ষত্ববিধি
আজ মান্তু হাতে করে একটা চিঠি এনে হাজির।
– দাদু, মৃন্ময় কাকু তোমাকে চিঠি লিখেছেন, এই নাও। আচ্ছা, কাকু তোমাকে চিঠিতে ‘শ্রীচরণেষু’ বলে সম্ভাষণ করেন কেন? আমাকে লিখলে তো লেখেন ‘কল্যাণীয়াসু’।
– আর আমাকে লেখেন ‘কল্যাণীয়েষু’, কেন? – এবার বুতানের প্রশ্ন।
– আসলে বড়দের সম্ভাষণ করতে হলে ‘শ্রীচরণেষু’ লেখাই নিয়ম। আর ছোটদের ‘কল্যাণীয়েষু,’ প্রীতিভাজনেষু’ এই সব লিখতে হয়। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে কল্যাণীয়া থেকে ‘কল্যাণীয়াসু’।
– না, সে প্রশ্ন নয়। আমরা জানতে চাইছি কখন দন্ত্য স আর কখন মূর্ধন্য ষ হবে তার কি কোন নিয়ম আছে? – মান্তু তার প্রশ্নটা বুঝিয়ে বলে।
– আছে বৈকি। আর এই নিয়মকেই বলা হয় ‘ষত্ববিধি’।
– তাহলে,বুতান বলল, ‘ কখন দন্ত্য স আর কখন মূর্ধন্য ষ তা বুঝবো কী করে?’
– শুধু তাই নয়, কখনও কখনও আবার তালব্য ‘শ’ ও হয়। আমি একটা দোকানের নাম দেখেছি ‘শ্রীচরণে শু’ – মান্তু যে আজকাল সব বানান লক্ষ করে তা বেশ বোঝা যায়।
– ওটা তো একটা জুতোর দোকানের নাম। বাংলা আর ইংরেজি মিলিয়ে ওই দোকানের নাম দিয়েছে। তার মানে ‘পায়ে জুতো’। অবশ্য এ রকম নাম দেওয়া কতটা সঙ্গত সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সে যাই হোক, আজ আমাদের আলোচনার বিষয় সেটা নয়। মৃন্ময় আমাকে আর তোদের চিঠিতে যা সম্ভাষণ করে তা নিয়েই বলি। কখন কোন ‘স’ আসবে তার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। এই ‘নির্দিষ্ট’ শব্দের বানানটাই দেখ। ট-বর্গের কোন বর্ণ যদি কোন ‘স’ সঙ্গে নেয় তবে নিশ্চিত ভাবেই মূর্ধন্য ষ কে সঙ্গে নেবে। অন্যান্য ‘স’ – এর সঙ্গে ট-বর্গের বর্ণগুলোর বৈরিতা আছে। এটা অনেকটা দলবাজি বা স্বজনপোষণের মত। যেমন তালব্য বর্ণগুলো নেবে তালব্য শ আর দন্ত্য বর্ণগুলো দন্ত্য স ছাড়া আর কাউকে নেবেই না। এছাড়াও আর একটা নিয়ম মনে রাখবি ‘অ’ বা ‘আ’ – এর পর ‘স’ এলে তা সাধারণত দন্ত্য স হলেও অন্য স্বরের পর এলে তা অনেক সময়ই মূর্ধন্য ষ হবে। আমরা যে সম্ভাষণগুলো নিয়ে আলোচনা করছিলাম ‘কল্যাণীয়েষু’, ‘শ্রীচরণেষু’, ‘প্রীতিভাজনেষু’ এই শব্দগুলোতে এ-কারের পর ‘স’ এসেছে তাই হয়েছে মূর্ধন্য ষ। আর ‘সুচরিতাসু’, ‘কল্যাণীয়াসু’ এই সব শব্দে আ-কারের পর ‘স’ আসায় তা হয়েছে দন্ত্য স। তোদের আরও কয়েকটা উদাহরণ দিই। তোরা তোদের জ্যামিতি বইতে ত্রিভুজ নিশ্চয়ই পড়েছিস।
– বাংলার মধ্যে আবার অঙ্ক আসছে কেন, দাদু? – মান্তুর কি ধীরে ধীরে অঙ্কতে ভীতি জন্মাচ্ছে?
– আরে না না, অঙ্ক আসেনি। আচ্ছা বলতো ত্রিভুজ কত রকমের হয়?
– সমবাহু, সমদ্বিবাহু, বিষমবাহু … বুতান গড়গড় করে বলে যায়।
– এবার দেখ, সমবাহু বা সমদ্বিবাহু এই শব্দ দুটোতে দন্ত্য স আর বিষমবাহু বানানে মূর্ধন্য ষ, কেন?
– কারণ হয়তো ওই ‘স’ আসছে শব্দের শুরুতে আর বিষম শব্দে ‘স’ এসেছে শব্দের মাঝে। – বুতান একটা নতুন ব্যাখ্যা দেয়।
– আচ্ছা ওই বিষমবাহু ত্রিভুজকে তো অসমবাহু ত্রিভুজও বলা যায়। আর অসমবাহু বানানেও আসছে দন্ত্য স। কারণ তোদের আগেই বলেছি যে অ-আ এর পর এলে দন্ত্য স আর অন্য স্বরের পর এলে সাধারণত মূর্ধন্য ষ।
– দাদু, তুমি বারবার সাধারণত বলছ কেন? তার মানে কি সব সময় তা হবে না? – মান্তু পরিষ্কার করে বুঝে নিতে চায়।
– সে তো বটেই। আচ্ছা, তোদের কয়েকটা শব্দ বলি। সেবা কিন্তু পরিষেবা, সঙ্গ কিন্তু অনুষঙ্গ, সুপ্তি কিন্তু সুষুপ্তি। অতিষ্ঠ, ভবিষ্যৎ, মুমূর্ষু, নিষেধ, অভিষেক, বিষণ্ন সুষম এই শব্দগুলোতেও মূর্ধন্য ষ। আবার পরিসংখ্যান, পরিসীমা, পরিসমাপ্তি এসব শব্দে ই-কারের পর এলেও দন্ত্য স থেকে যাচ্ছে। আসলে সব ধাতুর বেলায় এই মূর্ধন্য ষ হয় না। এছাড়াও লক্ষ করলে দেখবি পুরস্কার কিন্তু পরিষ্কার। ভাস্কর, তিরস্কার, পরস্পর, স্বতঃস্ফূর্ত এই সব শব্দে অ-কার বা আ-কারের পর ‘স’ আসাতে তা হবে দন্ত্য স। এগুলো একটু মনে রাখিস, কেমন?
আরও বলি, ঋ বা ঋ-কারের পর মূর্ধন্য ষ হবে। যেমন, ঋষি, বৃষ। বিসর্গ সন্ধির সময় তোদের বলেছিলাম কি যে নিঃ, দুঃ, বহিঃ, আবিঃ, চতুঃ, প্রাদুঃ এই সব শব্দের পর ক, খ, প, ফ থাকলে বিসর্গ সন্ধিতে বিসর্গের জায়গায় মূর্ধন্য ষ হয়। যেমন, নিঃ+কাম = নিষ্কাম (নিষ্কর্মা), দুঃ+কর = দুষ্কর, দুঃ+কৃতি = দুষ্কৃতি, বহিঃ+কার = বহিষ্কার, নিঃ+কর = নিষ্কর, নিঃ+পাপ = নিষ্পাপ, ইত্যাদি। আর তোদের মনে রাখতে হবে কতগুলো শব্দে স্বভাবতই মূর্ধন্য ষ বসে। যেমন, আষাঢ়, পাষাণ, বিষয়, ষোড়শ, ইত্যাদি। আর সব শেষে তোদের আর একটা কথা বলব ‘ত’ বর্গের কোন বর্ণের আগে যুক্ত ভাবে কোন ‘স’ এলে তা অবশ্যই দন্ত্য স হবে।