বুতান এসে বলল, ‘জান দাদু, আমার বাংলা লিখতে গেলে অনেক বানান ভুল হয়। ঠিক করব কীভাবে? সব বানানই কি মুখস্থ করে রাখব?’
বুঝলাম যে আজ স্কুলে নিশ্চয়ই বানান ভুলের জন্য বাবু বকুনি খেয়েছেন। একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, ‘সব বানান কি মুখস্থ করে রাখা যায়? কোন বানান নিয়ে খটকা থাকলে অভিধান দেখে নিতে হয়।’
– কিন্তু অভিধান কি সব সময় হাতের কাছে পাওয়া যায়?
– তাহলে কিছু বানানের নিয়ম শিখে রাখ। তাহলেও অনেক বানান ভুল থেকে মুক্তি পাবি। আর ব্যাকরণের সব নিয়মই যদি শিখে রাখিস তাহলে তো আর কথাই নেই।
– বানানেরও নিয়ম আছে বুঝি! নিয়মগুলো একটু বলে দাও না, তাহলেই আমার আর কোন বানান ভুল হবে না।
– সব নিয়ম তোকে এখনই বললে তুই সবটা বুঝতে পারবি না। তবে কিছু নিয়ম তোকে এখনই বলে দেওয়া যায়। যেমন, সন্ধির নিয়ম।
– সন্ধির নিয়ম! সে তো বড্ড কঠিন। অনেক সংস্কৃত মন্ত্র জানতে হবে।
– মানে?
– ওই যে দুর্গাপুজোর সময় সন্ধিপুজো হয়, তখন তো দেখেছি পুরোহিত মশাই কত কঠিন কঠিন মন্ত্র বলেন।
– আরে না না। এ সন্ধি সে সন্ধি নয়। সে সন্ধি হল দুই তিথির মিলন। আর আমি যে সন্ধির কথা বলছি তা কিন্তু আলাদা।
– ও! বুঝেছি। দুই পক্ষের যুদ্ধের পর যেমন সন্ধি হয়। বাবা মায়ের ঝগড়ার পর যেমন সমঝোতা হয়।
– পাকামি করিস না। এ সন্ধি হল দুটো বর্ণ মিশে যাওয়া।
মান্তু কোথা থেকে দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির। বুতান আর মান্তু হল পিঠোপিঠি ভাই বোন। সন্ধি শব্দটা বোধ হয় ওর কানে গিয়েছে। সে বলল, ‘না, দাদার সঙ্গে কোন সন্ধি নয়। ও সুযোগ পেলেই আমাকে মারে।’
– আর তুই যখন আমার চুল ধরে টানিস।
– আজ্ঞে না মহাশয়। আমি কখনও ও রকম অসভ্যতা করি না।
আমার মনে হল আবার না দুটোতে লেগে যায়। ওদের দুজনের ভাবও যত আবার ঝগড়াও তত। ওদের দুজনকেই থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘তোরা দুজনেই মন দিয়ে শোন। এ এক অন্য সন্ধি। এ ব্যাকরণের সন্ধি। মান্তু হয়তো এখনই সব বুঝতে পারবি না তবু তুইও শুনে রাখ। পরে তোরও কাজে লাগবে।
এই যে মান্তু বলল ‘মহাশয়’, এই শব্দটাকে ভেঙে তোরা দুটো শব্দ বের করতে পারবি?
– মহাশয় তো একটাই শব্দ। এর ভেতরেও দুটো শব্দ আছে নাকি? – বুতান জানতে চায়।
– আছে বৈকি।
মান্তু বলল, ‘দিনরাত তো আমার পিছনে লেগে থাকিস, তুই আর কী বুঝবি?
আমি বললাম, ‘আচ্ছা, তোরা কি দুটোতে শুধু ঝগড়াই করবি? এই যে মান্তু বলল ‘দিনরাত’ এই শব্দ থেকে দুটো শব্দ বের করতে পারবি?
দুজনেই এক সঙ্গে বলে উঠল, ‘কেন পারব না? দিন আর রাত।
– ঠিক। এটা এত সহজে পারলি তার কারণ এই দুটো শব্দে কোন সন্ধি হয়নি। শব্দ দুটো তাদের নিজেদের চেহারা বজায় রেখেছে। কিন্তু ‘মহাশয়’ শব্দটা যেহেতু দুটো শব্দে সন্ধি করে তৈরি হয়েছে তাই শব্দ দুটোকে আলাদা করতে পারছিস না। ঠিক আছে, ‘মহাশয়’ শব্দটার আগে অন্য একটা শব্দ নিয়ে আলোচনা করি। বুতান, তুই কি লক্ষ করেছিস মান্তুর স্কুলের দিদিমণি ওর হাতের লেখা দেখে প্রশংসা করে লিখেছেন ‘সুন্দর হস্তাক্ষর’। এই ‘হস্তাক্ষর’ শব্দের মানে কী?
– হাতের লেখা। – মান্তুর চটজলদি জবাব।
– ঠিক। কিন্তু এই শব্দটার মধ্যে দুটো শব্দ লুকিয়ে আছে। ‘হস্ত’ আর ‘অক্ষর’। আর ‘হস্ত’ শব্দটার শেষে একটা ‘অ’ আছে। তার মানে এই শব্দটা অ-কারান্ত। আবার ‘অক্ষর’ শব্দের প্রথম বর্ণটা’ অ’। তাই সংস্কৃত সন্ধির নিয়মে এই দুটো ‘অ’ মিলে ‘আ’ হয়েছে আর সেই ‘আ’ প্রথম শব্দটার পরে যোগ হয়েছে। সন্ধি ব্যাপারটাই তাই। দুটো পাশাপাশি বর্ণ খুব তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করলে অনেক সময়ই দুইয়ে মিলে অন্য একটা বর্ণ তৈরি করে।
বুতান আর মান্তু দুজনেই ওই দুটো শব্দ খুব তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করার চেষ্টা করল। মান্তু বলল, ‘কোথায় দাদু? খুব তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করলেও তো ‘আ’ আসছে না। বরং কেমন যেন’ হস্তোক্ষর’ হয়ে যাচ্ছে।’
– বাঃ! ঠিক ধরেছিস তো। আসলে কি জানিস, ওই যে তোদের বললাম দুটো ‘অ’ মিলে ‘আ’ হয়ে যায়, ওটা সংস্কৃতের নিয়ম। আমরা বাঙালিরা যেভাবে ‘অ’ উচ্চারণ করি সংস্কৃততে সেভাবে উচ্চারণ করা হয় না। সংস্কৃত, হিন্দি বা আরও অনেক ভাষাতেই ‘অ’ বর্ণটাকে একটু হালকা ‘আ’ উচ্চারণ করা হয়। আমরা কিন্তু উচ্চারণ করি ‘হস্তো’ আর ‘ওক্ষোর’।
– সেকি! ‘অ’ কে ওরা ‘অ’ বলে না! কেন দাদু? – বুতান জানতে চায়।
– আচ্ছা, তোদের একটা উদাহরণ দিই। তোদের সবচেয়ে প্রিয় ক্রিকেটার কে?
দুজনেই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সাচিন, সাচিন’।
– দেখ তোরা দুজনেই বললি ‘সাচিন’, কিন্তু ওর নাম তো ‘সাচিন’ নয়। ওর নাম শচীন। ওরা শচীনের ‘শ’ উচ্চারণ করে ‘সা’, আর আমরা বলি ‘শো’। এই উচ্চারণের ব্যাপারটা তোদের পরে কোন এক সময় বোঝাব। তবে এখন ‘হস্ত’ শব্দটাকে ‘হস্তা’ উচ্চারণ করে তারপর ‘অক্ষর’ শব্দটা তাড়াতাড়ি বলে দেখ ওই দুটো শব্দ মিলে ‘হস্তাক্ষর’ হয়ে গেছে।
ওরা কিছুক্ষণ ওই শব্দ দুটো আওড়ে বলল, ‘ঠিক বলেছ তো।’
তাহলে বুঝলি তো যে আগের শব্দের শেষে যদি ‘অ’ থাকে আর পরের শব্দের প্রথম বর্ণটি যদি ‘অ’ হয় তবে এই দুই ‘অ’ মিলে গিয়ে ‘আ’ হয়ে যায় আর এই আ-কার প্রথম শব্দের শেষে যোগ হয়। এবার তোরা এই ধরণের যত শব্দ তোদের মনে পড়ে সেগুলো লিখে রাখ। আমি কাল সেগুলো দেখব।
অ + আ = আ
বুতান এসে বলল, ‘তুমি তো আমাদের শিখিয়েছ যে একটা শব্দের শেষে ‘অ’ থাকলে আর তার পরের শব্দের গোড়ায় ‘অ’ থাকলে দুটো মিলে ‘আ’ হয়ে যায়।
– হ্যাঁ, বলেছি তো।
– তাহলে এই যে এই বইটাতে লেখা ‘দগ্ধানন’, এই শব্দে আ-কার এল কোথা থেকে?
– আচ্ছা বলতো এই শব্দটার মানে কী?
– এ তো খুব সোজা। দগ্ধ নন। মানে পোড়েনি। হনুমান সম্বন্ধে এটা বলা হয়েছে। মানে তার লেজের আগুনে লঙ্কা পুড়ে গেলেও সে পোড়েনি। কিন্তু মাঝে ভুল করে একটা আ-কার দিয়ে দিয়েছে।
– তোর মাথা। ছাপার অক্ষরে অনেক সময় অনেক ভুল থাকলেও এই বানানটা ঠিকই আছে। এর মধ্যেও দুটো শব্দ আছে। ‘দগ্ধ’ আর ‘আনন’। আর এখানে এই দুই শব্দের সন্ধি হয়েছে।
– আনন শব্দের মানে কী, দাদু? – মান্তু জানতে চায়।
– আনন মানে মুখ।
– কিন্তু দাদু, বদন মানে তো মুখ। দিদা তো আমাকে প্রায়ই বলে চাঁদবদনী।
– চাঁদবদনী না ঘণ্টা। তুই শাঁকচুন্নি। – বুতান বলে।
– থাম তোরা। হ্যাঁ, সংস্কৃত বদন মানে মুখ। আবার ফারসি থেকে যে বদন শব্দটি বাংলায় এসেছে তার মানে কিন্তু শরীর।
– এ তো ভারি মজা। বদন মানে মুখ আবার বদন মানে শরীর।
– হ্যাঁ, এ রকম তো হয়। ধর তোকে যদি বলি তোর চেহারাটা এত খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন? তখন চেহারা মানে শরীর। আবার হিন্দিতে একটা চেহারা আছে যার মানে মুখ। সে কথা যাক, তাহলে দগ্ধ আনন বা দগ্ধানন মানে কী দাঁড়াল?
– পোড়া মুখ। – এবার আর বুতান কোন ভুল করে না।
– হ্যাঁ, তবে জেনে রাখ যে লেজের আগুনে হনুমানের মুখটা কিন্তু পুড়ে গিয়েছিল তাই তাকে দগ্ধানন বলাই যায়।
– ও, তার মানে দিদা যখন দাদাকে পোড়া মুখো বলে তখন দিদা ওকে হনুমান বলে? ‘দগ্ধানন’, ‘দগ্ধানন’।
– তুই তো কাঁদুনে বুড়ি। তুই প্যাঁচানন।
– আর তুই বাঁদরানন।
– ওরে থাম থাম। কী শুরু করলি তোরা? এই যে তোরা দুজনেই বললি ‘প্যাঁচানন’, ‘বাঁদরানন’ এই শব্দগুলো তোরা কোথায় পেলি?
– কেন সন্ধি করলাম। বাঁদর আর আনন এই দুয়ে মিলে বাঁদরানন। – মান্তু পিছু হঠতে নারাজ।
– না। তোর এই সন্ধির উদাহরণটা ঠিক হল না। বাঁদরানন শব্দটা ভুল।
বুতান বলল, ‘তার মানে দশটা মুখ আছে তাই রাবণের নাম দশানন? এখানে বুঝি দশ আর আনন শব্দে সন্ধি হয়েছে।
– ঠিক বলেছিস। যেমন ধর আর একটা শব্দ পঞ্চানন মানে পাঁচ মুখ।
– বাজার যাবার রাস্তায় পঞ্চাননতলায় পঞ্চানন মন্দির আছে। – বুতান বলে।
– তার মানে কি দাদু এগারো, বারো, তেরো যে কোন সংখ্যার সঙ্গে আনন শব্দ জুড়ে যেতে পারে? – মান্তু জিজ্ঞেস করে।
তোদের আগেই বলেছিলাম যে সন্ধি হবে সংস্কৃত নিয়মানুযায়ী। এর একটা শর্ত শব্দ দুটো হতে হবে তৎসম। তৎসম শব্দ কাকে বলে জানিস তো? পরে কোন এক দিন এই শব্দের ব্যাপারে বলব। এখন জেনে রাখ যে সংস্কৃত থেকে সরাসরি তার রূপ না বদলে যে শব্দ বাংলায় এসেছে তাই তৎসম শব্দ। বাঁদর শব্দ কিন্তু সংস্কৃত অর্থাৎ তৎসম শব্দ নয় তাই এ সন্ধি হবে না। বরং শাখামৃগানন হতে পারে। শাখামৃগ মানে বাঁদর। আর সেই একই কারণে ‘প্যাঁচানন’ও হবে না, আবার ‘পাঁচানন’ও হবে না। তোরা বরং বলতে পারিস রাজা রাজার সঙ্গেই সন্ধি করবে অন্য কারও সঙ্গে নয়। ঠিক এই জন্যই ‘চাঁদ + আনন = চাঁদানন’ হবে না তবে চন্দ্রানন বা চন্দ্রাননা হতে পারে। চন্দ্রানন স্ত্রী লিঙ্গে চন্দ্রাননা। বুতান, তুই যে মান্তুকে বললি প্যাঁচানন, এই শব্দটা যদি ঠিকও হত তবু মান্তুকে তা বলা যাবে না কারণ আনন শব্দটা আমরা ব্যবহার করি ছেলেদের বেলায়। মেয়েদের বললে বলব’ আননা’। যেমন মান্তুর চাঁদের মত মুখ বলতে হলে বলতে হবে ‘চন্দ্রাননা’। মনে রাখিস অ+অ যেমন ‘আ’, তেমনি ‘অ’ এর সঙ্গে ‘আ’ এর সন্ধি হলেও ‘আ’ আসবে আর প্রথম শব্দের শেষে একটা আ-কার জুড়ে যাবে। তবে তৎসম শব্দ হওয়া চাই কিন্তু।
মান্তু সব কিছুই হাতে কলমে করে দেখতে চায়। সে বলতে শুরু করে ‘অআ’ ‘অআ’। তারপর বলে, ‘কোথায় দাদু, এ তো ‘অওয়া’ হয়ে যাচ্ছে।
– এখানেও ওই সংস্কৃত উচ্চারণের জন্যই সন্ধি হচ্ছে। ‘দগ্ধা’ আর’ আনন’ তাড়াতাড়ি উচ্চারণ করে দেখ ‘দগ্ধানন’ হয়ে যাবে। অবশ্য বাংলা উচ্চারণে তা হয় না। বাংলা উচ্চারণে হয়ে যাবে’ দগ্ধোয়ানন’ তাই তো রবি ঠাকুর লিখে গেছেন, “ছোট খোকা বলে অ, আ / শেখেনি সে কথা কওয়া।
এখন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। স্কুলের সময় প্রায় হয়ে এল।
রিপোর্ট কার্ড নিয়ে বুতান দৌড়তে দৌড়তে এসে বলল, ‘দাদু, ক্লাস টিচার বলেছেন এবার আমি আশাতীত ভাল ফল করেছি।’
– আশাতীত মানে কীরে দাদা? তোর আশা কি এবার তিত মানে তেতো হয়ে গেছে?
– দূর বোকা আশাতীত মানে খুব ভাল। তাই না দাদু?
– হ্যাঁরে আশাতীত মানে যে খুব ভাল তা তুই বুঝলি কী করে?
– কেন, আমার টিচার তো তাই বললেন। কেন দাদু, আশাতীত মানে কি ভাল নয়?
– আমি সেকথা বলছি না। আমি জানতে চাইছি আশাতীত শব্দটাকে তুই ভাঙতে পারবি কিনা।
– সব শব্দই কি ভাঙা যায়, দাদু? – মান্তু জিজ্ঞাসু হয়।
– না, সব শব্দ অবশ্যই ভাঙা যায় না। কিন্তু শব্দটা যদি সন্ধি জাত শব্দ হয় অর্থাৎ দুটো শব্দে সন্ধি করে যদি একটা শব্দ তৈরি হয় তবে তা অবশ্যই ভাঙা যাবে।
– এই শব্দও কি সন্ধি করে তৈরি হয়েছে? কোন কোন শব্দ নিয়ে দাদু?
– ‘আশা’ আর ‘অতীত’।
– কিন্তু অতীত মানে তো আগেকার। আমরা তো পড়েছি অতীত কাল। – বুতানের সংশয় আর যায় না।
– ঠিক। অতীত মানে পূর্বের। আবার অতীত শব্দের আর একটা মানে হয়, ‘বাইরে’। যেমন, ‘ধারণাতীত’ মানে ধারণার বাইরে। তেমনি আশাতীত মানে যা আশা করা যায় না।
– তার মানে এখানে ‘আ’ আর ‘অ’ সন্ধি করে নিয়েছে আর শুধু ‘আ’ থেকে গেছে?
– ঠিক তাই। ‘হিমালয়’, ‘দেবালয়’, ‘সিংহাসন’ এই সব শব্দে যেমন প্রথম শব্দ অ-কারান্ত আর পরের শব্দের গোড়ায় আছে ‘আ’, এখানে আগে ‘আ’ পরে ‘অ’। আচ্ছা বুতান, তোদের যে কয়েকটা সন্ধির উদাহরণ লিখতে বলেছিলাম সেগুলো লিখেছিস?
– এই তো দেখ, ‘যম+ আলয় = যমালয়, কার্য + আলয় = কার্যালয়, কমল +আকর = কমলাকর, মেঘ + আলয় = মেঘালয়, অন + আচার = অনাচার, অন + আহার = অনাহার।
– সব কটা ঠিক লিখলেও শেষের দুটো মানে ‘অনাচার’ আর ‘অনাহার’ এই দুটো উদাহরণ ঠিক লিখিসনি।
– কেন দাদু, বাংলায় ‘অনাচার’, ‘অনাহার’ এসব শব্দ আছে তো।
– না, না, শব্দগুলো ঠিকই আছে তবে এগুলো স্বরসন্ধির উদাহরণ নয়। আচ্ছা, ‘অনাচার’, ‘অনাহার’ এ দুটো শব্দের সন্ধি বিচ্ছেদ করতে পারবি?
– কেন পারব না। অন + আচার, অন + আহার।
– হ্যাঁ, তবে এই অন্ শব্দটা অ-কারান্ত শব্দ নয়। অন্ লিখতে হলে ন-এ হসন্ত দিয়ে লিখতে হবে। ‘অন্’ শব্দ একটা নঞর্থক অব্যয়। এর মানে অভাব, অল্পতা বা বৈপরীত্য। এই যে বললাম যে হসন্ত দিয়ে লিখতে হবে, এই হসন্তও কিন্তু হস্+অন্ত।
– কিন্তু কীভাবে বোঝা যাবে যে এটা অ-কারান্ত শব্দ নয়। – বুতান নিঃসংশয় হতে চায়।
– ঠিক আছে। তুই আমাকে বল ‘অন্+অধিক’ কী হবে?
– ‘অনাধিক’ ।
– না, শব্দটা অনধিক। আ-কার নেই। এটা আমরা খেয়াল করি না। আর তাই বানান ভুল করি। এই রকম শব্দ আরও অনেক আছে। অন্+অধিকার = অনধিকার, অন্+অতি = অনতি, অন্+অধিক = অনধিক, অন্+অন্ত = অনন্ত, অন্+অর্থ = অনর্থ, অন্+অশন = অনশন, ইত্যাদি।
– অশন মানে কী দাদু? – মান্তুর প্রশ্ন।
– অশন মানে খাওয়া, ভোজন। তাই অনশন মানে না-খাওয়া।
– ও তাই অনেকে অনশন ধর্মঘট করে? মানে খায় না?
– ঠিক। এখন এই শব্দগুলো যদি স্বরসন্ধি করেই হত তবে অবশ্যই অনাহার, অনাচার এই সব শব্দের মত ‘অনাধিকার’, ‘অনাশন’ এই রকমই হত। কিন্তু এগুলো ব্যঞ্জনসন্ধি হওয়ায় তা হয়নি। যাই হোক, এই ধরণের সন্ধি নিয়ে পরে তোদের কোন একদিন বলব। তবে আজ আরও দু একটা কথা বলি। যদিও সন্ধি নয়, অন্য বিষয়ে। তবে এগুলো জানা থাকলেও তোদের অনেক সুবিধা হবে। এই যে বললাম ‘অন্’ একটা অব্যয় আর এই অব্যয় শব্দের আগে জুড়ে দিলে শব্দটার প্রচলিত মানেটাই উল্টে যায়, এই রকম আরও কোন উপসর্গের কথা তোরা বলতে পারিস?
– ‘সময়’ শব্দের আগে একটা ‘অ’ বসালেই অসময় মানে খারাপ সময় হয়ে যাবে। – বুতানের জবাব।
– বাঃ। ঠিক। আচ্ছা এবার আমাকে বল যে কখন ‘অ’ বসাবি আর কখন ‘অন্’ বসাবি?
– এরও কোন নিয়ম আছে নাকি? – মান্তু জিজ্ঞেস করে।
– সাধারণত স্বরবর্ণ দিয়ে শুরু হওয়া শব্দগুলোতে আমরা ‘অন্’ বসাই আর ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে শুরু হলে আমরা শব্দের আগে ‘অ’ যোগ করি। যেমন, অকারণ, অকরুণ, অসম্ভব, অন্যায়, অজর, অমর, অসত্য, এই সব। এই শব্দগুলো যেহেতু ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে শুরু তাই আমরা ‘অ’ বসিয়ে বিপরীত অর্থের শব্দ তৈরি করেছি। আবার অন্+ইচ্ছা = অনিচ্ছা, অন্+উপায়= অনুপায়, অন্+উপযোগী = অনুপযোগী , অন্+ঐক্য= অনৈক্য, ইত্যাদি। এছাড়াও কোন কোন সময় আমরা ‘নিঃ’ বা ‘বি’ এসবও লাগিয়ে নিই। আর বিদেশি শব্দে অনেক সময় ‘বে’ বসিয়েও বিপরীতার্থক শব্দ তৈরি করি।