‘অভিনয় ছাইড়্যা দাও, রবীন। শুধু গান গাও’। বলেছিলেন শচীনদেব বর্মন। না, তিনি অভিনয় ছাড়তে পারেননি। অভিনয় আর গান দুটোর মধ্যে একটাকে তিনি বেছে নিতে পারেননি। এ দুই-ই যে তাঁর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। কারণ তিনি যেমন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের ছাত্র তেমনি তিনি তো প্রমথেশ বড়ুয়ারও শিষ্য। আর তাই কি তিনি হতে পারলেন না হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা মান্না দে-র সমকক্ষ এক সংগীতশিল্পী?
১৯১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনও এক দিন হুগলি জেলার চোপা গ্রামে অমূল্য কুমার মজুমদারের পুত্র রবীন্দ্রনাথ মজুমদারের জন্ম। তবে হুগলি জেলায় জন্ম হলেও তাঁর বেড়ে ওঠা কিন্তু কাটিহারে। কারণ তাঁর বাবা ছিলেন রেলওয়ে কর্মচারী এবং পোস্টিং ছিল কাটিহারে।
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন মাত্র বারো তখনই তিনি উত্তরবঙ্গ-রাজশাহী ডিভিশন সংগীত প্রতিযোগিতায় হলেন প্রথম। বাবা খুশি হয়ে তাঁকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিয়ে বললেন, ‘শুধু গান গাইলেই হবে না। তোমাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে’।
ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তিনটে লেটার নিয়ে পাস করে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হলেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। আজকের প্রজন্ম বুঝতেই পারবে না যে কতটা মেধাবী ছাত্র হলে সেই সময় তিনটে লেটার পাওয়া যেতে পারে। স্কটিশ চার্চ কলেজের অ্যানুয়াল সোস্যালে ছেলেটি ঠিক করল যে প্রমথেশ বড়ুয়াকে সভাপতি করে নিয়ে আসতে হবে। সকলে হেসে উড়িয়ে দিল। কিন্তু ছেলেটি বড়ো একরোখা। সে কারও বিদ্রুপকে তোয়াক্কা না করে পৌঁছে গেল বড়ুয়া সাহেবের বাড়িতে। একটা কলেজের সোশ্যালে আসবেন প্রমথেশ বড়ুয়া? এ যে অসম্ভব! কিন্তু ছেলেটির জেদের কাছে হার মানলেন বড়ুয়া সাহেব। অবশেষে রাজি হলেন। তবে থাকবেন মাত্র দশ মিনিট। তাই সই। যথাসময়ে বড়ুয়া সাহেব পৌঁছতেই ছেলেটি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়ল, গাইল ‘শাওন রাতে যদি… ‘। গান শুনে মুগ্ধ বড়ুয়া সাহেব ছেলেটিকে পরদিন দেখা করতে বলে হল ছেড়ে চলে গেলেন।
রাতে ছেলেটি ঘুমোতে পারল না। সকাল হয়েছে কি হয়নি, পৌঁছে গেল বড়ুয়া সাহেবের বাড়িতে। প্রথমেই বড়ুয়া সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছবিতে অভিনয় করবে’? কিন্তু এ তো এক অসম্ভব প্রস্তাব। বাবা জানতে পারলে আর রক্ষা থাকবে না। ছেলেটি বলল, ‘না। তা সম্ভব নয়। সামনেই আমার পরীক্ষা।’ বড়ুয়া সাহেব কী বুঝলেন, বললেন, ‘ঠিক আছে তোমার বাড়ির ঠিকানাটা রেখে যাও’। কাটিহারের বাড়ির ঠিকানাটা লিখে দিয়ে ছেলেটি চলে গেল সেখান থেকে।
পরীক্ষা শেষে ছেলেটি ফিরে গেল কাটিহারে। হয়তো ভুলেই গিয়েছিল বড়ুয়া সাহেবের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল। কিন্তু না, বড়ুয়া সাহেব ভোলেননি। হঠাৎই একদিন কাটিহারের বাড়িতে একখানা চিঠি এসে হাজির। ভাগ্যিস চিঠিটা বাবার হাতে পড়েনি। তাহলে হয়তো কী ছিল সেই চিঠিতে তা ছেলেটি জানতেও পারত না। পড়াশোনার ব্যাপারে কিছু কাজ রয়েছে বলে ছেলেটি পাড়ি দিল কলকাতায়। সোজা বড়ুয়া সাহেবের বাড়িতে। বড়ুয়া সাহেব তখন শাপমুক্তি ছবি তৈরি করার কথা ভাবছেন। তিনি ছেলেটিকে বললেন, ‘আজ থেকে তোমার নাম আমি ছেঁটে দিলাম। তোমার নাম রবীন মজুমদার’। তিনি রবীন মজুমদারকে নিয়ে গেলেন সোজা স্টুডিয়োতে। সেখানে তাকে রঙিন ধুতি-শার্ট পরানো হল। লুক টেস্ট হল, ভয়েস টেস্ট হল। তারপর তিনি ছেলেটিকে নিয়ে গেলেন প্রডিউসারের কাছে। বললেন, ‘এই নিন, বাংলা ছবির নতুন এক গায়ক-নায়ক। শাপমুক্তিতে ওই লিড রোলে অভিনয় করবে’। কিন্তু লিড রোলে তো সুশীল মজুমদারের অভিনয় করার কথা আর গান গাইবেন সত্য চৌধুরী। ‘সে আমি বুঝে নেব’, বললেন বড়ুয়া সাহেব। সে সময় বড়ুয়া সাহেবের ওপর আর কে কথা বলবে? ১৯৪০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেল ‘শাপমুক্তি’। তবে ঠিক তার আগের দিন একটা ঘটনা ঘটল। সেদিন ছবির প্রিন্ট দেখতে দেখতে বড়ুয়া সাহেবের মনে হল যে পাঁচ নম্বর রিলে বেশ কিছু ত্রুটি রয়ে গিয়েছে। তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দিলেন কাল সকাল আটটায় সকলকে স্টুডিয়োতে হাজিরা দিতে হবে। তিনি নতুন করে পাঁচ নম্বর রিলটা তৈরি করবেন। রবীন মজুমদার বললেন, ‘সে কি? আগামীকালই তো ছবি রিলিজ় করার কথা’। জবাবে বড়ুয়া সাহেব বললেন, ‘সে ভাবনা আমার, তোমার নয়’। ছবি রিলিজ় করবে উত্তরা সিনেমা হলে। বড়ুয়া সাহেব পাঁচ নম্বর রিল ছাড়া অন্য রিলগুলো পাঠিয়ে দিলেন। পাঁচ নম্বর রিল তখন তৈরি হচ্ছে। ঠিক সময়ে ছবি রিলিজ় করল। চার নম্বর রিল তখন দেখানো হচ্ছে। হলে পৌঁছে গেল পাঁচ নম্বর রিলটা। তারপর সবকিছুই ঠিকঠাক চলল। দর্শক বুঝতেই পারল না যে চার নম্বর রিল চলার সময় হল কর্তৃপক্ষের হৃৎপিণ্ড প্রায় বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল।
শাপমুক্তি হিট। দর্শক পেয়ে গেলেন তাঁদের প্রিয় এক গায়ক-নায়ককে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেন, আবার আমরা একজন সায়গলকে পেয়ে গেলাম। একে একে মুক্তি পেল গরমিল, নন্দিতা, সমাধান, কবি, ভাঙাগড়া, না, টাকা আনা পাই, কাননদেবীর বিপরীতে করলেন হিন্দি ছবি অ্যারাবিয়ান নাইটস। যেমন অভিনয় তেমন গান। গরমিল ছবির ‘এই কি গো শেষ দান’, কবি ছবির ‘কালো যদি মন্দ তবে’ এইসব গানগুলো লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল।
তবে শাপমুক্তি ছবি রিলিজ় হবার আগেই তাঁর গানের রেকর্ড বেরিয়ে গিয়েছে। এই রেকর্ডিংয়েও এক ঘটনা ঘটল। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের সুপারিশে তিনি গিয়েছিলেন এইচএমভি-তে গান রেকর্ড করতে। কিন্তু সেখানে তাঁকে বসিয়ে রাখা হল। বিরক্ত হয়ে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন মেগাফোন কোম্পানিতে। মেগাফোন থেকেই বের হল তাঁর রেকর্ড। এরপর থেকে তিনি নিজের গান মেগাফোন থেকেই রেকর্ড করাতেন।
সেই সময় সংগীতপ্রেমী মানুষ ছায়াছবির গান ছাড়াও অপেক্ষা করে থাকতেন পুজোর গান শোনার জন্য। রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে তিনি গাইলেন ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’। জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গেলেন তিনি।
তারপরই ঘটল ছন্দপতন। ১৯৫২ সালে না পড়েই একটা চুক্তিপত্রে সই করে দিয়েছিলেন। চুক্তিপত্রে লেখা ছিল যে মেয়াদ শেষ হবার আগে তিনি কোনও ছবি করার চুক্তি করতে পারবেন না। তিনি তো কিছুই জানেন না, সই করে ফেলেছেন আরও কয়েকটা ছবির চুক্তিতে। ব্যাস, আর যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে চলে এল উকিলের চিঠি। সব কাজ বন্ধ। চলল মামলা। জমানো পুঁজি সব শেষ। শেষমেশ ওই মামলায় জয়ী হলেও পেলেন না কোনও ক্ষতিপূরণ। এর সঙ্গে জুটল আর এক দোসর। আক্কেল দাঁতের ব্যথায় ভুগছেন তিনি। এক বন্ধু পরামর্শ দিল মরফিন ইনজেকশন নেওয়ার। ব্যথা কমল কিন্তু তিনি হয়ে পড়লেন নেশাগ্রস্ত। সারাক্ষণ ডুবে রইলেন রঙিন জলে। তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে বন্ধু সুরকার নচিকেতা ঘোষ ওই সময় তাঁর হাত না ধরলে তিনি আরও অতলে ডুবে যেতেন। নচিকেতার সেবায় এবং নচিকেতার বাবা ডাক্তার সনৎকুমার ঘোষের চিকিৎসায় এবং মনতোষ রায়ের তত্ত্বাবধানে ব্যায়াম করে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পেলেন। ধীরে ধীরে তিনি আবার ফিরে এলেন তাঁর জগতে। বন্ধু নচিকেতাকে তিনি কোনোদিন ভুলে যাননি। সারা জীবন তিনি ছিলেন নচিকেতার প্রতি কৃতজ্ঞ। ফিরে আসার পর যে ছবিতেই তিনি কাজ করেছেন তাঁর প্রথম শর্ত থাকত ছবির সুরস্রষ্টার দায়িত্ব নচিকেতাকেই দিতে হবে। একবার নচিকেতা বললেন, ‘একটা গানের সুর করেছি তোমাকে গাইতে হবে’। গানটা শুনেই রবীন মজুমদার বললেন, ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকতে এই গান আমি কেন গাইব’? এই হল প্রকৃত শিল্পী। গানটা ছিল “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে”।
এরও অনেকদিন পর তখন রবি প্রায় অস্তমিত। শরীর ভেঙে গিয়েছে, গলাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দূরদর্শনে একটা নাটক দেখে সত্যজিৎ রায় সৌমিত্র চ্যাটার্জীকে বললেন, ‘ইনিই বোধ হয় তোমার সেই রবীন মজুমদার? একটু্ যোগাযোগ করে ওঁকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো তো’। সত্যজিৎ জানতেন যে সৌমিত্র রবীন মজুমদারের গুণমুগ্ধ। তখন তিনি হীরক রাজার দেশে ছবিটা তৈরি করার পরিকল্পনা করছেন। দেখা হলে সত্যজিৎ রায় রবীন মজুমদারকে চরণদাসের চরিত্রে অভিনয় করতে বললেন। জানতে চাইলেন তিনি গান গাইতে পারবেন কি না? রবীন মজুমদার বললেন যে তিনি গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। ‘কুছ পরোয়া নেই, সেক্ষেত্রে আপনি শুধু লিপ দেবেন আর গান গাইবেন অমর পাল’। সেখানে চরণদাসরূপী রবীন মজুমদারের একটা সংলাপ ছিল “গান শেষ আর জানও শেষ, একই কথা”। ছবি রিলিজ় করার বছর তিনেকের মধ্যেই তিনি পাড়ি জমালেন অজানার পথে।
আর তার সঙ্গেই বোধ হয় শেষ হয়ে গেল একটা যুগ। যে যুগের সূচনা হয়েছিল কুন্দনলাল সায়গল আর কাননদেবীর হাত ধরে। গায়ক-নায়ক হয়ে যে পতাকা তিনি সায়গলের উত্তরসূরি হিসাবে বহন করেছিলেন সেই পতাকা বইবার আর কেউ রইল না। তারপরও অবশ্য কিছুদিন ছিলেন কিশোর কুমার। তবে তিনি তো আর খুব বেশি বাংলা ছবি করেননি।
তথ্য: আনন্দবাজার এবং রবীন মজুমদারের বোন বাচিক শিল্পী গৌরী ঘোষের বিভিন্ন লেখা থেকে।