» আরব্য রজনী : গাধা, বলদ ও বণিকের গল্প

অনুবাদক :

গাধা, বলদ ও বণিকের গল্প

যখন তার পিতা এই কথা শুনলেন, তিনি তাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার এবং রাজার মধ্যে যা ঘটেছিল তার সবই বললেন, যেখানে তিনি বললেন, ‘বাবা, আমাকে এই লোকটার সাথে বিয়ে দিন। হয় আমি বেঁচে থাকব, নইলে আমি মুসলিম কন্যা সন্তানদের জন্য মুক্তিপণ হব এবং তার হাত থেকে তাদের রক্ষা করব।’

‘আল্লাহ কসম,’ তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘তুমি তোমার জীবনের ঝুঁকি নিও না!’

কাজটি করার জন্য মেয়ে গোঁ ধরলেন, কিন্তু পিতা আপত্তি জানালেন, আমি ভয় পাচ্ছি যে, তুমি বণিকের সাথে গাধা ও ষাঁড়ের কী ঘটেছিল তা অনুভব করতে পারবে।’

‘ঐটা কী ছিল,’ সে জানতে চাইল, ‘এবং তাদের দুজনের কী হয়েছিল?’

তার পিতা তাকে বললেন: তুমি অবশ্যই জানো, আমার মেয়ে, একজন বণিকের প্রচুর সম্পদ এবং পশু উভয়ই ছিল এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে পশু ও পাখির ভাষার জ্ঞান দিয়েছিলেন। তিনি একটি গ্রামে বাস করতেন এবং তার বাড়িতে একটি গাধা ও একটি বলদ ছিল। একদিন বলদটি গাধার চত্বরে গিয়ে দেখতে পেল যে, সেটি পানি ছিটিয়ে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে; তার পাত্রে চালিত বার্লি এবং খড় দেওয়া হয়েছে, গাধাটি আয়েশ করে সেখানে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে তার প্রভূ তাকে কোন কাজে নিয়ে যান, কিন্তু তারপর তাকে ফিরিয়ে এনে এখানে রাখা হয়।

একদিন বণিক শুনতে পেলেন বলদটি গাধাকে বলছে, ‘আমি তোমাকে বাহবা জানাচ্ছি। এই যে আমি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত যখন তুমি নিশ্চিন্তে থাক আর চালনি করা বার্লি খাও। মাঝে মাঝে মালিক তোমাকে কাজে লাগায়, তোমার পিঠে চড়ে, আবার ফিরিয়ে আনে, অথচ, আমি সর্বদা হালচষি এবং শস্য মাড়াই করি।’

গাধা জবাবে বলল, ‘যখন তারা তোমার কাঁধে জোয়াল তুলে দেয় এবং তোমাকে মাঠে নিয়ে যেতে চায়, তখন তুমি উঠবে না, এমনকি তোমাকে পেটালেও উঠবে না; অথবা না হয় উঠে আবার শুয়ে পড়বে। যখন তারা তোমাকে ফিরিয়ে আনবে এবং এবং তোমাকে মটরশুটি খেতে দিবে তখন অসুস্থ হওয়ার ভান করবে এবং সেগুলি খাবে না; এক, দুই বা তিন দিন খাবে না পান করবে না এবং তুমি তোমার কঠোর পরিশ্রম থেকে রেহাই পাবে।’

পরদিন, রাখাল যখন বলদটিকে রাতের খাবার দিয়ে গেল, জন্তুটি যৎসামান্য খেল, এবং পরবর্তী সকালে লোকটি বলদটিকে হালচষার জন্য নিতে এল, সে দেখল বলদটি অসুস্থ এবং দুঃখের সাথে বলল, ‘এই কারণে সে গতকাল ঠিক মত কাজ করতে পারেনি।’

সে বণিকের নিকট গেল এবং বলল, ‘মালিক, বলদটি অসুস্থ এবং গতকাল সন্ধ্যায় সে কোন খাবার খায়নি।’

বণিক ঘটনা বুঝতে পারলেন, এবং বললেন, ‘যাও এবং তার জায়গায় গাধাটিকে নিয়ে সারাদিন হালচষার কাজ করো।’

সারাদিন হালচষার পর সন্ধ্যায় যখন গাধাটি ফিরে আসে, তখন বলদটি সারাদিন তাকে বিশ্রাম দিয়ে অনুগ্রহ করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাল। কিন্তু তিক্ত অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে গাধাটি কোন উত্তর দিল না। পরদিন রাখাল এসে তাকে সারাদিন হালচষার জন্য নিয়ে গেল।

পরদিন সকালে রাখাল এসে তাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হালচষার জন্য নিয়ে গেল। এবং যখন গাধাটি ফিরে এল তখন তার ঘাড় জোয়ারের ঘর্ষণে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে এবং ক্লান্তিতে সে অর্ধমৃত অবস্থা। বলদটি তাকে দেখে ধন্যবাদ জানাল এবং তার প্রশংসা করল, কিন্তু গাধাটি বলল, ‘আমি আমার স্বাচ্ছন্দ্যে বসে ছিলাম, কিন্তু নিজের কাজে মন দিতে পারিনি।’

তারপর সে বলল, ‘তোমাকে আমার কিছু পরামর্শ দেওয়ার আছে। আমি আমাদের মালিককে বলতে শুনেছি যে, তুমি না উঠলে তোমাকে জবাই করার জন্য কসাইকে দেওয়া হবে, এবং তোমার চামড়া টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হবে। আমি তোমার জন্য ভয় পাচ্ছি তাই তোমাকে এই উপদেশ দিয়েছি।’

বলদটি যখন গাধাটির কথা শুনল যা সে বলেছিল, তখন সে বলল, ‘আগামীকাল আমি লোকেদের সাথে বের হব।’ তারপর সে তার সমস্ত খাবার খেয়ে নিল এবং গামলাটি জিভ দিয়ে চাটতে লাগল। যখন এইসব কাণ্ড চলছিল, তখন বণিক পশুরা কী বলাবলি করছে তা শুনছিল।

পরের দিন সকালে, রাখাল যখন বলদটিকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে তখন তিনি ও তার স্ত্রী বাইরে গিয়ে গোশালার পাশে বসলেন। বলদটি যখন মনিবকে দেখল, তখন সে লেজ তুলে পাদ দিল এবং দ্রুত চলতে লাগল। কাণ্ড দেখে লোকটি হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার স্ত্রী হাসির কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি এমন কিছু দেখেছি ও শুনেছি যার জন্য আমি হাসতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু আমি তোমাকে এই ব্যাপারে বলতে পারবো না, বললে আমি আর বাঁচব না।’

‘এমন কি আপনি যদি মারাও যান,’ তিনি জোর দিয়ে বললেন, ‘আপনাকে অবশ্যই এর কারণ আমাকে বলতে হবে।’

তিনি পুনরায় জানালেন যে মৃত্যুর ভয়ে তিনি এটা করতে পারেন না, কিন্তু তার স্ত্রী বললেন, ‘তুমি আমাকে নিয়েই হেসেছ,’ তিনি তাকে বলতে বাধ্য করা পর্যন্ত জোরাজুরি করতে লাগলেন। মর্মপীড়ায় জর্জরিত হয়ে তিনি তার সন্তানদের ডেকে পাঠালেন এবং তার স্ত্রীকে গোপন কথা বলার পর মৃত্যুর আগে তার চুড়ান্ত নির্দেশনা দেওয়ার অভিপ্রায়ে কাজী ও দলিল লেখকদের নিকট পাঠালেন। স্ত্রীর প্রতি ছিল তার গভীর ভালবাসা, তিনি ছিলেন তার চাচাত বোন ও তার সন্তানদের জননী, যখন তিনি নিজেই একশ বিশ বছর বয়সী হয়ে গেছেন তখন মৃত্যুতে আক্ষেপ কী!

যখন তার সমস্ত পরিবার ও প্রতিবেশীরা সকলে একত্রিত হয়েছিল, তখন তিনি জানালেন যে তাদের কাছে তার কিছু কথা বলার আছে, কিন্তু তিনি যদি এই গোপন কথা কাউকে বলেন তবে তিনি মারা যাবেন। প্রত্যেকে তার স্ত্রীকে তাকে চাপ না দেওয়ার জন্য এবং তার স্বামী ও তার সন্তানদের পিতাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন, কিন্তু তিনি বললেন, ‘সে আমাকে না বলা পর্যন্ত আমি থামব না, এবং আমি তাকে মরতে দিব।’

এমতাবস্থায়, বণিক যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন সকলেই চুপ হয়ে গেল। এবং রীতিমত ওযু করার জন্য বাইরে চলে গেলেন, তারপর তিনি তাদের কাছে ফিরে আসবেন এবং মারা যাবেন।

বণিকের একটি মোরগ ও পঞ্চাশটি মুরগী ছিল, তাদের সাথে ছিল একটি কুকুর। তিনি শুনলেন, কুকুরটি মোরগটিকে গালাগালি করছে এবং বলছে, ‘তুমি তো খুব আনন্দে আছ, অথচ আমাদের মনিব মারা যাচ্ছেন।’

যখন মোরগ জিজ্ঞেস করল কেন এমন হল, তখন কুকুরটি তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। ‘আল্লাহর কসম’ মোরগটি চিৎকার করে উঠল, ‘নিশ্চয় তার মাথায় কোন বুদ্ধি নেই। আমার পঞ্চাশটি স্ত্রী আছে এবং আমি তাদের সন্তুষ্ট ও শান্তিতে রেখেছি অথচ তার একটি মাত্র স্ত্রী তবুও তাকে শৃঙ্খলায় রাখতে পারেন নি। কেন তিনি কয়েকটি শ্যাওড়ার ডাল নিয়ে তার স্ত্রীকে কামরায় ঢুকিয়ে পেটাতে পারেন না? ততক্ষণ পর্যন্ত পেটাবেন যতক্ষণ সে মরে না যায় অথবা অনুতপ্ত হয় এবং আর কোনদিন তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা না করে।’

মন্ত্রী এখন তার মেয়ে শাহরাজাদকে বললেন, ‘সেই লোকটি তার স্ত্রীর সাথে যেমন আচরণ করেছিল আমি তোমার সাথে সে রকম আচরণ করব।’

‘সে কী করেছে?’ মেয়ে জিজ্ঞেস করল। এবং মন্ত্রী বলতে লাগলেন—

মোরগ কুকুরকে কী বলেছে তা শুনে তিনি কিছু শ্যাওড়া ডাল কেটে একটি কক্ষে লুকিয়ে রাখলেন এবং তার স্ত্রীকে সেখানে ডেকে নিলেন। ‘এসো,’ তিনি বললেন, ‘যাতে আমি এখানে তোমার সাথে কথা বলতে পারি এবং সবার অলক্ষ্যে মারা যেতে পারি।’

তিনি তার স্বামীর সাথে ভিতেরে চলে গেলেন, বণিক দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং শ্যাওড়ার ডাল দিয়ে স্ত্রীকে পিটাতে লাগলেন, কিছুক্ষণ পর তার স্ত্রীর অচেতন হওয়ার অবস্থা হল। ‘আমি আর কখনও জানতে চাইব না,’ বলে তিনি তার স্বামীর হস্ত ও পদচুম্বন করলেন। এরপর অনুতপ্ত হওয়ার পরে তিনি এবং তার স্বামী তাদের পরিবারের ও সেখানে থাকা অন্যান্য লোকেদের আনন্দ সংবাদ দেওয়ার জন্য বেরিয়ে এলেন। অতঃপর তারা মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সুখে শান্তি বসবাস করেছিলেন।

শাহরাজাদ তার বাবার কথা শুনেলেন, কিন্তু তিনি তখনও তার পরিকল্পনার উপর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রইলেন এবং তাই তিনি তাকে দুলহান সাজিয়ে রাজা শাহরিয়ারের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি তার ছোটবোন দুনিয়াজাদকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে গেলেন। তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘যখন আমি রাজার নিকট যাব, আমি তোমাকে নেওয়ার জন্য পাঠাবো। তুমি অবশ্যই আসবে। এবং যখন দেখবে রাজা আমার সাথে যা করতে চেয়েছেন তা করা হয়েছে, তখন তুমি বলবে, “আপু, আমাকে একটি গল্প বল, যাতে রাত জেগে কাটাতে পারি।” তারপর আমি তোমাকে একটি গল্প শোনাবো, ইনশাআল্লাহ, তিনি আমাদের রক্ষা করবেন।’

শাহরাজাদকে তার পিতা রাজার নিকট নিয়ে গেলেন। তিনি তাকে দেখে আমোদিত হলেন, বললেন, ‘আমার আকাঙ্ক্ষিত বস্তু এনেছ?’

মন্ত্রী বললেন, ‘জি, রাজা।’

রাজা শাহরাজাদের সাথে শুতে গেলেন, কিন্তু তিনি তখন কাঁদছিলেন। তাকে যখন কাঁদার কারণ জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি বললেন, ‘আমার একটি ছোট বোন আছে, আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই।’ তখন রাজা দুনিয়াজাদকে ডেকে পাঠালেন। শাহরাজাদের সাথে আলিঙ্গন করার পর দুনিয়াজাদ পালঙ্কের নিচে গিয়ে বসল। তখন রাজা উঠে এলেন, তার বোনের সাথে যৌনসঙ্গম করলেন। সঙ্গম শেষে শাহরাজাদ তার বোনের কাছে এসে বসলেন, দুনিয়াজাদ শাহরাজাদকে রাত জেগে কাটানোর জন্য একটি গল্প বলতে অনুরোধ করল। ‘অবশ্য শোনাব,’ বললেন শাহরাজাদ, ‘যদি আমাদের সংস্কৃতিবান রাজা আমাকে অনুমিত প্রদান করেন।’ রাজা অস্থিরতায় ভুগছিলেন। যখন শুনলেন বোনেরা গল্প বলতে চায়, তিনি গল্প শোনার কথা ভেবে আনন্দিত হলেন এবং শাহরাজাদকে গল্প বলার অনমুতি দিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *