» উদ্বাস্তু শরীর

লেখিকাকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এই গল্পের বিষয়বস্তু কি? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, সেটা জানতে গেলে তো পড়তে হবে।

ভাগ্যিস কথাটা বলেছিলেন!

সর্বাণী মুখোপাধ্যায় আমাকে প্রতিবারই চমকে দেন তার লেখার বিষয়বস্তুর জন্য। এমন অ-সাধারণ সব বিষয়বস্তু বাছেন, যা একদিক থেকে অস্বস্তিকর, কিন্তু অন্যদিক থেকে প্রয়োজনীয়ও বটে। ‘যো*নিকীট’ উপন্যাসটিতে প্রথম নজর কাড়েন উনি। ওই একটি মাত্র উপন্যাস, যা ওনার লেখা, নিয়ে লাগামছাড়া হইচই পড়ে গিয়েছিল।

তার কারণ, শিরোনামের অভিঘাত অধিকাংশ বাংলার তথাকথিত ভদ্র শিক্ষিত পাঠককূল সহ্য করতে পারেননি। বিষয়বস্তুতে যাওয়া তো আরও দূরের কথা। যারা বইটার মধ্যে আদিম কদর্যতা খুঁজতে গিয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই হতাশ হয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, আর বাকিরা বিস্মিত হয়েছিলেন।

আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, লেখিকার সাহস দেখে। লেখিকার লেখার ক্ষমতা দেখে।

তার পরের বছরের এবং এই বছরের উপন্যাস নিয়ে তেমন কোন আলোচনা হয় নি। কারণ অমন কোন শিরোনাম উনি ব্যবহার করতে পারেন নি। অথচ, এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখার কথা খুব কম লেখক ভাবতে পারেন। লিখেছেন কজন, আমি জানি না। আমার পড়া এই প্রথম।

লেখার বিষয়বস্তু ইন্টারসে*ক্স, অর্থাৎ হার্মাফ্রোডাইট, অর্থাৎ উভলি*ঙ্গ মানুষ।

সমাজ একটা ধরাবাধা নিয়ম বেঁধে দেয়। প্রকৃতির অনুকূলে থাকা অধিকাংশ জীবজগৎ এই সাধারণ বাঁধা পথে চলে আসে। কিন্তু প্রকৃতিও বেখেয়ালি হয়। সে যখন চিরায়ত পথ ছেড়ে একটি-দুটি গলিপথ তৈরী করে ফেলে, তখন, সেই পথে হাটা তো দূর অস্ত, সেই পথের দিকে তাকানোটাই অনেকসময় অত্যন্ত অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। আর দেখতে দেখতে কখন যেন সেই অব্যবহৃত গলিপথটি প্রকৃতিরই দেওয়া নরম ঘাসের মধ্যে হারিয়ে যায়। সমাজ হাফ ছেড়ে বাঁচে।

উভলিঙ্গ মানুষের অবস্থা LGBTQ+ থেকেও বোধহয় করুণ। এই করুণতার একটুকরো চালচিত্রই হল এই উপন্যাস – উদ্বাস্তু শরীর। শরীরই যখন শরীরের শত্রু হয়ে যায় তখন তাকে সামলায় কোন জন? সেখানে বিকার নেই, লালসা নেই, লোভ নেই, কামনা নেই, বাসনা নেই, আছে কেবল মনুষ্যত্ব। সেখানে কেবল স্বাভাবিকত্বের থেকে সরে আসা শরীরের ওপর যে সামাজিক প্রত্যাঘাত নেমে আসে, তার বীভৎসতা রোধ করবে কে?

এর উত্তর খোঁজার প্রয়োজন। আজ না হোক তো কাল। লেখিকাকে ধন্যবাদ, তিনি প্রশ্নটা আজ তুলেছেন। ভাবীকালের মুখপত্ররূপে তার কাছে পরের বছরেও এমন উপন্যাস আশা করছি, যা আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে এমনই বিষময়, কিন্তু এর অ্যান্টিডোট খুঁজে বের করার আলোচনাটা শুরু হওয়া, অন্তত, আশু প্রয়োজন।

এই উপন্যাসের পরিশিষ্ট সেই বার্তাই আনে –

“সত্যিই দুনিয়া চায় না ওদের। তখনও চায়নি, এখনো চায় না। সমাজ নির্ধারিত নির্দিষ্ট যৌ*নতার লক্ষ্মণগণ্ডীর সীমারেখার বাইরের মানুষ ওরা। স্বপরিচয়ে বাঁচার গৌরব নেই ওদের। মিলেনিয়াম পার করা সহস্রাব্দের একুশ শতকের আগুয়ান এই পৃথিবী, টেকনোলজির বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ও মিডিয়া-হাইপের প্রগ্রেসিভ মডার্ন গ্লোবাল-ভিলেজ – যেখানে আজ গোটা বিশ্বকে একটি সম্প্রদায় হিসেবে মনে করা হয়, সেখানে বিশ্বের সমস্ত প্রান্তের মানুষ উন্নততম প্রযুক্তির মাধ্যমে আদর্শগত ভাবে একটি একক সমাজে সন্মিলিত বসবাস করে, যেখানে পারস্পরিক ভাবনা-চিন্তা ও জ্ঞানের উৎকর্ষের নিরবচ্ছিন্ন আদান-প্রদানে সবাই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং সংযুক্ত – সেই উচ্চমানের পৃথিবীতে দুটি ইন্টারসে*ক্স হার্মাফ্রোডাইট উভলি*ঙ্গের মানুষ, যারা তাদের অন্তস্তলের পুরুষ ও নারীর সত্ত্বা নিয়ে স্বাভাবিক নারী-পুরুষের সম মর্যাদায় বাঁচতে চায়, নিশ্চিন্ত জমির শক্ত ভিতের ওপর আত্মবিশ্বাসী পা রেখে তাদের সেক্সু*য়াল আইডেন্টিটির সন্মান চায়, সেটা ওরা আজও পায়নি। পায় না।”

===============

উদ্বাস্তু শরীর
সর্বাণী মুখোপাধ্যায়
শারদীয়া নবকল্লোল ২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *