কনস্টান্টিনোপল থেকে ইস্পাহান, এই পথেই লেখকের প্রথম পারস্য ভ্রমণ।
এটা কদাচিৎ যে কোন কাফেলা কনস্টান্টিনোপল থেকে পারস্যে যায়; কিন্তু বুরসা থেকে তারা প্রতি দুই মাসেই যায়। বুরসা বিথিনিয়ার রাজধানী, কনস্টান্টিনোপল থেকে তিন দিনের সফরের বেশি নয়, অথবা সামান্য বেশি সময় লাগে। এই রাস্তা দুটি মিশেছে চাবাঙ্গিতে, বুরসা থেকে এখানে আসতে দুই দিন সময় লাগে। সুতরাং, আমি শুধু কনস্টান্টিনোপল থেকে ইস্পাহানের রাস্তার ব্যাপারেই বলবো। এই যাত্রাটি হয় উটের কাফেলা নিয়ে, নয়তো অশ্বারূঢ় ও সশস্ত্র দশ বা বার জনের একটি দল।
কনস্টান্টিনোপল থেকে স্কুটারি অতিক্রম করে এশিয়ার উপকূল পৌঁছাতে হতে পারেন।
স্কুটারি থেকে যাত্রা শুরু করুন। প্রথম দিনের ভ্রমণ অনেক আনন্দদায়ক হবে। মাঠগুলো রঙিন মৌসুমী ফুল দ্বারা পরিশোভিত। শুরুতে সড়কের দুধারে পিরামিডসহ সমাধিক্ষেত্রগুলো ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়বে না। আপনি সহজেই নারী থেকে পুরুষের স্মৃতিস্তম্ভগুলো চিহ্নিত করতে পারবেন। পুরুষ স্মৃতিস্তম্ভের পিরামিডগুলোর মাথায় টোপর পরানো, কিন্তু নারী স্মৃতিস্তম্ভগুলো দেশীয় নারীদের হিজাবের মত কাপড়ে আবৃত। আপনাকে রাত কাটাতে হবে কার্টালিতে, এটি বিথিনিয়ার একটি গ্রাম। পরের দিন থাকবেন গেবিসাতে, এর প্রাচীন নাম লিবিসা। এটি হানিবালের সমাধির জন্য বিখ্যাত। এখানে দুটি উৎকৃষ্ট সরাইখানা ও চমৎকার দুটি ফোয়ারা রয়েছে।
তৃতীয় দিন আপনি পৌঁছে যাবেন ইজনিকে। ধারণা করা হয়, এটিই প্রাচীন নিকাইয়া শহর। শহরটির এক অংশ পাহাড়ের ঢালুতে, অপর অংশ সমতল ভূমিতে সমুদ্র পর্যন্ত, যেখানে ইজনিকের গল্ফ তৈরি করা হয়েছে। পোতাশ্রয় গড়ে তোলা হয়েছে পাথরের তৈরি দুটি বাঁধ এবং দেওয়াল ঘেরা তিনটি বিশাল চত্বরে, এগুলো ব্যবহৃত হয় সরঞ্জামাদি রাখার জন্য। যেখানে ঘরবাড়ি ও জাহাজ তৈরির জন্য বড় বড় কাঠের গুদামঘর রয়েছে। দেশটি শিকারের জন্য একটি চমৎকার জায়গা। বিরল ফল-মূল এবং শরাব সমৃদ্ধ। সুলতান আমুরাত শহরের উঁচুস্থানে একটি হারেম নির্মাণ করেছেন, যেখান থেকে একই সাথে সমুদ্র ও ভূখণ্ডের বিস্তৃত দৃশ্য অবলোকন করা যায়। শহরের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে ইহুদিরা, তারা কাঠ ও ভুট্টা ব্যবসা করে। যখন বায়ু প্রবাহিত হয়, আপনি সাত বা আট ঘণ্টার মধ্যে কনস্টান্টিনোপল থেকে ইজনিক যেতে পারবেন, কোন রকম বিপদ ছাড়াই।
চতুর্থ দিন আপনি থাকবেন চাবাঙ্গীতে, ছোট শহর, গড়ে উঠেছে চাবান-গিগুল হ্রদের পাশে। এখানে দুটি সরাইখানা রয়েছে। হ্রদের শুরু থেকে দুই লীগের মত কিছুটা পর্বতের উপর দিয়ে, কিছুটা হ্রদের পাশ দিয়ে ভ্রমণ করতে হয়। স্থানগুলো কোথাও কোথাও ঘোড়ার পেট পর্যন্ত উঁচু। হ্রদটির পরিধি দশ লীগের বেশি বিস্তৃত নয়। কিন্তু এখানে বড় বড় মাছ উৎপন্ন হয়। বলাবাহুল্য, আমি একবার আড়াই ফুট লম্বা একটি পাইক মাছ কিনেছিলাম তিন সাউ দিয়ে। কয়েকজন সম্রাট হ্রদ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত খাল কাটার পরিকল্পনা করেছিলেন, যাতে হ্রদের নিকটস্থিত পর্বত থেকে সংগৃহিত কাঠ কনস্টান্টিনোপলে নিয়ে যাওয়া সহজ হয়। প্রধান মন্ত্রী যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়ত তার অন্যান্য ভাল কাজগুলোর মতো এই কাজটিও তার স্মৃতিকে গৌরবান্বিত করতে পারত। কিন্তু তিনি ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ মারা গেলেন, তার পুত্র তার পরিবর্তে প্রধান মন্ত্রী হলেন কিন্তু এই সব কাজের প্রতি মনোযোগী হলেন না।
চাবান্দী ছেড়ে আসার পর জ়াকারাত নদীর তীরে এসে রাত্রি যাপন করতে হবে। এটি উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়ে কৃষ্ণসাগর পতিত হয়েছে। এই নদীতে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। আপনাকে একটি কাঠের সেতু দিয়ে নদীটি পার হতে হবে। এই স্থানে কোন শহর নেই, কোন সরাইখানাও নেই। কিন্তু নদী থেকে একলীগ দূরে বৃহৎ শহর অ্যাডা অবস্থিত। সেখানকার বাসিন্দাদের প্রধান অংশ আরমেনীয়। লোক পাঠিয়ে সেখান থেকে আমরা উত্তম ও উৎকৃষ্ট ওয়াইন এবং অন্যান্য দরকারী সামগ্রী আনিয়েছিলাম।
নদীর উপরের কাঠের সেতু পার হয়ে উঁচু রাস্তা চলে গেছে মার্শের ভিতর দিয়ে। একদিন লাগবে ক্যানকোলিতে পৌঁছতে, এখানে চারটি সরাইখানা আছে, রাত কাটানোর জন্য যেকোন একটি বেছে নিন।
পরের স্থানের নাম টুসকেবসার, দুটি সরাইখানা সহ একটি ছোট গ্রাম। সেখান থেকে যেতে হবে কার্গেসলার, এটি বড় শহর; এখানে একটি সরাইখানা আছে। এটি নদীর তীরে অবস্থিত, এখানে মাছের বড় দোকান আছে। স্থানীয়রা বলে বোরমা-বালুকি। লম্বা নাকওয়ালা বলেই লোকেরা এই নামে ডাকে। এটি ট্রাউট মাছের মত দাগ কাটা। তবে মাছটির স্বাদ অনেক ভাল এবং দামও বেশি। কয়েকটি পর্বতমালার পাদদেশে পোলিয়া বা পোলিস নামের শহর, বাসিন্দাদের অধিকাংশই গ্রীক। পর্বতগুলো অনেক উঁচু এবং বিস্তৃত যা পার হতে দুদিন ভ্রমণ করতে হয়। এগুলো বিভিন্ন ধরণের গাছে পরিপূর্ণ, গাছগুলো দেবদারু গাছের মত সোজা ও লম্বা। পর্বতগুলোতে অনেক গিরিখাত। প্রধান মন্ত্রী কুপ্রিগ্লি যদি সেতু নির্মাণ না করতেন তবে এগুলো পার হওয়া কঠিন হত। এই পর্বতগুলোর মাটি নরম, ভারি বৃষ্টিপাত বা তুষারপাতের পর ঘোড়ার পদচিহ্নগুলো মুছে যায়। যদি সেই মন্ত্রী পথগুলো পাকা ও পীচ না করতেন তাহলে কনস্টান্টিনোপল পর্যন্ত যাতায়াত অনেক কষ্টকর হয়ে যেত। সাথে চকমকি পাথর রাখা খুবই দায়িত্বপূর্ণ কাজ। পর্বতের কোথাও চকমকি পাথর পাওয়া যাবে না। এখানে মুরগীর মত বড় বড় কবুতরের প্রাচুর্য রয়েছে, এগুলোর স্বাদও ভাল। একটিতেই আমাদের ক্ষুধা নিবারণ করা সম্ভব হয়েছে, শুধু তাই নয়, এগুলোকে শিকার করাও অনেক আনন্দের। শহর ও পর্বতের মাঝখানে প্রায় দুই লীগ দৈর্ঘ্যের একটি সমতলভূমি রয়েছে। কাছাকাছিই একটি নদী প্রবাহমান, যার জল ও পলিতে এই অঞ্চল যথেষ্ট পরিমাণ উর্বরতা সম্পন্ন। এই মাটিগুলো উৎকৃষ্ট এবং মানব জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস উৎপাদন করে। আমি গুণেছি যে সড়কের দুপাশে বিশটির বেশি সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। তুর্কিদের একটা ঐতিহ্য হলো সড়কের পাশেই সমাধিস্থ করা, তারা বিশ্বাস করে পথিকেরা মৃতদের আত্মার জন্য দুআ করবে। প্রতিটি কবরে অর্ধপ্রোথিত মার্বেলের খুঁটি রয়েছে। খুঁটিগুলোতে বিভিন্ন রঙের বড় বড় সংখ্যা লেখা। তাতে অনুমান করা যায় যে, পোলিয়া ও তার আশেপাশে প্রচুর সংখ্যক খ্রিস্টান চার্চ ছিল। তারা আমাকে একইভাবে আস্বস্ত করেছিল যে, পর্বতের উপরে ও নীচে গ্রামে এই স্তম্ভগুলির পরিমাণ ছিল অনেক। তুর্কিরা তাদের সমাধিতে স্থাপন করার জন্য এগুলো তুলে নিয়ে যায়।
পর্বতের উপরের গ্রাম বেন্ডরলোর, সেখানে একটি সরাই রয়েছে। পর্বতের ওপারের গ্রাম গেরাদারে আছে দুটি সরাই। কার্গসলারে আছে দুটি সরাই, এখানকার পানীয় উৎকৃষ্ট। কারাগালান শহরে আছে দুটি সরাই। কোসিজার গ্রামে আছে একটি সরাই।
টোসিয়া একটি বড় শহর, এটি পাহাড়ের চড়ায় অবস্থিত যা একটি উঁচু পর্বতের অংশ। শীতের সময়ে, পশ্চিম দিক থেকে একটি জলধারা প্রবাহিত হয়ে একটি বিশাল বড় নদীতে পড়ে, নদীটির নাম গুসেলারমাক। পূর্বদিকে ছোট পাহাড়ের চুঁড়ায় একটি দুর্গ আছে, ওখানে পাশারা বাস করে। এবং শহরে সড়কের পাশে একটি মনোরম সরাইখানা রয়েছে। বাসিন্দাদের অধিকাংশ গ্রীক খ্রিস্টান। তারা খুব উৎকৃষ্টমানের ওয়াইন প্রস্তুত করে, এর টাকাতে তারা সমগ্র এলাকাকে সুশোভিত করে তুলেছে।
এগিসেনসালো একটি নদীর তীরে অবস্থিত, এখানে একটি সরাইখানা ও একটি মনোহর মসজিদ রয়েছে।
ওজেমান একটি ছোট শহর, এটি একটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত যার উপরে রয়েছে একটি শক্তিশালী দুর্গ এবং নীচে আছে বেশ সুবিধাজনক একটি সরাই। গুসেলারমাক নদী গভীর ও চওড়া, এটি শহরের দক্ষিণাংশকে বিধৌত করে। এটি পার হতে হবে একটি সেতু দিয়ে, এমন সুন্দর সেতু আপনি আর কোথাও দেখেননি। এতে পনেরটি খিলান রয়েছে, যার প্রতিটি ফ্রিস্টোন বা চুনাপাথরে তৈরি। এর কাজের সৌন্দর্য এটির নির্মাণ কারিগরদের দক্ষতার মহিমা জ্ঞাপন করে। সেতু থেকে কিছু দুরত্বে দাঁড়িয়ে আছে ছয়টি শস্য মাড়াই কল। এদের প্রত্যেকটি ছোট ছোট সেতু দ্বারা সংযুক্ত। এই নদীটি ওজেমান থেকে প্রায় আট দিনের যাত্রায় ইউক্সিন সাগরে পড়েছে।
আজিলার একটি বড় শহর, এখানে দুটি সরাইখানা রয়েছে। দেলেকিরাস একটি বড় গ্রাম, এখানে আছে একটি সরাইখানা।
চতুর্থ দিনের যাত্রা অনেক বিপজ্জনক, কেননা, সড়কটি অতি সরু এবং ডাকাতদের জন্য সুবিধাজনক। এদেশে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। এটা বুঝতে পেরে আমরা পথের মধ্যে ওৎপেতে থাকলাম এবং আমাদের নিরাপত্তার জন্য পাশার নিকট একটি প্রতিনিধি দল পাঠালাম, তিনি আমাদের পঞ্চাশজন ঘোড়সওয়ার ধার দিলেন।
আমাসিয়া একটি বড় শহর, এটি পর্বত চড়াইয়ের ফাঁফা স্থানে অবস্থিত। এটির বিস্তৃতি নেই, কিন্তু দক্ষিণ দিকে সুন্দর সমভূমি। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটি এসেছে টোকাট থেকে এবং আমাসিয়া থেকে চার দিনের পথ কৃষ্ণসাগরে পতিত হয়েছে। একটি কাঠের সেতুর উপর দিয়ে নদীটি পার হতে হবে, সেতুটি এত সরু যে তিন জনের বেশি একসাথে পার হওয়া যায় না। শহরে বিশুদ্ধ জল আনার জন্য তারা মার্বেলের মত শক্ত পাথরে এক লীগ পরিমাণ কেটেছে, যা অত্যন্ত বিস্ময়কর শ্রমের ফল। পশ্চিম পাশে রয়েছে উঁচু পর্বত, সেখানে একটি দুর্গ রয়েছে। সেখানে বৃষ্টির হলে জলাধারে জল সংরক্ষণ করা হয়, অন্যথায় জলের কোন বিকল্প উৎস নেই। পর্বতের মধ্যখানে সচরাচর বসন্ত বিরাজ করে। চতুর্দিকে শিলা কেটে কয়েকটি কক্ষ বানানো হয়েছে, সেখানে দরবেশেরা বসবাস করে। আমাশিয়াতে দুটি মাত্র সরাই রয়েছে, এগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু এখানকার মাটি খুবই ভাল। এখান থেকেই সমগ্র আনাতোলিয়ায় ফল-মূল ও শরাব সরবাহ করা হয়।
আইনাবাচার একটি সরাইখানার নাম, এটি বড় শহর থেকে পোয়া লীগ দূরে অবস্থিত। এখানকার যাবতীয় রসদ আনতে হয় বড় শহর থেকে।
টারকল বড় শহর, একটি পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত যার উপরে রয়েছে দুর্গ। টোকাট থেকে আসা নদীটি এখানকার বাড়িগুলি বিধৌত করে। আমরা এতে দুর্দান্ত মাছ শিকার করেছি। এখানে আছে সড়কের সবচেয়ে সুন্দর সরাইগুলোর একটি।
টারকল থেকে একদিনেই টোকাট সফর করা যায়। এখানেই স্মির্না থেকে ইস্পাহানের রাস্তা মিলিত হয়েছে।
টোকাট সুউচ্চ পর্বতের পাদদেশে খুব সুন্দর শহর। এটি একটি শিলার চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে যা প্রায় শহরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। এর উপরে আছে সুরক্ষিত দুর্গ। এখান থেকেই সমগ্র শহর আশপাশের শাসন পরিচালিত হয়। এখানে দুর্গ ও নগর রক্ষার জন্য আছে দক্ষ সৈন্যবাহিনী। দূর্গটি অনেক প্রাচীন। প্রাচীনকালে এখানে তিনটি দুর্গ ছিল, এটি তারই অবশিষ্টাংশ। তুর্কি শাসিত এই নগরে তুর্কি, আর্মেনিয়ান, গ্রীক ও ইহুদিদের সৌহার্দ্যপূর্ণ বসবাস রয়েছে। রাস্তাগুলি সংকীর্ণ, কিন্তু বাড়িগুলো প্রশস্ত ও ভালভাবে নির্মিত। বেশ কয়েকটি মসজিদ রয়েছে, তার মধ্যে একটি খুবই জাঁকজমকপূর্ণ। এটি সম্প্রতি নতুন ভাবে নির্মিত হয়েছে মনে হয়। এখানে একটি সুন্দর সরাইও তৈরি হচ্ছিল, যা আমি শেষবার যখন সেই পথে যাত্রা করেছি, তখন পুরোপুরি নির্মিত হয়নি। টোকাটে একটি জিনিস আরও বিশেষ ও সুবিধাজনক রয়েছে, যা রাস্তার কোনও সরাইয়ে আর পাওয়া যায় না। শহরের চারপাশেই আছে পান্থনিবাস, বণিকদের জন্য সেখানে থাকার ব্যবস্থা আছে, যারা টোকাটে থাকাকালীন কোলাহল ও কাফেলার তাড়াহুড়া থেকে মুক্ত থাকতে চায়। তাছাড়া, সেই ব্যক্তিগত বাসস্থানগুলিতে আপনার মদ পান করা ও বাকী যাত্রার স্বাধীনতা রয়েছে; যা সাধারণ সরাইগুলোতে এত সহজে করা যায় না। সেখানে তুর্কিরা বণিকদের উপর নজর রাখে এবং তাদের পকেট থেকে অর্থ বের করে নেওয়ার ধান্ধায় থাকে। টোকাটে খ্রিস্টানদের বারোটি চার্চ রয়েছে, সেখানে একজন আর্কবিশপ বাস করেন। তার অধীনে আছেন সাত জন সাফ্রাগান। টোকাটের চারপাশে চৌদ্দ বা পনের লীগের মধ্যে পুরুষ সন্ন্যাসীদের জন্য দুটি মঠ এবং নারী সন্ন্যাসিনীদের জন্য দুটি মঠ রয়েছে। দেশটি সমস্ত আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান অধ্যুষিত, তবে খুব কম সংখ্যক গ্রীকও তাদের সাথে মিশে গেছে। খ্রিস্টানদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী এবং বেশীর ভাগই সেকরা। নগর থেকে আধ-পোয়া লীগ দূরে একটি পরিচ্ছন্ন নদী প্রবাহিত হয়েছে, যা এরজেরুমের নিকট দিয়ে বয়ে গেছে এবং একটি সুন্দর পাথুরে সেতুর নীচ দিয়ে টোকাট অতিক্রম করেছে। শহরের উত্তর পাশে, এর প্রবাহ একটি সমতল ভূমিতে তিন বা চার দিনের যাত্রা পরিমাণ এবং দুই বা তিন লীগ প্রশস্ত হয়ে প্রবাহিত হয়। এটি খুবই উর্বর এবং গ্রামগুলো খুব ভাল মানুষে পূর্ণ। একজন মানুষ টোকাটে খুব কম খরচে বেঁচে থাকতে পারে। ওয়াইন সবচেয়ে চমৎকার এবং সব ধরণের বিরল ফলমূলে পরিপূর্ণ। এটি এশিয়ার একমাত্র জায়গা যেখানে প্রচুর পরিমাণে জাফরান জন্মে। জাফরান ভারতবর্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেরা পণ্য। বছর শেষে এক পাউন্ড জাফরানের মূল্য তের বা চৌদ্দ ফ্রাঙ্ক , যদিও যে মোম দিয়ে এটি সংরক্ষণ করা হয় তার ওজনও জাফরানের সমপরিমাণ। এই নগরী, তার অন্তর্গত জমিগুলি সাধারণত একজন বিধবা সুলতানার সম্পত্তি। এখানে মাত্র একজন আগা ও একজন কাজী থাকেন, যারা একজন উর্ধতন পাশার পক্ষে শাসন করেন যার কাছ থেকে তারা তাদের আদেশ পান। তিনি সিবাসে, প্রাচীন সেবাস্তিয়ায় বাস করেন। সিবাস একটি বড় শহর যা টোকাট থেকে প্রায় তিন দিনের পথ। সংক্ষেপে, টোকাট হল প্রাচ্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জনপথগুলোর একটি যেখানে পারস্য, ডিয়ারবেকার, বাগদাদ, কনস্টান্টিনোপল, স্মির্না, সিনোপাস ও অন্যান্য স্থান সমূহের কাফেলাগুলো অবস্থান করে। এখানেই কাফেলাগুলো সফর শেষ করে, আবার এখান থেকেই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। যারা কনস্টান্টিনোপল যাবেন, তারা শীতল-পশ্চিমে হাতের ডান দিকে, যারা স্মির্না যেতে চান তারা গ্রীষ্ম-পশ্চিমে হাতের বাম দিকের রাস্তা ধরবে। টোকাট থেকে যেকোন পথেই যাত্রা করবেন, একজন শুল্কসংগ্রহকারী সকল উট ও ঘোড়া গণনা করবে। প্রতিটি উটের জন্য পোয়া রৌপ্যমুদ্রা, এবং প্রতিটি ঘোড়ার জন্য আধরৌপ্যমুদ্রা আদায় করবে। ঘোড়া বা উটসওয়ার অথবা তাদের পণ্যসমূহের জন্য কোন শুল্ক দিতে হয় না। কাফেলার এই ক্রমাগত সমাবেশ থেকে শুল্ক সংগ্রহ করে টোকাট তুরস্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শহরগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়েছে।
টোকাট থেকে যাত্রা করে এরজেরোম যাওয়ার প্রাক্কালে পাহাড়ের পাদদেশে একটি ছোট গ্রাম পাবেন। যেন পর্বতটি এর শীর্ষে রয়েছে। সেই পর্বত ও নদীর মাঝখানে, কাফেলা যেখান দিয়ে যাবে সেই রাস্তাটি খুবই সংকীর্ণ। এই রাস্তাতেই চার শত অনুচর সহ শিকার থেকে ফিরে আসা প্রধান মন্ত্রীর সাথে আমাদের দেখা হয়। খুব দ্রুত তিনি আমাদের বিষয়ে অবগত হন এবং আমাদের তাঁর পাশ দিয়ে স্বাধীনভাবে চলে যাওয়া নিমিত্তে তাঁর অনুচরদের সরিয়ে দেন। কিন্তু সকল দলের মধ্যে তিনি এমন একজনের দিকে দৃষ্টি দেন যার কাছে চার ফ্রাঙ্কের বেশি মুদ্রা ছিল না, যা তাকে কাফেলা তদন্তের জন্য বাধ্য করেছিল যে আমরা কারা। কাফেলা তদন্ত ঈর্ষার খারাপ পরিণতি থেকে রক্ষা করেছে। মন্ত্রী যথেষ্ট সদাশয় ছিলেন। ঘটনাটি এমন সময়ের যখন প্রধান মন্ত্রী পারস্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তাঁকে বলা হল আমরা ইহুদী। তিনি এমন মাথা নাড়লেন, বললেন, আমরা দেখতে সে রকম না। এটা আমাদের জন্য ছিল আনন্দের, কেননা, এরপর তিনি আমাদের প্রতি আর বেশি নজর দেন নি। বিশ জনের মধ্যে একজন ছিল ইহুদী, ভাল বিবেচনা করলে তিনি আমাদের থামানোর জন্য লোক পাঠাতে পারতেন। কিন্তু প্রাসাদে ফিরে তিনি দেখলেন একজন ক্যাপিগি তাঁর জন্য অপেক্ষমান। তাঁর কাছে ছিল প্রধান মুফতির আদেশ নামা, যাতে তাঁর শিরোচ্ছেদর নির্দেশ ছিল। তৎক্ষণাৎ সে আদেশ কার্যকর করা হয়েছিল। যেহেতু আমীর তাঁর সেনাবাহিনীর ক্ষতির জন্য বিচলিত ছিলেন, এবং যার আদেশে তা সংঘটিত হয়েছিল তার প্রতি প্রতিশোধ নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
যদিও কাফেলা টোকাটে বিশ্রাম নেয়, তবও তারা একইভাবে দুই বা তিন দিন অবস্থান করে চার্কলিকুতে। এটি টোকাট থেকে দুই লীগের বেশি দূরে নয়। চার্কলিকু একটি সুন্দর প্রদেশের বড় শহর, এখানে দুটি উর্বর পাহাড় রয়েছে, যাতে ওয়াইন প্রস্তুতের জন্য প্রচুর আঙুর উৎপন্ন হয়। এখানকার বাসিন্দাদের অধিকাংশই খ্রিস্টান, যারা সাধারণত চর্মকার। টোকাট ও আশপাশের এলাকায় তারা ছাগচর্মের কাজ করে। মনে করা হয় জল তাদের শিল্পে অনেক অবদান রাখে। টোকাট ছাগচর্মের জন্য বিখ্যাত, যেমন দিয়ারবেকুইর এবং বাগদাদ লাল রঙের জন্য, মৌসুল বা প্রাচীন নিনেভেহ হলুদের জন্য এবং ওরফা কালির জন্য বিখ্যাত। এই শহর থেকে দুই হাজার পদক্ষেপ দূরে, একটি সমভূমির মাঝখানে একটি বিশাল শিলা দৃষ্টিগোচর হবে, এর উত্তর দিকে নয় বা দশ ধাপ উপরে উঠলে একটি প্রকোষ্টে একটি খাট, একটি টেবিল ও একটি আলমারি দেখতে পাবেন। এগুলোর সবই পাথর থেকে কেটে তৈরি করা হয়েছে। পশ্চিম পাশে পাঁচ বা ছয় ধাপ উঠলেই পাবেন একটি লম্বা সুড়ঙ্গ, দৈর্ঘ্য ছয় ফুট এবং তিন ফুট চওড়া। সমস্তই পাথর কেটে বানানো, যদিও এতে অস্বাভাবিক কাঠিন্য রয়েছে। খ্রিস্টানেরা নিশ্চিত করে যে, সেন্ট খ্রাইসোস্টম তার নির্বাসনের সময় এই শিলাটিকে তার অবসর কাটানোর স্থান বানিয়েছিলেন। এই পাথরটি ছাড়া তার কোন বিছানা-বালিশ ছিল না। এখানে আপনি একজন মানব দেহের ছাপ দেখতে পাবেন। এই কারণেই, অধিকাংশ খ্রিস্টান নিয়ে গঠিত কাফেলা এই শিলাকে ভক্তি প্রদানের জন্য চার্কলিকুতে অবস্থান করে। স্থানীয় বিশপ, কিছু পুরোহিত হাতে মোমবাতি নিয়ে ওখানে যায় এবং প্রার্থনা করে। কিন্তু আসল কারণ হলো, এখানকার আঙুর হতে উৎকৃষ্ট ওয়াইন তৈরি হয়। দামেও সস্তা, টোকাটের চেয়ে আধা দাম। আর্মেনিয়রা এখানে থামতে বাধ্য হয় তাদের বাকী যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।
চার্কলিকু থেকে দুই লীগ গেলে একটি উঁচু পর্বত পাড়ি দিতে হবে যার দু পাশে রয়েছে খাড়া ও উঁচু গিরিচুঁড়া। আর্মেনিয়দের রীতি হলো, যখন তারা কাফেলার অভ্যাগমনের কথা শুনে তখন তারা স্বদেশীয়দের সাক্ষাতের জন্য ঘোড়সওয়ার হয়ে দুতিন দিনের পথ এগিয়ে যায় এবং তাদের জন্য সতেজ খাবার নিয়ে যায়। চার্কলিকুতে যারা আমাদের কাফেলার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, তিনজন আর্মেনীয় একটি বৃহৎ মর্নিংস-ড্রাফট নিয়েছিলেন যা তাদের মদোন্মত্ত সাহসীতে পরিণত করে। তারা একাকি শহরে রওয়ানা হয়ে গেল। কিন্তু, পথিমধ্যে উত্তর দিক থেকে আসা ছয় জন ঘোড়সওয়ার তাদের আক্রমণ করল। সেখানে আমরা যে পর্বতগুলো অতিক্রম করতে যাচ্ছি তার চেয়েও উঁচু পর্বত রয়েছে। তৎক্ষণাৎ চোরেরা তাদের ছোট বর্শাগুলো আর্মেনীয়দের দিকে ছুঁড়ে মারল, এত জোরে মেরেছিল যে দুজন মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পড়ে গেল এবং একজন পাথরের আড়ালে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করল। কিন্তু চোরেরা তাদের ঘোড়া আর মালপত্র সব নিয়ে গেল। সেগুলোর মূল্য ছিল দশ হাজার ক্রাউন । পাহাড়ের চূড়ায় থাকা কাফেলা মুর্খামি করে নিজের বিপদ ডেকে আনা সেই হতভাগাদের দেখেছিল। কিন্তু পথের সংকীর্ণতার কারণে তাদের কোন সাহায্য করতে পারেনি। তাছাড়া চোরেদের সব পথ ছিল চেনা থাকায় তারা ছিল দৃষ্টির বাইরে। এই কারণে কাফেলা থেকে ছিঁটকে পড়া বিপজ্জনক, খুব বেশি পশ্চাতেও থাকা যাবে না, খুব বেশি আগেও যাওয়া যাবে না। কেউ কেউ পাঁচ শ পদক্ষেপ দূরে থেকেও ভোগান্তিতে পড়েছেন। [ক্রমশঃ]