ইতিহাস পর্যবেক্ষণে জানা যায়, পুরান ঢাকা একসময় অত্যন্ত সুপরিকল্পিত, সুন্দর ও ছিমছাম একটি শহর ছিল। পুরান ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল কয়েকটি গঞ্জ এবং সেই গঞ্জ গুলো নিয়েই আজ আমাদের পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার আভিজাত্য ছিল চোখধাঁধানো কিন্তু মুঘল শাসকদের পতনের পর থেকে পুরান ঢাকার ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে আসে। ব্রিটিশ শাসকরা এ শহরের কিছু দেখভাল করলেও বর্তমান সময়ের প্রশাসনযন্ত্রের অবহেলায় পুরান ঢাকা ধীরে ধীরে তার শ্রী হারিয়ে ফেলছে।
শক্তি ঔষাধলায়ের মালিকের বাড়ি দেখে দয়াগঞ্জ নতুন রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। এরপর হাঁটা শুরু করলাম কাঠেরপুল লেন। বানিয়া নগর নতুন রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলাম, এবার জাসটিস লালমোহন দাস লেন ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরান ঢাকার এক ঐতিহাসিক মন্দিরের সামনে এসে হাজির হলাম। একসাথে দুটো মন্দির যার একটির নাম শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ জিউ মন্দির অন্যটি লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দির। উভয় মন্দির কাঠেরপুল, তনুগঞ্জ লেন, সূত্রাপুরের মধ্যে পড়েছে। সকাল বেলা মন্দিরের গেট খোলা ছিল কিন্তু কি কারণে জানি ভিতরে প্রবেশ করলাম না। বাহির থেকে মন্দির দুটো দেখে আবারও হাঁটা শুরু করলাম।
এবার একটু সূত্রাপুরের ইতিহাস জেনে আসি। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায় তা হলো যারা কাঠের কাজ করেন তারা সূত্রধর নামে পরিচিত। সূত্রাপুর এলাকায় অধিকাংশ লোক কাঠের কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তাই এলাকাটির নামকরণ হয়েছিলো সূত্রাপুর। এই হলো সূত্রাপুরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি বহু দিনের, ঐতিহাসিক কোন স্থাপনা দেখলেই তার মোহে পড়ে যাই। ইতিহাস ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা আমায় আপন করে নিয়েছে তার নিজের মত করে। এরা জড় পদার্থ তবে এদের পুরো শরীর জুড়েই কথার বর্ণমালা ছাপানো কি দারুণ। ইতিহাস আপনাকে শতবর্ষ থেকে হাজার বছর থেক লক্ষ বছর পর্যন্ত পিছনের সময়কে ভাবতে সাহায্য করে।
আমি সেই মোহে বারবার এসব জায়গায় ফিরে যাই। এবার হেঁটে চলে আসলাম ২৭ বি কে দাস রোডে, প্রথমেই এই রোডে চোখে পড়ল শ্রী শ্রী বিহারী লাল জিউ মন্দির। এই মন্দিরের ঠিক অপর পাশে রয়েছে পরপর দুটো বাড়ি। একসময়ের বনেদি ঢাকার এসব জায়গায় যে বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছিল তা বর্তমান সময়ের সুরম্য অট্রালিকার চেয়ে কয়েকগুন বেশি নান্দনিক এবং আকর্ষনীয় ছিল।সেসব বাড়ি গুলোর কারুকার্য দেখলেই মনের মধ্যে আলাদা এক আমাজের তৈরি হয়। কি দারুণ সব স্থাপত্য শৈলীতে নিপুণ হাতে তৈরি করা হয়েছিল এসব বাড়িগুলো।
পুরান ঢাকায় আমি বহুবার এসেছি— প্রত্যেকবারই নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করি। পুরান ঢাকা আমার কাছে আভিজাত্য এক নগর। এই পুরান ঢাকার ইতিহাস শত শত বছরের। এর পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাসের গন্ধ। আমি সেই গন্ধ বারবার ফিরে যাই পুরান ঢাকায়।
বি কে দাস রোড, ফরাশগঞ্জের দিকে হাঁটছি। এবার আমার সামনে একে একে অনেক গুলো বাড়ি চোখে পড়ল। সকাল বেলা ঢাকার অন্য দিকগুলো ঘুমন্ত থাকলেও পুরান ঢাকার কর্মচঞ্চলতা শুরু হয় সেই সূর্যের আলো উঠার আগ থেকেই।ফরাশগঞ্জের বি কে দাস রোডে প্রবেশের পর আমার মনে হয়েছে আমি এখন সত্যিকারের পুরান ঢাকায় আছি। রাস্তার দু পাশ জুড়ে শত বছরের কয়েকটি ভবন। সেসবে দারুণ সব কারুকার্য, মনমাতানো এইসব কারুকার্য দেখে যে কারো মন সুখের সৌন্দর্য্যে আন্দোলিত হয়ে উঠবে। বি কে দাস লেনের এসব বাড়ির আনুমানিক বয়স ১৫০ বছরের কাছাকাছি। একের পর এক দ্বিতল ভঙ্গুর ভবনগুলো আমার চোখের সামনে প্রজাপতি হয়ে ভাসছিল। প্রায় বাড়িতেই দখলদারদের কবলে পড়েছে। বাড়ির চেহারা দেখলেই সেটা উপলব্ধি করা যায়। কোন কোন বাড়ির টান বারান্দা— ঝুলন বারান্দা দেখে আমার মন চাচ্ছিল এসব বাড়িগুলোতে এক রাত করে কাটাই। কিন্তু সেই কপাল নাই। প্রত্যেকটা বাড়িই তার আগের রূপে রয়েছে। তবে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে, যে কোন সময় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞে রূপান্তরিত হতে পারে এসব বাড়িগুলো।
একসময়ের আভিজাত্যের এই নগরে কত উন্নত এবং গোছাল নগর সভ্যতা ছিল, সেই নগর সভ্যতার মানুষ গুলোর রুচি ছিল কতটা উচ্চমানের তা এসব বাড়ির দিকে তাকালেই সহজে অনুমান করা যায়। এই বাড়ি গুলোর দিকে তাকালেই ফরাশগঞ্জ সম্পর্কে জানতে সবার ইচ্ছে করবে।
ফরাশগঞ্জের রয়েছে সুন্দর এক ইতিহাস। ঢাকার অদূরে নায়েব নাজিম নওয়াব নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের অনুমতি নিয়ে ১৭৮০ সালে একটি ফরাসি বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ এলাকার আদি নাম ছিল ফ্রেন্সগঞ্জ। এখানে ফরাসি লোকজন বসবাস করত এবং সে সময়ে এর একদিকে আহসান মঞ্জিল এবং অপরদিকে তেজগাঁও-এর গার্ডেন হাউজ ছিল। ১৭৫০ সালে ইংরেজদের মালিকানাধীন একটি কারখানা দখলের মাধ্যমে এ জায়গায় ফরাসি বসতির সূত্রপাত ঘটে। এতে একটি সঙ্কট দেখা দিলে পরবর্তীকালে নায়েব নাজেম জাসারাত খানের হস্তক্ষেপে তা নিরসিত হয়। ১৭৫৭ সালে বাংলার মুসলিম যুগের অবসানের বহু পূর্বে উক্ত কারখানার নাম ঢাকা কারখানা করা হয়। কিন্তু ফরাশগঞ্জের সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এলাকাটিতে ফরাসি ব্যবসায়ীরা কাঁচা হলুদ, আদা, রসুন ও মরিচের পাইকারি আড়ত গড়ে তোলে। ঢাকা শহরে এটি একটি ফরাসি অধ্যুষিত এলাকা। এছাড়া ফরাশগঞ্জ বহুসংখ্যক পুরানো ও ঐতিহাসিক ভবনের জন্যও বিখ্যাত। এই হলো ফরাশগঞ্জের ইতিহাস।
এই পর্বে এসব রোডে পূর্বে দেখা অনেক বাড়ি আমি দেখিনি কারণ সেগুলো আমি কয়েকবার ভ্রমণ করেছি। এবার শুধু সেসব সম্পর্কেই লিখছি যা আমি আগে দেখিনি। ফরাশগঞ্জের বি কে দাশ লেনের সবচেয়ে সুরম্য অট্রালিকার সামনে এসে হাজির হলাম। এই বাড়িটির নাম ফরাশগঞ্জ বড় বাড়ি। বাড়িটি দখল করে সেখানে গড়ে উঠেছে ফার্নিচারের দোকান, বাড়ির সামনের দিকটায় ছিল নান্দনিক সব গ্রিক স্থাপত্য শৈলী। কিন্তু সেসব আজ তার শ্রী হারিয়ে শ্রীহীন হয়ে গেছে। বাড়িটির দরজায় গিয়ে আমি বারবার নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম বাড়িটার ভিতরে আমার জন্য এত ভয়াবহ সুন্দর কিছু অপেক্ষা করতেছে তা আমি কল্পনাও করি নাই। যদিও সেসব সৌন্দর্য্য আসলে আক্ষেপটাকেই দীর্ঘ করতেছে। কি দারুণ নান্দনিক একটা বাড়ি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলাম। দুটো ভাগে এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
এবার এই বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে একটু জেনে আসি— বি কে দাশ অর্থাৎ বসন্ত কুমার দাশ আর তাঁর ভাই প্রসন্ন কুমার দাশ। প্রসন্ন কুমার ছিলেন বরিশাল বড়ঘর এস্টেটের জমিদার। বিংশ শতাব্দীর শুরুর কথা। ঢাকায় একটি বাড়ি করলেন থাকার জন্য। সেই বাড়িটিই এই বড়বাড়ি। কি ছিল না এই বাড়িতে— সবই ছিল এই বাড়িতে কিন্তু আজ কিছুই নেই, শুধু ঐতিহাসিক তকমা গায়ে লাগিয়ে একটা কঙ্গাল দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটার ভিতরে যখন প্রবেশ করি তখন দোতলায় উঠার অনুমতি চাই। আমি অনুমতি পেয়েও যাই, অনুমতি নিয়ে বাড়িটির উপরে উঠলাম। দু অংশে ভাগ এই বাড়ির সামনের অংশে কয়েকটি পরিবার বাস করে। সেই একই রূপে বাড়িটি আছে, তবে তার শরীর নেই, দেহ নেই, মন নেই— কিছুই নেই। নব্য ধ্রুপদি নকশার এ বাড়িটি প্রসন্ন কুমার দাশ তৈরি করেছিলেন ১৯০৫ বা ১৯১০ সালের দিকে। এ বাড়ির নকশার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে ফরাসি রোকোকো, মাল্টি কোর্টইয়ার্ড বা একাধিক উঠান, এলিভেটেড ওয়াকওয়ে। এ বাড়িটায় মোট ভবন দুটি, তিনটির মতো বারান্দা। কক্ষ সাকুল্যে ৯ থেকে ১০টি। বাড়িটার সামনের অংশটুকু দ্বিতল, পেছনটা তিনতলা। শোনা যায়, উঠানগুলোর কোনোটি ছিল পরিবারের সদস্যদের জন্য, কোনোটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়কদের জন্য। ঐতিহ্যবাহী বাড়িটির এখন ভগ্নদশা। একটি অংশ ইতিমধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে। চারপাশ দেখে মনে হয়, যেকোনো সময় বাড়িটি ভেঙে পড়তে পারে বা ভেঙে ফেলা হতে পারে। এত দিন বড়বাড়িসহ বি কে দাশ রোডের ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউকের সংরক্ষিত সম্পত্তি ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর রাজউকের সর্বশেষ গেজেটে এখানকার বাড়িগুলো সংরক্ষিত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ পড়ে। যা নিয়ে ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পুরান ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা। এসব কিছু তথ্য জানতে পারি প্রথম আলোর একটা আর্টিকেল পড়ে। এই হলো পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক শতবর্ষী এক বাড়ির গল্প।
মাঝেমধ্যে ভাবি— এসব যদি রি-কনভার্ট করে ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করত, বাংলাদেশের এসব স্থাপনা দেখতে ভীড় লেগেই থাকত। কি দারুণ আমাদের এই পুরান ঢাকা।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পুরান ঢাকার অনেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার ভারতের কলকাতায় চলে যায়। আবার কলকাতা থেকে অনেক মুসলিম আসেন ঢাকায়। এ সময় কোনো কোনো বনেদি পরিবারের মধ্যে বাড়ি-ভূসম্পত্তির মালিকানা বদল করার সুযোগ ঘটে। বড়বাড়ির মালিক প্রসন্ন কুমার দাশও পেরেছিলেন। বাড়িটি কিনে নেয় ঢাকার একটি পরিবার। প্রসন্ন কুমারের বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি এমন একটা অট্রালিকার মালিক যদি হতে পারতাম, আহারে……