» ইসকন : শুরুই হয়েছে জালিয়াতি দিয়ে

আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে নদীয়ার তদানীন্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কেদারনাথ দত্ত নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে এবং সরকারি নথিপত্রে বদল ঘটিয়ে মুসলমান অধ্যুষিত মিঞাপুরকে ‘মায়াপুর’-এ বদলে ফেলেন। শুধু তাই নয়, সুচতুরভাবে ওই মায়াপুরকে চৈতন্য জন্মস্থান বলে প্রচারও করতে থাকেন।

প্রামাণ্য নথি হিসেবে কেদারনাথ তুলে ধরেন প্রায় দেড়শো বছর আগে রচিত বৃন্দাবনবাসী নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’ গ্রন্থটিকে। ততদিনে চৈতন্যের জন্মভিটে গঙ্গাগর্ভে বিলীন। ফলে তিনি চৈতন্যকালীন নবদ্বীপের একটি কাল্পনিক চিত্র আঁকেন, চৈতন্য জন্মস্থানের নামকরণ করেন ‘মায়াপুর’ এবং তার চারদিকে নয়টি দ্বীপের কল্পনা করে ‘নবদ্বীপ’ নামের নতুন ব্যাখ্যা দেন।

চৈতন্য জন্মস্থান হিসেবে ‘মায়াপুর তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠা করতে কেদারনাথ দত্ত এই ‘ভক্তিরত্নাকর’-এর আশ্রয় নেন। চাকরি ছেড়ে তিনি ভক্তিবিনোদ ঠাকুর নামে সন্ন্যাসী হন। ১৯১৮-তে অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর তাঁর পুত্র ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী মায়াপুরে ‘শ্রীচৈতন্য মঠ’ স্থাপন করলে কেদারনাথের প্রচারে ভক্তিবাদের সরকারি সিলমোহর পড়ে।

এঁর শিষ্য অভয়চরণ দে ১৯৭২-এ মায়াপুরে চন্দ্রোদয় মন্দির নামে ইসকনের হেড অফিস বানান, একই সাথে চৈতন্য জন্মভূমির প্রচার তুঙ্গে ওঠে। প্রভুপাদ এসি ভক্তিবেদান্ত স্বামীর শ্বেতাঙ্গ শিষ্যশিষ্যাদের ঢালাও প্রণামীর দয়ায় কালে কালে চন্দ্রোদয় মন্দির চোখ ধাঁধানো হর্ম্যরাজির সমাহার হয়ে ওঠে।

যদিও ইসকন চৈতন্যকে নিয়ে নয়, কৃষ্ণকে নিয়ে ভাবিত। আসলে ভক্তদের থাকার ব্যবস্থা, তাদের খাওয়াদাওয়া এবং মন্দির সম্প্রসারণের জন্য ভক্তিবেদান্তর এমন বিস্তৃত জায়গার দরকার ছিল যা নবদ্বীপের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মিলত না। স্থান হিসেবে তাই মায়াপুরের নির্বাচন এবং চৈতন্য প্রসঙ্গটা সেখানে ফাউ হিসেবে বিবেচিত।

মায়াপুর এখন পুরোদস্তুর পর্যটনের জায়গা। দূরদূরান্ত থেকে অধিকাংশ পর্যটক এখানে আসেন গাড়ি পার্ক করে বনভোজন আর অপরিমিত মদ্যপানের টানে। তাঁদের কাছে চৈতন্যের জন্মস্থান বা চাঁদ কাজির সমাধি কিংবা বল্লালসেনের ঢিবির আলাদা কোনও আকর্ষণই নেই। তাঁরা চন্দ্রোদয় মন্দিরের বিশালত্বে মুগ্ধ হন, অপরিসীম বৈভব দেখে বিস্মিত হন এবং বিদেশি ‘প্রভু’ দর্শনে ধন্য হন। আর হুল্লোড়বাজির শেষে আদ্যোপান্ত ব্যবসায়িক মোড়কে ঢাকা এই মন্দিরের ছোটখাটো স্মারক কিনে ঘর সাজিয়ে গর্ব বোধ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *