» জহির রায়হান

লেখক :

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একেবারে শুরুতেই জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন উপন্যাসের “আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো” লাইনটা এই প্রজন্মকে সাহস জুগিয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। প্রায় ৫৪ বছর আগে হারিয়ে গিয়েও জহির রায়হান বেঁচে থাকলেন মানুষের মাঝে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কন্ঠস্বর হয়ে।

জহির রায়হান, বিস্ময়কর এক মানুষ। একাধারে সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিক – এই মানুষটার মতো ডায়নামিক মিডিয়া পার্সোনালিটি বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়টা নাই।

আমরা হুমায়ূন আহমেদকে চিনে বড় হইসি কিন্তু জহির রায়হান আর কয়েকটা দশক পড়ে জন্মালে কিংবা ৩৭ বছর বয়সে চিরতরে হারিয়ে না গেলে হয়তো চিরকাল জহির রায়হান জ্বরে ভুগতো বাঙালি।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর প্রভাব কতটা গুরুতর হতে পারতো, তা হয়তো একটা ঘটনা থেকেই বোঝানো যাবে। জহির রায়হানের ” জীবন থেকে নেয়া ” চলচ্চিত্রের (বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র) স্ক্রিনিংয়ে ওপার বাংলার হৃত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়ের মতো বাঘা বাঘা নামের উপস্থিতি ছিল।

স্বয়ং সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ” চলচ্চিত্র জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো জহিরের হাতে। এটা রীতিমতো একজন গুণী, প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারের জন্য মাইলফলক।”

সেসময় জহির রায়হান আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। তবুও এই স্ক্রিনিং থেকে আসা সমস্ত অর্থ মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দিয়েছিলেন।

ক্ষুদ্র জীবনে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে অসীম ভালোবাসায় লালন করেছিলেন নিজের মধ্যে। অবিচারের বিরুদ্ধে প্রত্যেকটা রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে ছিলো তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ।

১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের মিছিলে যে দশ জনের দলটি সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলো , সেই দশজনের মাঝে একজন ছিলো ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া জহির রায়হান।

মুক্তিযুদ্ধে যে কজন বুদ্ধিজীবী নিজেদের মেধা দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন , তাঁদের মধ্যেও তিনি অগ্রগামী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের কলকাতায় গিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। নির্মাণ করেন তাঁর বিখ্যাত “স্টপ জেনোসাইড” তথ্যচিত্র।

একটি পরাধীন জাতির স্বাধীনতার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অকাতরে প্রাণের বলিদান, শত ত্যাগ তিতিক্ষা আর পাকিস্তানীদের বর্বরতাকে তুলে ধরে বানানো “স্টপ জেনোসাইড” ডকুমেন্টারিকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি বলা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার ক্ষেত্রে” স্টপ জেনোসাইড” একটা ভাইটাল রোল প্লে করেছিলো।

নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! স্বাধীনতার জন্য , অধিকার আদায়ের জন্য যেই মানুষটা ২০ বছর ধরে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁকেই দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দেড় মাসের মাথায় চিরকালের তরে গুম করে দেওয়া হলো। দেশের আরেক কৃতি সন্তান, প্রিয়তম ভাই বুদ্ধিজীবী শহিদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন সেদিন।

মৃত্যুর আগে তিনি “লেট দেয়ার বি লাইট” সিনেমা নিয়ে কাজ করছিলেন। পরবর্তীতে সত্যজিৎ রায়কে অনুরোধ করা হয়েছিল এই অসমাপ্ত সিনেমার কাজ শেষ করতে। সত্যজিৎ স্ক্রীপ্ট চাইলেন।

উত্তরে শুনতে হলো, ” সব তাঁর মাথায় ছিলো, খাতায় কিছুই। ছিলোনা। পকেটে ছয় আনা নিয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলা মানুষের পক্ষেই হয়তো এটা সম্ভব।”

জহির রায়হান গুম হয়ে যাওয়ার ৫৪ বছর শেষ হতে চলল। মৃত্যুর রহস্য অমীমাংসিতই থেকে গিয়েছে।

জীবন থেকে নেয়া, স্টপ জেনোসাইড, বেহুলা, হাজার বছর ধরে, লেট দেয়ার বি লাইট – এসবের স্রষ্টাকে কি আদৌ ভোলা সম্ভব?যখনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠবে, তখনই জহির রায়হান ফিরে আসবে অনুপ্রেরণা হয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *