» আটাত্তরের আগে বাঙ্গালী কবে, কোথায় ইলিশ-পান্তা খেত?

খুব সম্ভবত প্রথম আমি ইলিশ মাছ সহযোগে মাটির সানকিতে পান্তা ভাত খাওয়া দেখি ১৯৭৮-এর পয়লা বৈশাখ রমনার বটমূলে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এরা বিশেষ চেতনায় সমৃদ্ধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র। ইলিশ মাছের প্রজনন চক্র সম্পর্কে এদের জ্ঞান, বোধ বা শিক্ষার মান দেখে বুঝা যায় এই তরুণরা স্বল্প শিক্ষিত।

১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারাদেশে জাটকা (বাচ্চা ইলিশ) আহরণ, পরিবহন, মজুত, ক্রয়-বিক্রয় ও বাজারজাতকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। ২০১৪ সালে সংশোধিত বাংলাদেশের মৎস্য আইন অনুযায়ী, দীর্ঘে ১০ ইঞ্চি আকারের মধ্যে বিকশিত সকল ইলিশই জাটকা, মুখ থেকে লেজ পর্যন্ত এই মাপ হিসাব করা হয়। জাটকা সংরক্ষণ অভিযান চলাকালীন ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে এই চার মাস ইলিশ মাছ শিকারী প্রতিটি জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি করে চাল সহায়তা দেয় সরকার। একই সাথে সারাদেশে জাটকা নিধন বন্ধে অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম চলে সেই সময়। তখন অনেক জেল, জরিমানা এমন কি হতাহতেরও ঘটনা ঘটে।

আমরা যদি বাংলাদেশের খাদ্যের ইতিহাস নিয়ে একটু পড়ি তাহলে আমরা পাই, ১১ শতকে শ্রীহর্ষ প্রাকৃতপৈঙ্গলে লিখছেন,

“ওগগরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইকঘিত্তা দুগ্ধসজুত্তা।
মোইণিমত্তা ণালিচগাচ্ছা দিজ্জই কন্তা খা পুনবন্তা॥”

অর্থাৎ, গরম ফেনা ওঠা ভাত তাতে গাইয়ের ঘি, পাট শাক, ময়না (মতান্তরে মৌরলা) কলাপাতায় দুধ সহযোগে যার স্ত্রী পরিবেশন করেন তিনি পুণ্যবান।

চর্যাপদে কিন্তু ঘি, পায়েস আর হরিণের মাংসের কথাও আছে।

এবার পদ্মপূরাণ দেখুন, সেখানে বেহুলার বিয়ের খাবারের পদ ছিল নিরামি ও সুক্তো।

ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলেও কিন্তু আমরা সবজি আর কাতলা মাছের মুড়োর কথা পাচ্ছি। কোথাও কিন্তু ইলিশ নাই!

অন্যদিকে চৈতন্যচরিতামৃতে রাঘব পণ্ডিতকে দেখতে পাই, তিনি পাটশাক নিয়ে যাচ্ছেন মহাপ্রভুর জন্য।

১২ শতকে শ্রীহর্ষ রচিত নৈষধীচরিতে আমরা সেই নিরামিষই পাচ্ছি।

মজার ব্যাপার মঙ্গলকাব্য আর বৈষ্ণব সাহিত্যতেও একই ঘটনা।

ময়মনসিংহের দ্বিজ বংশীদাস তার মনসামঙ্গলে কৈ মাছ, চিতল মাছের কথা বলছেন। ইলিশ কিন্তু বলছেন না।

কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাশয়ের কথাতেও আমরা শুধু নিরামিষই পাচ্ছি আর মাছের মধ্যে পাচ্ছি কই, কাতল, চিতল; কিন্তু ইলিশ না।

পরিশেষে উল্লেখ করবো চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ বা ইউয়ান চোয়াং সরিষা দিয়ে কৈ মাছ রান্নার কথাই বলে গেছেন। আরো বলছেন, বাংলার মানুষ এত ধনী ছিলো যে তারা প্রচুর খাদ্য অপচয় করত।

এতসব কথা বলার পিছনে মূল কারণ, ১৯৭৮-এর পয়লা বৈশাখ রমনার বটমূলে হুজুগ সৃষ্টিকারী (trend-setter) ওই স্বল্প শিক্ষিত তরুণের অনুসরণ করা বন্ধ করুন। ইলিশ পান্তা খাওয়া বাঙ্গালীর সাংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নয়। অপসংস্কৃতিক বিশ্বাস থেকে নিজেকে মুক্ত করুন। ইলিশের প্রজনন ও বৃদ্ধির কালে জাটকা ধরে খাওয়া অশিক্ষিত, পরিবেশ ও প্রকৃতি বিরোধী অমানবিক গোষ্ঠির কাজ।

লিখেছেন: ১৪ এপ্রিল ২০২২ ইং।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *