ই, ঈ / উ, ঊ
শিরোনামটুকু পড়ে অনেকেরই ভুরু কুঁচকে যেতে পারে। অনেকেই ভাবতে পারেন যে জন্মের পর থেকেই তো বাংলা উচ্চারণ শুনে আসছি আর একটু বড় হয়ে যখন মুখে বুলি ফুটলো তখন থেকে তো বাংলা উচ্চারণই করে আসছি। আজ হঠাৎ এ নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হল কেন? ঝাড়খণ্ড থেকে রাঢ়, বঙ্গ, বরেন্দ্রভূম, সমতট হয়ে কামরূপ পর্যন্ত যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল সেখানকার বাসিন্দাদের মুখের ভাষা বাংলা। যদিও সেই ভাষা এক এক অঞ্চলের মানুষের মুখে এক এক রকম রূপ নিয়েছে।
না, আজকের আলোচনা অবশ্য এই প্রসঙ্গে নয়। আজকের আলোচনার মূল বিষয় হল বাংলা বর্ণমালায় যে কটি বর্ণ আছে তার প্রত্যেকটির উচ্চারণ (মান্য উচ্চারণ) বাংলায় আছে কি? অনেকেই বলবেন, না। আবার হয়তো কেউ কেউ বলবেন, উচ্চারণ অবশ্যই আছে আর সেই বর্ণটি কোথা থেকে উচ্চারিত হবে তার নির্দেশও দেওয়া আছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? আমরা কি ওই নির্দেশ অনুযায়ী সব কটি বর্ণ উচ্চারণ করি?
এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ছে দীর্ঘ স্বরগুলির কথা। সত্যিই কি ওই দীর্ঘ স্বর বাংলায় উচ্চারিত হয়? বিদ্যাসাগর অপ্রয়োজনীয় মনে করে বাংলা বর্ণমালা থেকে দীর্ঘ ঋ (ৠ) আর দীর্ঘ ৯ (ৡ) বাদ দিয়েছেন। আর আজও কোন কোন বাংলা বর্ণমালাতে ‘৯’-এর অস্তিত্ব আছে বটে কিন্তু তার ব্যবহার আছে কি? আমার নিজের ধারণা ‘৯-কার যেন ডিগবাজি খায়’ কথাটাই বোধ হয় সত্যি। ৯-কার বোধ হয় সত্যিই ডিগবাজি খেয়েছে। আর তাই তো রবীন্দ্রনাথ ৯-কে বর্ণমালা থেকে বাদ দিয়েছেন। ৯ দিয়ে কোন শব্দের কথা কি পাঠকদের মনে পড়ছে? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ‘৯চু’। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো যে ফলটার নাম ‘লিচু’ না লিখে ‘৯চু’ লেখেন কতজন। আমি স্বীকার করছি যে আমি কখনও লিখিনি।
যাই হোক, যে কথা বলছিলাম। যে দীর্ঘ স্বরগুলি বাংলা বর্ণমালাতে এখনও আছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে। হ্যাঁ, আমি দীর্ঘ ঈ আর দীর্ঘ ঊ-এর কথাই বলছি। আমরা কি সত্যিই এই দীর্ঘ স্বর দুটি উচ্চারণ করি? একটু দেখে নেওয়া যাক।
অনেকে বলেন ‘কি’ এবং ‘কী’ শব্দের উচ্চারণ আলাদা। প্রথমটা হ্রস্ব স্বর এবং সেই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এই ভাবে দেওয়া সম্ভব। আর দ্বিতীয়টা দীর্ঘ স্বর আর সেই প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এই ভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। লিখিত ভাবে প্রশ্নটি করলে অবশ্যই এটি ঠিক কিন্তু উচ্চারণের ক্ষেত্রে কী হবে? ধরুন কেউ বললেন, ‘তুমি কি খাবে?’ অর্থাৎ বক্তা জানতে চাইছেন আমি খাব কিনা। এর উত্তরে আমি যদি বলি, ‘হ্যাঁ’, তখন বক্তা আবার প্রশ্ন করতে পারেন, ‘তুমি কী খাবে?’ অর্থাৎ আমি কী খেতে পছন্দ করব। এখন এই বাক্য দুটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। দেখা যাবে প্রথম বাক্যের ‘কি’ এর তুলনায় দ্বিতীয় বাক্যের ‘কী’ দীর্ঘতর। তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি না যে বাংলায় দীর্ঘ স্বরের উচ্চারণ আছে? ব্যাপারটা কিন্তু এত সহজ সরল নয়। যদি একটু লক্ষ করি তাহলে দেখা যাবে যে প্রথম বাক্যে (তুমি কি খাবে?) ‘কি’ উচ্চারণে হ্রস্ব স্বর ব্যবহার হল বটে কিন্তু সেই সঙ্গে ‘খাবে’ শব্দের এ-কার দীর্ঘ হয়ে গেল। আবার অন্য দিকে দ্বিতীয় বাক্যে ‘কী’ শব্দের ই ধ্বনি দীর্ঘ হওয়ায় ‘খাবে’ শব্দের এ কিন্তু হ্রস্ব হয়ে গেছে।
এ শুধু ই, ঈ বা এ এই সব স্বরেই নয় অন্যান্য স্বরও বাক্যে ব্যবহারের সময় কখনও হ্রস্ব আবার কখনও দীর্ঘ হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে একটি বাক্য নেওয়া যাক। কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘আপনি যাবেন?’ অর্থাৎ প্রশ্নকর্তা জানতে চাইছেন, আমি যাব কিনা। আবার মনে করুন যে প্রশ্নকর্তা জানেন যে আমি যাব কিন্তু ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না তখন তিনি প্রশ্ন করতে পারেন, ‘আপনি যাবেন?’ আর এই ক্ষেত্রে ‘আপনি’ শব্দের ‘আ’ অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। অথচ আমরা তো সকলেই জানি যে দীর্ঘ ‘আ’ কখনও হয় না।
এ ছাড়াও একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় তা হল সাধারণভাবে প্রথম স্বরের তুলনায় পরবর্তী স্বর সামান্য দীর্ঘ হয়ে যায়। যদি উচ্চারণ করা হয় ‘আচার’ বা ‘আহার’ তাহলে দেখা যাবে যে শব্দের গোড়ার ‘আ’ ধ্বনির তুলনায় ‘চা’ বা ‘হা’-এর ‘আ’ ধ্বনি দীর্ঘ। আর সাধারণভাবে এমন হলেও স্বর হ্রস্ব হবে না দীর্ঘ হবে তা কোন শব্দের ওপর বক্তা জোর দিচ্ছেন তার ওপরেই নির্ভরশীল।
আরও লক্ষ করবেন যে ‘সুজন’ এবং ‘কূজন’ শব্দের উচ্চারণে সুজনের হ্রস্ব উ এবং কূজনের দীর্ঘ ঊ ধ্বনি দৈর্ঘ্যে সমান।
সব শেষে আর একটি কথা বলব যে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে বাংলায় ১০০টি স্বরধ্বনি উচ্চারিত হলে ‘ই’ ধ্বনি উচ্চারিত হয় ৬.৭৭ বার এবং ‘উ’ ধ্বনিটি উচ্চারিত হয় ৩.০৮ বার। এবং অন্যদিকে ফার্গুসন-মুনীর চৌধুরী জানিয়েছেন যথাক্রমে ৫.১৪ এবং ৩.৫৮ বার। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এঁরা কিন্তু কেউই বাংলায় দীর্ঘ ঈ বা দীর্ঘ ঊ ধ্বনির উচ্চারণ আছে বলে জানাননি। আর রবীন্দ্রনাথের মত তো আমরা সকলেই জানি। তিনি তৎসম শব্দ ছাড়া অন্যত্র দীর্ঘ স্বর লিখিত ভাবেও ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন না। বানান সংস্কারের অনেক আগে থেকেই তিনি ‘পাখি’, ‘শাড়ি’, ‘বাড়ি’, ইত্যাদি বানান লেখা শুরু করেছিলেন।
অ
অনেকেই বলেছেন যে বাংলা উচ্চারণ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে হলে ‘অ’ ধ্বনির উচ্চারণ দিয়েই তা করা প্রয়োজন। কথাটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণ ‘অ’ বর্ণটি আমাদের বর্ণমালার প্রথম বর্ণ।
আচ্ছা, এই ‘অ’ ধ্বনিটি কেমন? বাঙালিদের ‘অ’ উচ্চারণ অন্যান্য সকলের থেকে আলাদা। অবাঙালিরা ‘অ’ উচ্চারণ করে অনেকটা হালকা ‘আ’-এর মত করে। কিন্তু বাঙালিদের ‘অ’ উচ্চারণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম আর তাই বাঙালিদের উচ্চারণে স্বরসঙ্গতির প্রভাবও অনেক বেশি। শব্দের গোড়ায় হলে বাঙালিদের ‘অ’ ধ্বনি এক রকম, শব্দ মাঝে এক রকম আবার শব্দ শেষে তা সম্পূর্ণ অন্য ধ্বনি। আবার শব্দের গোড়ার ‘অ’ ধ্বনিও যে আমরা সবসময় একইভাবে উচ্চারণ করি তাও নয়।
বিষয়টা খুব কঠিন বলে মনে হচ্ছে? কয়েকটি শব্দ নিয়ে আলোচনা করা যাক। ‘কল’, ‘কলা’, ‘কলি’, ‘কলু’, ‘কলে’। লক্ষ করে দেখুন ‘কল’, ‘কলা’, ‘কলে’ শব্দে ‘ক’ একটি অ-কারান্ত শব্দ এবং এই ধ্বনিটিও অ-কারান্ত। কিন্তু ‘কলি’ বা ‘কলু’ শব্দে ‘ক’ কি আমরা একইভাবে উচ্চারণ করব? অবশ্যই না। কিন্তু কেন?
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ই’ আর ‘উ’ হল যত নষ্টের গোড়া। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে ‘অ’ বা অ-কারান্ত শব্দের পর’ ই’ বা ‘উ’ ধ্বনি এলে ‘অ’ বা অ-কারান্ত বর্ণটি ঈষৎ ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। আবার অনেক সময় তা হয় না। ‘অভিষেক’ আর ‘অনিকেত’ শব্দ দুটি উচ্চারণ করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এর কারণ কী? হ্যাঁ, নঞর্থক ‘অ’ শব্দের গোড়ায় থাকলে তারপর ‘ই’ বা ‘উ’ ধ্বনি এলেও গোড়ার ‘অ’ ও-কারান্ত হয় না তাই অভিষেক [ওভিশেক] উচ্চারণে গোড়ায় ‘ও’ এলেও অনিকেত শব্দে কিন্তু তা হবে না। আবার ঠিক সেভাবেই সহ অর্থে ‘স’ এর পর ই বা উ ধ্বনি এলেও ‘স’ ও-কারান্ত উচ্চারিত হবে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। সহিত শব্দটির উচ্চারণ [শোহিত] হলেও সঠিক শব্দের উচ্চারণ কিন্তু [শঠিক]।
‘অ’ ধ্বনির পর ই বা উ ধ্বনি থাকলে তার উচ্চারণ কেমন সেকথা তো বললাম কিন্তু এ ছাড়াও কখনও এমন হয় কি? অবশ্যই হয়। যেমন ধরুন ‘অ’ ধ্বনির পর যদি ‘ঋ’ বা ঋ-কার থাকে? দেখে নেওয়া যাক। মসৃণ শব্দ উচ্চারণ করলেও কিন্তু গোড়ার ম কিছুটা ও-কারান্ত হয়ে যাবে। এর উচ্চারণ হবে [মোস্-রিন]। কর্তব্য শব্দের উচ্চারণে ‘ক’ এর সঙ্গে ‘অ’ ধ্বনিটি অবিকৃত থাকলেও কর্তৃত্ব শব্দের উচ্চারণ কিন্তু [কোর্-ত্রিত্ব]। তবে এক্ষেত্রেও না-বাচক ‘অ’ বা সহ অর্থে ‘স’ আগে থাকলে সেই ‘অ’ বা ‘স’ অ-কারান্তই থাকবে। যেমন, অদৃশ্য, অকৃপণ, অকৃত্রিম, সদৃশ, সতৃপ্ত, সতৃষ্ণ, ইত্যাদি।
‘অ’ ধ্বনির পর য-ফলা যুক্ত কোন বর্ণ এলেও কিন্তু ‘অ’ ধ্বনিটি ও-কারান্ত হয়ে যাবে। যেমন, পথ্য [পোথ্থো], গদ্য [গোদ্দো], সন্ন্যাস [শোন্নাশ], বন্য [বোন্নো], ধন্য [ধোন্নো], সভ্য [শোভ্ভো] ইত্যাদি। আবার দেখুন পদ্ম [পদ্দোঁ] কিন্তু পদ্য [পোদ্দো], অন্ন [অন্নো] কিন্তু অন্য [ওন্নো], সত্ত্ব [শত্তো] কিন্তু সত্য [শোত্তো], ইত্যাদি। কারণ? ‘য’ বা ‘য-ফলা তো আসলে ‘ইয়’, তাই ওই ই ধ্বনিটির প্রভাবেই এমন উচ্চারণ।
আর কোথাও এমন হয় কি? ‘অ’ ধ্বনির পর ‘ক্ষ’ এলেও এমনটা কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘যক্ষ’ [যোক্-খো], ‘রক্ষ’ [রোক্-খো], ‘দক্ষ’ [দোক্-খো], ভক্ষক [ভোক্-খোক্], ইত্যাদি শব্দের উচ্চারণ লক্ষ্যণীয়। এর কারণ কী? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘ক্ষ’ বর্ণটিকে তো আমরা ‘খিঁয়ো’ বলি তাই হয়তো এর প্রভাবেই নাকি এমন উচ্চারণ।
এ ছাড়াও সম্ উপসর্গের পরবর্তী বর্ণে ই বা উ ধ্বনি এলে শব্দের গোড়ার ‘স’ ঈষৎ ও-কারান্ত হয়ে যায়। যেমন, সঙ্গীত, সন্ধি, সন্দিহান, সঞ্জীবনী, সঞ্চিত, ইত্যাদি। ব্যতিক্রম সংকীর্ণ বা সংকীর্তন, সম্মিলিত, সম্মুখ, ইত্যাদি।
আবার শব্দ মাঝে ‘অ’ ধ্বনির উচ্চারণ কী? সাধারণত শব্দ মাঝে ‘অ’ ধ্বনি ঈষৎ ও-কারান্ত হয়। পাগল, বাদল, চাদর, ভোঁদর, আদল, আদর, সদর এই শব্দগুলো উচ্চারণ করলেই দেখা যাবে যে শব্দগুলোর মাঝের অ-কারান্ত ধ্বনিগুলো কেমন ও ধ্বনি হয়ে যাচ্ছে।
আবার এরও ব্যতিক্রম আছে। আগে রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে বলেছিলাম ‘ই’ আর ‘উ’ যত নষ্টের গোড়া। এখানে দেখা যাবে যে আগে ‘ই’ বা ‘উ’ ধ্বনি থাকলে ঠিক তার পরের ‘অ’ ধ্বনিটির কোন বিকৃতি হচ্ছে না। ‘জীবন’, ‘ভীষণ’, ‘বিরল’, ‘কূজন’, ‘সুজন’ এই শব্দগুলো উচ্চারণেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ই বা উ ধ্বনির পর ‘অ’ ধ্বনি এলে তা ও-কারান্ত হবে না।
আর শব্দ শেষে ‘অ’ ধ্বনি কিন্তু বাংলায় নেই। তা হয় হস্ যুক্ত নয় ও-কারান্ত। আর শব্দ শেষে যুক্ত বা যুগ্ম বর্ণ থাকলে তা ব্যতিক্রমহীন ভাবে ও-কারান্ত।