১৭৮৫ সালের আগে পর্যন্ত ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ বলে আলাদা কোনও ‘গ্রন্থ’ দুনিয়ার কোত্থাও ছিল না। মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অংশ হিসাবে ‘কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথন’ অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু আলাদা করে তার গুরুত্ব ছিল না।
স্বতন্ত্র গ্রন্থ হিসাবে গীতার জন্মদাতা চার্লস উইলকিন্স। ১৭৪৯ সালে জন্মানো এই মানুষটি, মাত্র ২১ বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার বা জুনিয়র ক্লার্ক হিসাবে কলকাতায় প্রথম পা রাখেন। ১৭৭৮-এ প্রকাশিত বাংলা ছাপার হরফে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের A Grammar of Bengal Language-এর ভূমিকায় হ্যালহেড তাঁকে বাংলা হরফ তৈরির পূর্ণ কৃতিত্ব দেন ও নিজের বইতে সেসব হরফ ছাপেন। যদিও এই হরফ তৈরির প্রধান কৃতিত্বের দাবিদার হলেন বাঙালি ‘কর্মকার’ পঞ্চানন মল্লিক। ওই বছর থেকেই বারাণসীতে সংস্কৃত শিখতে শুরু করেন উইলকিন্স।
বারাণসীতে থাকাকালীন তিনি তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আগ্রহে ইংরেজিতে মহাভারতের অনুবাদ করতে শুরু করেন, যদিও তা শেষ করতে পারেননি। ১৭৮৪ সালের অক্টোবর মাসে হেস্টিংস বারাণসীতে উপস্থিত হলে উইলকিন্স তাঁকে মহাভারতের আংশিক অনুবাদের খসড়া পাণ্ডুলিপিটির একটি অনুলিপি বা ‘কপি’ দেখান। তবে মাত্র ৬ বছর সংস্কৃত ভাষাচর্চার দৌলতে যে মহাভারতের অনুবাদ করা সম্ভব নয়, সে কথা অবশ্য না বললেও চলে।
এর ঠিক ১০ বছর আগে, ১৭৭৪-এ কলকাতায় স্থাপিত হয় সুপ্রিম কোর্ট। তারও বছর দুয়েক আগে ১৭৭২-এর ১৫ অগস্ট, গভর্নর হেস্টিংসের প্রত্যক্ষ উৎসাহ ও তদারকিতে সরকারিভাবে ঘোষিত হয় যে, “উত্তরাধিকার, বিবাহ, জাতপাত ও অন্যান্য ধর্মীয় আচরণ বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সমস্ত মামলায়, মুসলমানদের কোরানের আইনসমূহ এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে শাস্ত্রব্যবস্থা চিরকাল সম্মানের সঙ্গে মেনে চলতে হবে।” সেই মোতাবেক ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত হয় হ্যালহেড-অনূদিত A Code of Gentoo Laws, or, Ordinations of the Pundits শীর্ষক ঔপনিবেশিক ‘হিন্দু’ আইনের প্রথম গ্রন্থ।
পাঁচ বছর পরে ১৭৮১ সালে হেস্টিংসের আমলেই পাস হয় নতুন আইন ‘The Act of Settlement’। এই আইনের ১৭ সংখ্যক ধারায় বলা হয়, “সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও জমির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় এবং দু-পক্ষের মধ্যে চুক্তি ও লেনদেনের সমস্ত বিষয়, মুসলমানদের ক্ষেত্রে মুসলমান আইন ও ব্যবহার এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে হিন্দু আইন ও ব্যবহার দ্বারা নির্ধারিত হবে।”
বহু দিন থেকেই হেস্টিংস আদালতে হিন্দুদের ক্ষেত্রে ‘solemn oath’ বা ‘আনুষ্ঠানিক শপথ’-এর উপযোগী একটি শাস্ত্রগ্রন্থের অভাব বোধ করছিলেন। কারণ বাইবেল বা কোরানের মতো হিন্দুদের জন্য আদালতে ‘সহজে বহনযোগ্য’ প্রামাণ্য শাস্ত্রগ্রন্থের অস্তিত্ব ছিল না। এক্ষেত্রে উইলকিন্সের অনুবাদটি তাঁর সহায়তা করে। তিনি ওই আংশিক অনুবাদ থেকে কৃষ্ণার্জুনের কথোপকথনটুকু আলাদা করে বাছাই করার পরে, একটা আলাদা বইয়ের পরিকল্পনা করেন। ১৭৮৪ সালের ডিসেম্বরে হেস্টিংস উইলকিন্সের অনুবাদের ওই অংশটি কোম্পানির লন্ডনের প্রধান কর্তা ন্যাথানিয়েল স্মিথকে পাঠান এবং কোম্পানির খরচে সেই অনুবাদটি প্রকাশ করার অনুরোধ জানান।
অবশেষে ১৭৮৫-র মে মাসে, কোম্পানির অর্থে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় The Bhagvat-Geeta, or Dialogues of Kreeshna and Arjoon। মাত্র দু’বছরের মধ্যে বইটি রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়। সৃষ্টি হয় এক আচাভুয়া গ্রন্থ গীতার। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, হ্যালহেড যেমন তাঁর গ্রন্থে পঞ্চানন মল্লিকের নামোল্লেখ করেননি, হেস্টিংস-উইলকিন্স জুটিও এই অনুবাদের পেছনে লুকিয়ে থাকা আরেক বাঙালি পণ্ডিত কাশীনাথ ভট্টাচার্যের নামোচ্চারণ করেননি।
তবে গ্রন্থ হিসাবে বাঙালির গীতা পড়ার ইতিহাস আরও অর্বাচীন। ‘লণ্ডনে বিবেকানন্দ’ গ্রন্থে মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “১৮৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গীতার বিশেষ প্রচলন ছিল না।” অবশেষে বিবেকানন্দের উৎসাহে হরমোহন মিত্র কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত থেকে গীতা অংশটি আলাদা করে নিয়ে মূল ও বঙ্গানুবাদ সমেত ছাপাতে শুরু করেন। “তাহা হইতে বাংলাদেশে গীতার খুব প্রচলন হইল এবং লোকে সাগ্রহে পড়িতে লাগিল।” সে হিসাবে আমরা গীতা পড়ছি মাত্র ১৩৫ বছর।
লরেন যে লরেনকে চিনবে এ আর কী এমন নতুন কথা?