত্র প্রবেশদ্বার আছে,খিলানযুক্ত এই প্রবেশপথ একটি আয়তাকার ফ্রেমে আবদ্ধ এবং সেখানে পলেস্তারায় বিভিন্ন আকৃতির প্যানেল নকশায় সজ্জিত ছিলো।প্রবেশপথের মূল খিলান ছিল চতুষ্কেন্দ্রিক এবং চার কোণায় রয়েছে চারটি পার্শ্ববুরুজ। হাজীগঞ্জ এবং ইদ্রাকপুরের দুর্গ প্রাচীরের পার্শ্ববুরুজগুলির সাথে এ দুর্গের পার্শ্ববুরুজগুলির মিল নেই। সোনাকান্দা দুর্গের পার্শ্ববুরুজগুলি অষ্টভুজাকার।
এই দুর্গের কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। এই দুর্গ নিয়ে কিছু কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে।যার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই-বাংলার ইতিহাসের সাথে এমন লোককথার প্রচলন বহুকাল ধরে চলে আসছে।তার কোন সত্যতা নেই এমনকি কোন দলিলও নেই।
বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ী শীতলক্ষ্যা নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলদস্যু দ্বারা অপহৃত হন। সোনার গাঁর শাসক ঈশা খাঁ তাকে উদ্ধার করে দুর্গে নিয়ে আসেন ও তার পিতাকে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কেদার রায় তাকে মুসলমানের ঘরে রাত কাটানোর দায়ে ফিরিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মর্মাহত রাজকুমারী স্বর্ণময়ী দুর্গে বসে কেঁদেছিলেন বলে এই দুর্গের নাম হয় সোনাকান্দা।
বারোভুঁইয়াদের অন্যতম নেতা ঈশাখাঁ বিক্রমপুরের জমিদার কেদার রায়ের বিধবা কন্যা সোনা বিবিকে জোড়পূর্বক বিয়ে করে এনে এই দুর্গে বন্দী করে রেখেছিলেন। তিনি দুর্গে বসে কেঁদেছিলেন বলে এই দুর্গের নাম হয় সোনাকান্দা।
কিছু মানুষ বিশ্বাস করত যে দুর্গের ভেতরের গুপ্ত সুড়ঙ্গ দিয়ে সোনারগাঁও এবং ঢাকার লালবাগ কেল্লার সাথে সংযোগ ছিল।