বঙ্গ বা বাংলা নামের উৎপত্তি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। একদলের মতে বঙ্গ নামের সঙ্গে ‘আল’ যুক্ত হয়ে বঙ্গাল বা বাংলা হয়েছে। আরেক দলের মতে ‘বঙ্গাল’ দেশের নাম হতেই বাংলা নামকরণ হয়েছে। এ দুই দলের কারও মতকেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তবে তাঁদের বিশ্লেষণ এবং গ্রহণযোগ্য মত নিয়ে আলোচনা করার আগে এ সম্পর্কে যেসব ধর্মীয় মতাদর্শ রয়েছে, তা দেখা যাক।
আমরা ‘বঙ্গ’ নামের উৎস খুঁজে দেখতে পারি। বঙ্গ নামের উৎস বিষয়ে মহাভারত, হরিবংশ, ঋগ্বেদ, পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে এক বিচিত্র কাহিনির অবতারণা করা হয়েছে। কাহিনিটি এমন : উত্তর ভারতে দীর্ঘতমা নামে এক অন্ধ ঋষি ছিলেন। তার কিঞ্চিৎ চরিত্র দোষ ছিল। এই ঋষি শ্রেণি এবং মর্যাদা নির্বিশেষে সকল রমণীর সঙ্গেই মিলিত হতেন। তাই তার সন্তানদের সংখ্যাও ছিল অগণিত। বর্ণিত আছে, এই ঋষি তার আপন সন্তানদের কন্যা সন্তানের সঙ্গেও মিলিত হতেন। ফলে এক পর্যায়ে তিনি সকলের অভাজনে পরিণত হন। তিনি ঋষি। তাকে হত্যা করতেও সবাই কুণ্ঠিত। কী করা যায়। বুদ্ধি এল, ঋষিকে ‘মা গঙ্গার’ হাতে সঁপে দেওয়াই যৌক্তিক। ঋষির বিষয়ে সিদ্ধান্ত ‘মা গঙ্গা’-ই নিক। সবাই মিলে দীর্ঘতমা ঋষিকে বাক্সে বেঁধে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিল। গঙ্গাজলে ভাসতে-ভাসতে ‘দীর্ঘতমা’ এ অঞ্চলে অনার্য বলিরাজের রাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন। বলিরাজ বার্ধক্যে উপনীত। কিন্তু নিঃসন্তান। ঋষি দীর্ঘতমার করুণ দশা দেখে বলিরাজ তাকে ডাঙায় তুলে আনলেন। ঋষির কাছে বলিরাজ নিজের দুঃখের কাহিনি শোনান। বলিরাজ তার বংশ রক্ষা এবং রাজ্যের চিন্তায় ব্যাকুল। দীর্ঘতমা ঋষিকে তিনি এই সমস্যা থেকে উদ্ধারের জন্য আবেদন জানান। ঋষি আপন মনে খুশি হলেন। যে ‘দোষে’ তার আপন সন্তানেরা তাকে গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দিলো, এখন বলিরাজ তাকে সেই কাজের জন্য আবেদন করছে। কার্যত বলিরাজ ঋষি দীর্ঘতমাকে আপন স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে সন্তান উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করেন। দীর্ঘতমা ঋষি উপযুক্ত বটে। সুদেষ্ণার গর্ভে তিনি পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিলেন। এই সন্তানদের বলে ‘ক্ষেত্রজ পুত্র’। এই ক্ষেত্রজ পাঁচটি পুত্র সন্তানের নাম রাখা হয় : অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র, সূক্ষ্ম। এই পাঁচ সন্তানকে একটি করে রাজ্য দেওয়া হয় এবং তাদের নামেই রাজ্যের নামকরণ করা হয়। বঙ্গকে আমাদের অঞ্চল দেওয়া হয়েছিল। তাই এ জনপদের নাম বঙ্গ হয়।
উপরোক্ত বক্তব্যে দেখতে পাই, দীর্ঘতমা ঋষি অনার্য বলিরাজের রাজ্যে অর্থাৎ এ অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। বলিরাজের কোনো রাজ্য এ অঞ্চলে ছিল তার কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। তাছাড়া মহাভারতের কাহিনি পৌরাণিক কাহিনি, যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। মহাভারতের এ বক্তব্যটি এ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়েছিল। মহাভারতের ও অন্যান্য গ্রন্থের রচনাকাল খ্রিষ্ট জন্মের পূর্বের এক হাজার বছরের মধ্যে বলে অধিকাংশ পণ্ডিত অনুমান করেন। খ্রিষ্ট জন্মের কয়েক হাজার বছর আগেও এ অঞ্চলে মানুষের বসবাস ছিল। আর্যরা ভারতে আসার পূর্ব থেকেই এ অঞ্চলের মানুষেরা একটি সভ্য জাতি হিসেবে বিদ্যমান ছিল। এইসব গ্রন্থ রচনার অনেক আগেই এ ভূখণ্ডে কৌম সমাজ ও কৌম চেতনার বিকাশ ঘটেছিল, তা নিশ্চিত। আর্যরা সারা উত্তর ভারত সহজেই দখল করতে পারলেও অসীম সাহসী মানুষদের এ অঞ্চল বহুদিন দখল করতে না পেরে এখানকার মানুষদেরকে ম্লেচ্ছ, অসুর, ভ্রষ্টা ইত্যাদি বলে নিন্দা করত।। এ অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রতি আর্য ঋষিদের অবজ্ঞা ছিল বলেই এ ধরনের কাহিনির অবতারণা করা হয়েছে। বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি ভারতীয় আর্যদের আমলে নয়। আর্যদের আসার বহু আগেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে উপমহাদেশের এ অঞ্চলে বঙ্গ নামের একটি জনপদ ছিল।
বঙ্গ শব্দের উৎপত্তির দ্বিতীয় তত্ত্বটি বহুল পরিচিত নয়। এতে বলা হয়েছে, হজরত নূহ (আ.)-এর সময়ে বিশ্বব্যাপী এক মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়। মহাপ্লাবন এখন থেকে সাড়ে সাত হাজার বছর পূর্বে ঘটেছে বলে কেউ-কেউ দাবি করেন। সেই মহাপ্লাবন থেকে এই উপমহাদেশও বাদ যায়নি। সেইসময় বিশ্বাসীর সংখ্যা কারও মতে ৮৫, কারও মতে ১৬০ জন ছিল। সেই মহাপ্লাবনে বিশ্বাসীদের বাইরের সকল মানুষ মারা যায়। প্লাবনের পর হযরত নূহ (আ.)-এর ইচ্ছানুযায়ী এই বিশ্বাসীরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। যেসব অঞ্চলে তারা বসতি স্থাপন করেন, তাদের নামানুসারেই সেসব অঞ্চলের নামকরণ করা হয়। কার্যত এভাবেই পৃথিবীতে দ্বিতীয় দফায় মানবজাতির বিস্তার ঘটে। স্পষ্টতই আধুনিক বিশ্বের মানবগোষ্ঠী তাদের বংশধর। হজরত নূহ্ (আ.)-এর এক পুত্রের নাম ছিল হাম। হামের পুত্র হিন্দ। হিন্দের দ্বিতীয় পুত্রের নাম বং। এবং বং-এর সন্তানেরা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করায় এই জনপদ বঙ্গ নামে পরিচিত হয়। বং-এর বংশধারা এই অঞ্চলকে বাসযোগ্য ও সুন্দর করেন এবং তারা এই দেশ শাসন করেন।
মহাভারতের কাহিনির চেয়ে এ তত্ত্ব অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হলেও নৃবিজ্ঞানের গবেষণায় এটাও টিকে না। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কোনো এক বংশের মানুষ এ অঞ্চলের অধিবাসী নয়। হিন্দুস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের থেকেও এ অঞ্চলের মানুষের পার্থক্য বিদ্যমান। আদিম অস্ট্রিক জাতি থেকে উদ্ভব এ জাতি পরবর্তীতে দ্রাবিড়, মঙ্গোল, আর্য, শক, হুন, পারসিক, তুর্কি, আফগান, আরব, মুঘল, পর্তুগিজ ও অন্যান্য জাতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। এতবড়ো সংকর জাতি পৃথিবীতে বিরল। ভারতের অন্যান্য সকল অঞ্চলের অধিবাসীদের উৎপত্তি অস্ট্রিক জাতি থেকে নয়।
আইন-ই-আকবরীর লেখক আবুল ফজল দাবি করেন, এই দেশের প্রাচীন নাম ছিল বঙ্গ; প্রাচীনকালে বন্যার পানি হতে রক্ষার জন্য এখানকার রাজারা ১০ গজ উঁচু ও ২০ গজ বিস্তৃত প্রকাণ্ড ‘আল’ নির্মাণ করতেন–এ থেকেই ‘বাঙ্গাল’ এবং ‘বাঙ্গালা’ নামের উৎপত্তি। গোলাম হোসেন সলিল লিখেছেন, ‘আদিতে বাংলার নাম ছিল বং। এর সঙ্গে ‘আল’ শব্দ যোগ হওয়ার কারণ হচ্ছে, বাংলা ভাষায় ‘আল’ অর্থ বাঁধ। বন্যার পানি যাতে বাগানে বা আবাদি জমিতে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য জমির চারদিকে বাঁধ দেওয়া হতো। প্রাচীনকালে বাংলার প্রধানেরা পাহাড়ের পাদদেশে নিচু জমিতে ১০ হাত উঁচু, ২০ হাত চওড়া স্তুপ তৈরি করে তার উপরে বাড়ি নির্মাণ ও চাষাবাদ করতেন। লোকগুলোকে বলত বাঙ্গালা।’
এ ব্যাখ্যাগুলোও খুব যৌক্তিক মনে হয় না। প্রথমত, বঙ্গ শব্দের উৎপত্তি নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ খুব বেশি দিনের নয়। ‘আল’ শব্দটি অস্ট্রিক বা দ্রাবিড় ভাষায় ছিল কিনা তা বুঝা যায় না। থাকলেও সে ‘আল’ শব্দের অর্থ কি ছিল তাও একটি প্রশ্ন। ‘আল’ সংস্কৃত ভাষায় ‘আলি’ এবং পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় ‘আইল’। যা বঙ্গের সঙ্গে যোগ করলে বঙ্গাল বা বাঙ্গাল হয় না। উল্লেখ্য যে, বঙ্গাল দেশের নাম হতেই যে কালক্রমে বাংলা নামের উৎপত্তি এতে কারও দ্বিমত নেই।
আমরা বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। দ্রাবিড় ভাষীরা উপমহাদেশের সিন্ধু অঞ্চলে এবং অস্ট্রিক ভাষীরা বার্মা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বাংলার বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। সিন্ধু অঞ্চল থেকে দ্রাবিড়রা গুজরাট, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, উড়িষ্যা হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে আসাম পর্যন্ত চলে যায়।
অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে এখানে এক নতুন জাতি। এই মানবগোষ্ঠীই আমাদের আদি পূর্বপুরুষ। এরপর আফগানিস্তানের পথ ধরে আর্যরা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে মঙ্গোলীয়রা ভারতে প্রবেশ করে। বাঙালির প্রতিদিনের আচরণে অস্টিক-দ্রাবিড়-মঙ্গোল প্রভাব সবথেকে বেশি। অস্ট্রিক-দ্রাবিড়রা তখন নিম্নাঞ্চলে সমভূমিতে কিছু-কিছু বসবাস শুরু করেছে। আর্যরা আফগানিস্তানের পথ ধরে ভারতে প্রবেশ করলেও আমাদের এ অঞ্চলে তারা বহুদিন আসেনি। আগেই বলেছি, এ অঞ্চলের মানুষকে আর্য ঋষিরা ঘৃণার চোখে দেখত এবং ম্লেচ্ছ, অসুর, পাপী, অনাচারী, ভ্রষ্টা ইত্যাদি বলে নিন্দা করত। মঙ্গোলরা আর্যদের আগেই তিব্বত হয়ে এখানে আসে। কোনো-কোনো মঙ্গোল পার্বত্য জাতি বাংলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অর্থাৎ যেখানে সেদিন বেশিরভাগ মানুষ বসবাস করত সেখানেই বসতি স্থাপন করে।
তিব্বত ভাষায় ‘বং’ শব্দের অর্থ হলো জলাভূমি। কাজেই বাংলার এই জলাভূমি অঞ্চলকেই মঙ্গোলরা ‘বং’ বলত, এটাই স্বাভাবিক। সেমেটিক ভাষায় ‘আল’ অর্থ আওলাদ, সন্তান-সন্ততি বা বংশধর। কাজেই পরবর্তীতে এই জলাভূমিতে যারা বসবাস করত তাদেরকে (বং+আল) বঙ্গাল বলা হতো। আব্দুল করিম লিখেছেন, প্রাচীন লিপির ‘বঙ্গাল’ দ্বারা বঙ্গাল দেশ না বুঝিয়ে বঙ্গ-এর অধিবাসীদের বুঝানো হয়েছে এবং বঙ্গাল দেশ দ্বারা বঙ্গালদের দেশ বুঝানো হয়েছে (আব্দুল করিম, বঙ্গ-বাঙ্গালা বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ২৬)।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, আজকের বাংলা সেযুগে অনেকগুলো জনপদে বিভক্ত ছিল। মধ্যযুগে সুলতান ইলিয়াস শাহই (১৩৪২–১৩৫৮ খ্রি.) প্রথম বাঙালি অধ্যুষিত সকল অঞ্চলের সমন্বয়ে বাঙ্গালা বা বঙ্গ গঠন করেন। তিনিই মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসে প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা। তাঁর রাজত্বকালেই বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় হতেই বঙ্গের সকল অঞ্চলের অধিবাসী বাঙালি বলে পরিচিত হয় এবং বঙ্গের বাইরের দেশগুলোও তাদেরকে বাঙালি হিসেবে অভিহিত করতে থাকে।
এরপরের দীর্ঘ ইতিহাস, দিল্লির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার বা অর্জনের বহু রক্তক্ষয়ী ও সংগ্রামের ইতিহাস। তারপর ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীর হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কররানির পরাজয় ও নিহত হওয়ার মাধ্যমে দিল্লির নিকট বাংলার স্বাধীনতা লুপ্ত হয়। এরপর ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা বাংলা দখল করে নেয়। অবশেষে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি জাতির বৃহত্তম অংশ তাদের স্বাধীনতা ফিরে পায় এবং আজকের এই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।