» বানান ও উচ্চারণ, কে কার অনুগামী হবে?

প্রাবন্ধিক :

উচ্চারণ অভিধানগুলোতে ব্যঞ্জনবর্ণের লুপ্ত অ-কে ও দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, বানান থেকে হসন্ত বিলুপ্ত করার প্রয়াসেই এই নূতন সমস্যার সৃষ্টি।

সকলেই জানে ব্যঞ্জন বর্ণের মধ্যে একটি অ ধ্বনি থাকে। যেমন ক্+অ=ক। আমরা কি কখনো ক-কে কো উচ্চারণ করি? তাহলে অঙ্ক বা অর্ক উচ্চারণ করতে অং+কো বা অর্+কো কেন?

স্বাভাবিক নিয়ম হল, হসন্ত (্) থাকলে ব্যঞ্জন শেষের উচ্চারণ হবে না। আর হসন্ত না থাকলে অ উচ্চারণ হবে। তাহলে যেখানে উচ্চারণের সমস্যা হতে পারে সেখানে হসন্তের ব্যবহার করলেই হয়। কিন্তু তা না করে শব্দের শেষ বর্ণে ও-কারের বোঝা চাপান হল!

আমি হল, চাপান দুটি শব্দ লিখেছি! এগুলোর উচ্চারণ হল্অ, চাপান্অ। যদি হল্ (hall), চাপান্ লিখি তবে শব্দের শেষে অ উচ্চারণ হবে না। কিন্তু হল কী? হসন্ত ব্যবহার এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দেওয়া হল, আর ছিল, করল, ধরল, বলল ইত্যাদিকে ছিলো, করলো, ধরলো, বললো বানান হল। এতে সুবিধাও একটা হয়েছে—পশ্চিমী ও-কারের প্রভাব পূর্বেও বিস্তার লাভ করেছে।

অন্য একটি সমস্যাও ছিল। যেমন ধরল কেমন উচ্চারণ হবে? ধর্ ল না ধ র ল। শব্দটি মূলে ছিল ধরিল— ধর্-ইল। তার মানে র বর্ণে অ নেই। তাই ধর্ ল। এটাই সঠিক। এটাকে স্বচ্ছত্ব দিতে গিয়ে করা হল ধরলো—মানে শেষের অ-টি ও হয়ে গেল। তাহলে ধ-এর অ কী দোষ করল? শব্দটি ধোরলো হল না কেন?

রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রের পুরান ছাপার বই গুলোতে হোলো, কোরলো বানান পাওয়া যায়, এটা পশ্চিমী উচ্চারণের ধরণ! পূর্বী উচ্চারণ করল, হল— বানান ও উচ্চারণের নিদান দাতারা সমন্বয় করলেন— একই শব্দের আধা পূর্বী, আধা পশ্চিমী করে নতুন শৈলী তৈরি করল।

পূর্বী যারা পশ্চিমী বানান ও উচ্চারণকে অস্বীকার করে পূর্বী ভাষার প্রচলন করতে লেখ্য ভাষায় খাইতাছি, যাইতাছির চালু করেছিল, তাদেরও হৃদয় শীতল হল।

ভাষায় গুরুচণ্ডালী বলে একটা দোষ ছিল এককালে—সাধু-চলিত মিশ্রণ করার নাম গুরুচণ্ডালী। সে বলল, আমি খাইতাছি; খাইয়া যাইতাছি। বাক্য গুলো সাধু ভাষায় কেমন হবে? সে বলিল, আমি খাইতেছি; খাইয়া যাইতেছি। তেছি-কে তাছি-তে রূপান্তর করে বলাই হল পূর্বী বাঙালীর উচ্চারণ। কিন্তু বলিল-কে বইল্‌ল উচ্চারণ করলেই আবার আঞ্চলিকতার আখ্যা দেওয়া হয়।

মূলত, কোন জীবিত ভাষার বানান ও উচ্চারণকে সূত্রে নির্দিষ্ট করা বড় জটিল কাজ। আর এই জটিলতাকে প্রশ্রয় যোগায় বানানকে উচ্চারণানুগ করার চিন্তা। এই জটিলতাকে সহজ করার উপায় হচ্ছে, বানান উচ্চারণের মত হবে না বরং উচ্চারণ বানানের মত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *