ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : জাঙ্গান, সুলতানিয়া ও অন্যান্য স্থান হয়ে তাউরিস থেকে ইস্পাহানে যাওয়ার সাধারণ রাস্তা।
আমাদের এখন তাউরিস ছেড়ে ছয় লীগ দূরে হ্রদে ফিরতে হবে, যেখানে তারা জাঙ্গান ও সুলতানিয়ার মধ্য দিয়ে সাধারণ সংক্ষিপ্ত পথ ধরে চলবে এবং আর্দেইল ও কাসবিনের পথকে বাম দিকে ছেড়ে যাবে। এই হ্রদটি সাধারণত বড় বড় লাল হাঁসে পূর্ণ থাকে, যেগুলোর মাংসও খুব সুস্বাদু।
এখান থেকে বার তের ঘণ্টা ভ্রমণের পর কারাশিমায় এসে তিনটি সরাইখানা পাবেন। এটি দীর্ঘ উপত্যকায় অবস্থিত একটি বড় শহর, যা অত্যন্ত উর্বর। এখানে মাটির তৈরি একটি ছোট সরাইখানা আছে, যার দরজাগুলো খুব নিচু যে লোকেরা প্রবেশ করতে তাদের হাঁটু গেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
পরদিন আপনি টারকোমা নামকে একটি বড় গ্রামে আসবেন। যেখানে মাটি খুব উর্বর, যদিও স্থানটি খুব ঠাণ্ডা। এখানে অনেকগুলো কারাভানসরাই[1] কুঞ্জপথের মত নির্মিত হয়েছে, যা সম্পূর্ণ মাটির তৈরি। একপ্রান্তে মানুষেরা শয়ন করে অন্যপ্রান্তে ঘোড়াগুলো রাখা হয়।
পরদিন আপনি একটি বন্ধুর ও মরুর দেশ ভ্রমণ করে আট ঘণ্টার মধ্যে মিয়ানাতে এসে যাবেন। মিয়ানা মার্শে অবস্থিত একটি ছোট শহর, যেখানে মহাসড়কে পাহারা দেওয়ার জন্য শুল্ক প্রদান করতে হয়। এই শহরে সমস্ত পারস্যের সবচেয়ে সুন্দর সরাইখানাগুলোর মধ্যে একটি রয়েছে।
মিয়ানা ত্যাগের দুই ঘণ্টা পরে, আপনাকে একটি নদী পার হতে হবে একটি সুন্দর ক্ষয়িষ্ণু সেতুর উপর দিয়ে।
মিয়ানা ত্যাগের দুই ঘণ্টার পরে, আপনাকে একটি নদী পার হতে হবে, একটি ক্ষয়েষ্ণু সেতুর উপর দিয়ে; খিলানগুলোর ভিতরে ফাঁফা; এটি ইট ও ফ্রিস্টোন দিয়ে তৈরি, প্যারিসের পন্ট নিউফের মতো। এই সেতুর অবস্থান ক্যাপলেন্টন পর্বতের পাদদেশের কাছাকাছি। শাহ আব্বাস সমস্ত সড়কটিকে পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, কেননা, স্থানটি এতই পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত যে যখন এটি গলে যায় বা সামান্যতম বৃষ্টিপাত হয় তখন কাফেলার পক্ষে চলাচল করা অসম্ভব। তাছাড়া পারস্যে এক ধরনের উট আছে যখন মাটিতে বৃষ্টি জমে যায় তখন তারা তাদের পা রাখতে পারে না থাকতো তাদের বাহিত বোঝার ওজন বহন করবে। তাদের বাহিত বোঝাগুলোর একচতুর্থাংশ তাদের কাঁধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তাদের পেট ফেটে যায়। সড়কটিতে পাথর বাঁধাইয়ের পূর্বে তারা রাস্তার অতিপিচ্ছিল অংশে গালিচা বিছিয়ে দিত যাতে উটগুলো যেতে পারে। যা কোথাও কোথাও এখনও করা দরকার, যে সব স্থানে পাথর বাঁধাই নষ্ট হয়ে গেছে।
ইস্পাহানের দিকে উতরাইয়ের নিম্নাংশে একটি পাহাড়ের চূড়ার পাশে একটি পরিত্যক্ত পুরনো দুর্গ দাঁড়িয়ে আছে। এটি মহাসড়ক ও একটি নদীর নিকটে, যা গুইলান প্রদেশ অতিক্রম করার পরে কাস্পিয়ান সাগরে পতিত হয়েছে। গুইলানে নদীটি বিভিন্ন খালে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সাধারণত, খালে প্রবাহিত জলের দ্বারা পারস্যে যে সকল ভুট্টা ও ফলাদি উৎপন্ন হয়, সেগুলো জনপ্রিয়তা কম এবং প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চল, যে গুলোর উর্বরতা কৃত্রিম নয় সেগুলোতে জন্মানোগুলোর চেয়ে সস্তা। অধিকন্তু, এই ধরণের অস্বাভাবিক শস্য এক বছরের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না; এবং আপনি যদি এটিকে আরও বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করতে চান তবে কেরি পোকা বংশবিস্তার করবে এবং শস্যগুলো খেয়ে ফেলবে। এভাবে জন্মানো ভুট্টার ক্ষেত্রেও এই ব্যাপার, বরং আরও বেশি, মোচার মধ্যে কীড়া জন্মে যা ভুট্টাকে এতই তিক্ত করে তোলে যে খাওয়া অসম্ভব।
ক্যাপলেন্টন পর্বতের এই দিকে, সামন্য দূরত্বে খুব উঁচু আরও দুটি আছে; একটি উত্তরাভিমুখী, নাম সেইভল্যাণ্ড; অন্যটি দক্ষিণাভিমুখী, নাম সেভান্দ। তৃতীয় একটিও আছে যা ইস্পাহান সড়ক থেকে দৃষ্টিগোচর হয় না, পথ থেকে বহুদূরে হামাদান শহরের নিকটে। এই তিনটি পর্বত প্রস্রবণে পূর্ণ, সেখান থেকে বেশির ভাগ স্রোত পারস্যের জলাশয়ে পতিত হয়। পারস্যবাসীরা বলে, এই প্রস্রবণগুলোর মধ্যে আরও অনেকগুলো ছিল সেগুলো একশ বছর আগে শুকিয়ে গেছে অথবা কেউই বলতে পারে না সেগুলোর কী হয়েছিল।
পর্বতের কাছাকাছি বেশ কয়েকটি গ্রাম আছে যেগুলো বাদশাকে কিছুই দেয় না, তবে তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাউল ও মাখন পাঠাতে বাধ্য হয় আরদেইলস্থ মসজিদ ব্যবহারের জন্য। তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাধিকারও রয়েছে, যা হচ্ছে, যদি কোন ব্যক্তি হত্যা করে এবং এই গ্রামগুলোতে পালিয়ে যায়, তাকে গ্রেফতার করা যাবে না, স্বয়ং বাদশাও তাকে শাস্তি দিতে পারবেন না।
ক্যালেপ্টন পর্বতের পাদদেশে প্রবাহিত নদী ছেড়ে বছর কয়েক পূর্বে নির্মিত শামালাভা নামক একটি সরাইখানায় আসবেন। তের ঘণ্টা পরে, একটি অনুর্বর ভুমি ভ্রমণ করে আপনি অন্য একটি সরাইখানায় আসবেন, নাম সারচাম। এটি অতিশয় মরুভূমিতে অবস্থিত। যা মহাসড়কগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য সেখানে অবস্থানরত রেডারদেরকে খুব উদাসীন করে তোলে এবং যে কোন শহর বা গ্রাম থেকে নিজেদেরকে অনেক দূরে খুঁজে পায়।
সারচাম থেকে নদীর ধারে এসে তীর ধরে বেশ কিছুক্ষণ ভ্রমণ করবেন, যতক্ষণ না একটি বড় গ্রামের কাছে ডিগবে নামক সরাইখানায় না পৌঁছান। অবকাঠামোটি অত্যধিক সুন্দর, নিম্নাংশ ফ্রিস্টোনে লাল ও সাদা দ্বারা ঢেউ খেলানো এবং খুবই মজবুত।
পরদিন, একটি গভীর উপত্যকায় না পৌঁছানো পর্যন্ত আপনি একটি বন্ধুর অঞ্চল ভ্রমণ করবেন। এর শেষে আপনি জাংগানে পৌঁছবেন। বড় শহর এবং অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত। যাই হোক, এখানে একটি মনোরম সরাইখানা রয়েছে। আমি শেষবার যখন ইস্পাহান গিয়েছিলাম, এটিতে এত ভীড় ছিল যে আমি বৃষ্টিতে বাহিরেই শুয়ে থাকতাম যদি না দুই জন আরমেনীয় সৌজন্য তা দেখাত। জাংগান থেকে একটি সরাইতে যাবেন, সেখানে সুলতানিয়ার খানকে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।
সুলতানিয়া একটি খুব বড় শহর, সড়ক থেকে আধা মাইল দূরে পর্বতের নিকটে। পূর্বে এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর মসজিদ ছিল, যা অবশিষ্ট থাকা ধ্বংসাবশেষ দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায়। অনেক খ্রিষ্টান চার্চকেও মসজিদে পরিণত করা হয়েছিল। আপনি যদি আরমেনীয়দের বিশ্বাস করেন, তারা আপনাকে বলবে, সুলতানিয়াতে আটশোর কাছাকাছি চার্চ ও চ্যাপেল[2] ছিল।
সুলতানিয়া থেকে তিন লীগ দূরে একটি সরাই রয়েছে, আরও এক লীগ দূরে বড় শহর ইজা। সেখানে একটি সুপরিসর সরাই রয়েছে। সেখানে অতি চমৎকার মদ পাওয়া যায়।
সেখান থেকে যান হাবারে, প্রাচীন শহর, বিশাল ব্যাপ্তি কিন্তু অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। বেশির ভাগ অংশ আরমেনীয় অধ্যুষিত। এখানে উৎকৃষ্ট মদের অভিপ্রায়ে পর্যটকেরা তাদের বোতলগুরো পুনরায় পূর্ণ করে নেয়।
হাবার থেকে সাত ঘণ্টার ভ্রমণের পর আসবে পার্টিন গ্রামে। জাংগান থেকে পার্টিন দুই দিনেই পৌঁছে যাবেন। এটি একটি উর্বর সমভূমিতে অবস্থিত, সেখানে আরও কয়েকটি গ্রাম আছে। এটি তিন লীগের বেশি প্রশস্ত নয়। পূর্ব ও পশ্চিমে, প্রত্যেক পাশে পর্বতমালার সারি দ্বারা ঘেরাও।
সমভূমি পেরিয়ে, সেক্সাভায় আসা পর্যন্ত একটি অনুর্বর ও দারিদ্র ক্লীষ্ট জনবসতিতে সারাদিন ভ্রমণ করতে হবে। একটি গ্রামের ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে যাবেন, যেখানে একটি মসজিদের মিনারসহ দুটি ঘর দাঁড়িয়ে আছে। খুব উঁচু ও সরু। তারপর একটি মাটির প্রাচীরের সরাইয়ে আসবেন, এটি কয়েক বছর আগে নির্মিত। খিয়ারা দুর্গের পাশে। এটি একটি পাহাড়ের গিরিখাতে খুব খারাপভাবে নির্মিত।
সেক্সাভা হল, বাদাম উৎপাদনের উত্তম মাটির শহর। এখানে যে সরাইগুলো আছে, মাটি দ্বারা নির্মিত এবং খুব ছোট হলেও খুবই সুদর্শন ও সুবিধাজনক। তাদের সংখ্যাধিক্য তাদের ক্ষুদ্রতার ত্রুটি অপনোদন করে।
সেক্সাভা থেকে সাত ঘণ্টার ভ্রমণের পর একটি চমৎকার সরাই, নাম উদজিউপ। আগে এটি আরও উন্নত ছিল, মাঠে একা দাঁড়িয়ে। এখান থেকে তিন লীগ পরে আরেকটি প্রশস্ত সরাই রয়েছে। নাম কোচকেরিয়া। আরও চার ঘণ্টা পরে দেঙ্গে সরাই। সেখানে দুটি রাস্তা মিলিত হয়েছে যা আমি পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদে বলেছি।
দেঙ্গে থেকে কোম—অনুর্বর, শুষ্ক ও মরুভূমি অঞ্চলে তিন দিনের যাত্রা। সেখানে জল নেই, কিন্তু খুব কম জায়গা ছাড়া অন্য সর্বত্রই ভাল সংরক্ষিত জল (Cistern Water) পাওয়া যায়। দেঙ্গে থেকে চার লীগ পরে একটি মনোরম সরাই আছে। তারও তিন লীগ পরে আছে আরেকটি। একটি গ্রাম থেকে দক্ষিণে প্রায় এক মাইল দূরে। সেখানে উন্নতমানের মদ উৎপন্ন হয়। সাদা ও লাল মদ। শেষ সরাই থেকে সাভা পর্যন্ত কাফেলা সহ ভ্রমণ তিন ঘণ্টার বেশি নয়।
উর্বর সমভূমিতে সাভা ভাল শহর। এখানে বেশ কয়েকটি গ্রাম আছে। শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাণিজ্য হল, ছোট মেষশাবকের চামড়া, এর কুঁচন খুব ঝরঝরে যার থেকে তারা পশমীকাপড় তৈরি করে। সাভা ছেড়ে দুই তিন লীগ দূরে অঞ্চলটি বেশ উর্বর। শহর থেকে অর্ধ লীগ দূরে পদচলে নদী পার হওয়ার পর দুই ঘণ্টা ভ্রমণ শেষে আপনি পৌঁছে যাবেন পারস্যের অতি মনোরম সরাইগুলোতে। এগুলো সম্পন্ন হয়েছিল আমি যখন শেষবার ইস্পাহান ভ্রমণ করেছিলাম। এখান থেকে কোম পর্যন্ত শুকনো ও বালুকাময় একটি সড়ক ধরে সাত আট ঘণ্টার যাত্রা। কিন্তু কোমের এই দিকে আধা লীগ, ভূমি খুবই ভাল ও উর্বর।
কোম পারস্যের অন্যতম বড় শহর। প্রচুর ধান সমৃদ্ধ দেশ। এছাড়াও এখানে উৎকৃষ্ট ফলাদি উৎপন্ন হয়, বিশেষ করে, বৃহৎ ও খাসা আনার। দেওয়ালগুলো মাটির তৈরি। ছোট টাওয়ারগুলি একে অপরের কাছাকাছি। ঘরগুলো শুধুই মাটির এবং ভিতরের দিকে খুব একটা সুদর্শন নয়। শহরে প্রবেশ করার সময় একটি পাথুরে সেতুর উপর দিয়ে নদী পাড়ি দিতে হয়। তারপর ডান দিকে বাঁক নিয়ে খুব সুন্দরভাবে নির্মিত ও বেশ সুবিধাজনক একটি সরাইয়ে আসবেন।
কোমে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বড় মসজিদ, পারস্যেবাসীদের মধ্যে ভক্তিশ্রদ্ধায় আরদেইলের মসজিদের চেয়ে এটি কম নয়। এখানে আপনি শাহ সেফি ও শাহ দ্বিতীয় আব্বাসের সমাধি দেখতে পাবেন। এছাড়া রয়েছে সাইয়্যেদা ফাতিমার সমাধি, তিনি ছিলেন আলী ও মুহম্মদের কন্যা ফাতেমাতুজ্জুহরার পুত্র ইমান হোসেনের কন্যা।
মসজিদের সবচেয়ে বড় তোরণটি প্রশস্তার চেয়ে দীর্ঘ গণচত্বরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেখানে একটি সরাই আছে, কয়েকটি দোকানও আছে, বাহিরের অংশ অনেকটা সৌন্দর্যপূর্ণ। গণচত্বরের একদিক নিচু দেওয়াল ঘেরা, এর অপরপাশে বেলাভূমি এবং একটি নদী যা গণচত্বর শেষে পার হতে হয়। মসজিদের সদর দরজার ওপাশে সোনার অক্ষরে শাহ দ্বিতীয় আব্বাসের প্রশংসায় একটি শিলালিপি স্থাপন করা হয়েছে। প্রথমে যে স্থানে প্রবেশ করবেন সেটি হল, প্রস্থের চেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যের একটি প্রাঙ্গণ, বাগানও বলা যেতে পারে। কেননা, মাঝখানের গলির প্রত্যেক পাশে যেখানে শান বাঁধানো, সেখানে কয়েকটি বর্গাকার পুষ্পক্ষেত্র রয়েছে; হলদে জুঁই ও অন্যান্য গাছপালা; যেগুলিকে বেড়া দ্বারা এমন ভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে যা দুই পাশের দৈর্ঘ্যের সমান বিস্তৃত। এই প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা খ্রিষ্টানদের জন্য সহজ ব্যাপার নয়, বিশেষ করে যাদের পোশাক ও জীবনাচার তারা পছন্দ করে না। অধিকন্তু, আমি যে ধরণের পোশাক পরিধান করতাম এবং চলাফেরা করতাম, ভারতবর্ষ ও পারস্যের কোথাও আমি বাধার সম্মুখীন হইনি।
প্রথম প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই বামপাশে ছোট ছোট কামরা রয়েছে, সেখানে যারা মসজিদ কর্তৃপক্ষ বিতরণকৃত ভিক্ষা গ্রহণ করে তারা আসে ও খাবার খায় এবং তারপর তাদের পথে চলে যায়। এই কক্ষগুলো যারা খাবারের মূল্য দিতে পারে না তাদের জন্য আশ্রয় হিসেবে কাজ করে। ঠিক আরদেইলির মসজিদের মত। এই দানসত্রগুলো আমাদের গুলোর মত নয়, যেগুলোতে আগমণকারীরা নিজ খরচে থাকতে হয়। কেননা, পারস্যে তাদের খাবার দেওয়া হয় মসজিদের খরচে। এই পদ্ধতিতে জিম্মাদারী মুক্ত হয়ে তাদের বন্ধুরা আরও সহজে তাদের ঋণদাতাদের অর্থের বন্দোবস্ত করে ফেলতে পারে।
প্রথম প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে চলে যান দ্বিতীয়টিতে, এটি বড় ও পাকা; এখান থেকে তৃতীয়টিতে যান, এটি বর্গাকার ও টেরাসের মত উত্থিত। বড় একটি তোরণ দিয়ে এটিতে প্রবেশ করে খোলা চলাচলপথের শেষে মোল্লাদের বাসস্থান।
সেই প্রাঙ্গণ থেকে দশ বার ধাপের ইটের গাঁথুনি আরোহণ করে একটি সুন্দর প্রাঙ্গণে চলে যান, এটিও টেরাসের মত উত্থিত। এর ঠিক মধ্যখানে একটি মনোরম ফোয়ারা রয়েছে। এটি ক্রমাগত ছোট নল দ্বারা প্রবাহিত পানিতে পূর্ণ হয় এবং অন্য নলগুলি দিয়ে খালি হয় যেগুলো ঘেরের বিভিন্ন অংশে পানি সরবরাহ করে। এই প্রাঙ্গণে কয়েকটি ভবন রয়েছে, কিন্তু এর একপাশ তোলা হয়েছে মসজিদের সম্মুখ দিক যুক্ত করে যা অসুন্দর কাঠামো নয়। এর সাথে রয়েছে তিনটি বড় তোরণ, দেশীয় রীতিতে অতি নিপুণভাবে প্রসারিত; সম্মুখে ইটের গাঁথুনি দিয়ে এক পুরুষ উচ্চতায় আলো প্রবেশের জন্য গবাক্ষ তৈরি করা হয়েছে, হীরাকার বিষমকোণী চতুর্ভূজের মত। মধ্য তোরণের দোরগোড়া রৌপ্যপাত দিয়ে ঢাকা। এই তিনটি তোরণ ও গুম্বজের মধ্যে কয়েকজন ধর্মশাস্ত্রবিৎ রয়েছেন, তারা তাদের হাতে কিতাব রেখে পালাক্রমে পাঠ করতে থাকেন।
এই মসজিদটি অষ্টভুজাকার এবং প্রতি কোণে আখরোট গাছের একটি ছোট কাঠের দরজা রয়েছে, ধুসর ও হলুদ রঙে রাঙানো। সাইয়্যেদা ফাতিমার সমাধিটি রয়েছে মসজিদের দূরবর্তী অংশে, সেখানে প্রাচীর ও সমাধির মাঝে মাত্র একজন মানুষের যাওয়ার জায়গা রয়েছে। এটি একটি বৃহৎ রৌপ্য জাফরি দিয়ে ঘেরাও করা, ষোল ফুট বর্গাকার। গরাদগুলি বৃত্তাকার এবং হাতলগুলিও, যেখানে একে অপরকে ছেদন করেছে। এটি সোনা ও রূপার বেশ কয়েকটি বাতি দ্বারা আলোকিত করা হয় যা সম্পূর্ণরূপে নয়নাভিরাম। মসজিদের অভ্যন্তরে, কোণগুলোর উচ্চতা পর্যন্ত যা গুম্বজকে ধরে রেখেছে, বিভিন্ন রঙের বর্গাকার টালি দিয়ে সজ্জিত। গম্বুজের চুঁড়া এবং মসজিদের মিম্বরের ধনুকাকৃতি খিলানগুলি সোনা ও নীলমণির অলঙ্করণ সমৃদ্ধ। মসজিদের চারদিকে এবং যে দিকে সাইয়্যেদা ফাতিমার সমাধি রয়েছে সে দিকে এটি বৃহৎ দরদালান রয়েছে। সেখানে দরিদ্রদের মাঝে রাজভিক্ষা বণ্টন করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে খুব ভালভাবে প্রস্তুত পোলাউ ও অন্যান্য আহারাদি। এই সমাধি থেকে বামদিকে মোড় নিলে একটি আরোহন রয়েছে, দূরত্ব পঁচিশ ত্রিশ পদক্ষেপ। এই আরোহণের শীর্ষে একটি দরজা রয়েছে। এর উপরে রয়েছে মহান দ্বিতীয় শাহ আব্বাসের সমাধিফলক। দরজাটি খুললে বাদশাহের চিরনিদ্রার স্থানটি দেখা যায়। এখানে আরেকটি জাফরিওয়ালা দরজা রয়েছে, দেখতে পাবেন, একটি ছোট গুম্বজের নিচে শাহ সেফির পিতার সমাধি রয়েছে। এটি সোনার কাপড়ের গিলাফে ঢাকা। তারা নিয়মিত শাহ আব্বাসের সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ করে, তারা বলে, এটি তাদের বিখ্যাত করবে।
কোমে আমি দুই ঘণ্টাও ছিলাম না, কিন্তু সরাইয়ের তোরণ দিয়ে অসাধারণ তাড়াহুড়ো করে লোকেদের দৌঁড়ে যেতে দেখলাম। ব্যাপার কি, জানতে চাইলে তারা আমাকে উত্তর দিল যে, এটি ছিল দিনব্যাপী দুই নবীর লড়াইয়ের জন্য নির্ধারিত। অতঃপর, আমি চত্বরে গেলাম, সেখানে লোকারণ্য, দেখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। প্রথম স্থানে পর্যাপ্ত সংখ্যক বাজিকর ও পুতুল নাচের খেলোয়ারদেরকে দুই দলে বিভক্ত করে চত্বরের মাঝখানে রাখা হয়েছিল। এবং লড়াইয়ের জন্য যথেষ্ট চক্র তৈরি করা হয়েছিল। প্রতিটি দল একটি ষাঁড়ের শিঙ ধরে রেখেছিল, একটিকে তারা বলল, মুহম্মদ, অন্যটি আলী। দুর্ঘটনাক্রমে হোক বা ষাঁড়-প্রভূদের চাতুরীর কারণে হোক, একটি অপ্রতিরোধ্য লড়াইয়ের পরে, যখন উদ্দীপনা ও উম্মাদনার কারণে ষাঁড়গুলোর মুখে ফেনা উঠল, মুহম্মদ দীর্ঘ সময় পর মাঠ ত্যাগ করল এবং আলী বিজয় লাভ করল। তখন সমস্ত লোক আনন্দে চিৎকার করে উঠল, সমস্ত চত্বর বাঁশী ও সানাইয়ের সুরে মুখরিত হল। প্রত্যেকে যেন এসেছে, আলীকে উপাসনা করতে, তারা রোদন করে উঠল, দেখুন, আলী যা করেছে তা আল্লাহর কাজ। দীর্ঘসময় পর তারা ষাঁড়টিকে একটি তোরণের নিচে নিয়ে এল, তার মাথা জনগণের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হল। সেখানে তারা তার দেহ টিপে তাকে সতেজ করার পরে, লড়াইয়ের পরে নির্ভিকভাবে যত্ন নিয়ে প্রত্যেকে তাকে উপহার প্রদান করল যা ছিল বাজিকরদের লাভ। কোমের খান বা প্রশাসক এই দৃশ্য দেখার জন্য একশত ঘোড়া নিয়ে এসেছিলেন, তিনি ষাঁড়টিকে পঞ্চাশ তোমান বা সাত শত পঞ্চাশ ক্রাউন উপহার প্রদান করলেন। যারা তার সাথে এসেছিলেন এবং কোমের প্রধান বাসিন্দারা, তারা তাকে কিছু পোশাক ও অন্যদের কটিবন্ধ উপহার দিলেন। দরিদ্র মানুষেরা তাদের সামর্থ্যানুযায়ী তাকে ফলমূল ও অন্যান্য জিনিস প্রদান করতে কার্পণ্য করেনি।
খান, একজন অত্যন্ত সুশীল ও দয়ালু প্রভূ ছিলেন। এমন কোন বিদেশী ছিলেন না যিনি তার প্রশংসা করেননি। অতঃপর আমি সেই স্থানে পৌঁছানোর সাথে সাথে তিনি আমাকে দেখলেন, আমার সাথে ছিল একজন ওলন্দাজ। তাকে আমি কনস্টান্টিনোপল থেকে নিয়ে এসেছি। অথবা তাকে কেউ জানিয়েছিলে যে তার নিকটে একজন বিদেশী রয়েছে। তিনি আমাদের ডেকে পাঠালেন এবং তারপর তিনি আমাদের ভ্রমণ উপলক্ষ্যে কিছু প্রশ্ন করলেন। তিনি একটি আসন আনিয়ে আমাদের বসতে দিলেন। তারপর তিনি জানতে চাইলেন, আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং ইস্পাহানে আমাদের কাজ কী? যখন আমরা তাকে জানালাম যে আমরা বাদশাহের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য অপেক্ষা করতে সেখানে গিয়েছি, তখন তিনি আমাদের অভিপ্রায় মেনে নিলেন। কিন্তু অভিযোগ করলেন যে, আমরা তাকে আমাদের আগমণের সংবাদ জ্ঞাপন করিনি। সন্ধ্যায় তিনি আমাদের জন্য বেশ কিছু সুস্বাদু খাবার পাঠালেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, ছয়টি আকর্ষণীয় তরমুজ এবং চার বোতল উৎকৃষ্ট মদ।
তিনি আমার নিকট অত্যন্ত সাহসী ও উদার ব্যক্তি হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিলেন, যে কারণে পরবর্তীকালে বাদশাহের প্রতি তার অসন্তুষ্টি ও তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কেননা, খান শহরের প্রাচীরগুলো পুননির্মাণ করতে, যেগুলো ছিল মাটির তৈরি এবং নদীর উপরের সেতু মেরামতের জন্য বাদশাহকে না লিখে নিজ দায়িত্বে শহরে আনা প্রত্যেক ফলের ঝুড়ির উপর সামান্য কর আরোপ করেছিলেন। বর্তমানে পারস্যের প্রত্যেক শহরে এমন ব্যক্তি নিয়োগ করা হয়েছে যারা পণ্যের মূল্য কত নির্ধারিত হবে তার সাপ্তাহিক বিবরণ সংগ্রহ করে এবং খেয়াল রাখে যে কোন জিনিসের উপর কোন ধরণের শুল্ক আরোপ করা না হয়। দর নির্ধারণের সময়েই তারা তাদের কর আদায় করে নেয়, কেননা, প্রতি সপ্তাহের শুরুতে তারা নিলাম আহ্বান করে। শাহ সেফি ১৬৩২ সালে রাজ্যভার গ্রহণ করেন। খান তাঁর অজান্তেই ফলের উপর কর আরোপ করেছেন, কর প্রদানকারীগণ কর্তৃক বাদশাহকে তা জানানো হলে তিনি তার প্রতি এতটাই ক্ষুব্দ হন যে তিনি তাকে শিকল পরিয়ে ইস্পাহান নিয়ে আসেন, যেখানে তিনি তার প্রতি অত্যন্ত রূঢ় আচরণ করেন। সেই সময়ে খানের পুত্র বাদশাহের নিকটেই অবস্থান করছিলেন, তার দায়িত্ব ছিল বাদশাহকে আলবোলা ও তামাক পরিবেশন করা, যা পারস্যে একটি অত্যন্ত সম্মানজনক চাকরি ছিল। যখন খান এলেন, বাদশাহ তাকে প্রাসাদের সদর দরজায় জনসম্মুখে নিয়ে যেতে আদেশ করলেন এবং তার পুত্রকে আদেশ করলেন তার পিতার গোঁফের চুল গুলো ধরে টেনে তার চামড়া থেকে মূল সহ তুলে ফেলতে। এরপর তিনি আদেশ করলেন, তার নাক কেটে ফেলতে, তার কান কেটে ফেলতে; অতঃপর তার চোখ উপড়ে ফেলতে এবং সর্বশেষ তার মাথা কেটে ফেলতে। যখন বাদশাহের ইচ্ছানুযায়ী তিনি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলেন, তিনি তাকে আদেশ করলেন গিয়ে তার পিতার সুবাদারী গ্রহণ করতে এবং তাকে একজন অভিজ্ঞ প্রবীণকে সহকারী হিসেবে গ্রহণ করার অনুমতি প্রদান করা হল। তিনি তাকে এই কথাগুলো বলে কোমে পাঠালেন, যদি তুমি এই মৃত কুকুরটি যেমন শাসন করেছে তার চেয়ে ভাল করতে না পার, আমি তোমাকে এর চেয়ে নিষ্ঠুর মৃত্যু প্রদান করবো।
কোম ত্যাগ করে, চার ঘণ্টা ধরে একটি মনোরম বিস্তৃর্ণ সমতল ভূখণ্ড ভ্রমণ করবেন, তারপর পৌঁছবেন পাঁচ ছয়টি সরাইওয়ালা একটি মনোরম গ্রামে। অতঃপর, অ্যাবসিরিম পৌঁছানো পর্যন্ত বালি ছাড়া আর কিছুই নেই। গ্রাম থেকে দূরে যেখানে তিনটি সরাই আছে, সেখানে সুপেয় জল পাওয়া যাবে। অ্যাবসিরিম থেকে কাচান পর্যন্ত একটি বৃহৎ গ্রাম, যাতে বিস্তৃর্ণ ভূট্টা ক্ষেত ও গোলা রয়েছে, ছয় ঘণ্টার ভ্রমণ।
কাচান জনপূর্ণ বড় শহর ও মানবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস দিয়ে সজ্জিত। এটিকে ঘিরে একটি পুরোনো প্রাচীর রয়েছে যা স্থানে স্থানে ভেঙে পড়েছে, তাই শহরে প্রবেশের জন্য কোন তোরণ খোঁজার দরকার হয় না। যে পাশ ইস্পাহানের দিকে, সে পাশের মাটি ভাল। ফল উৎপাদনের বিশাল ভাণ্ডার। ইহুদীরা সযত্নে উৎকৃষ্ট মদ উৎপাদন করে। ধারণা করা হয়, কাচানে ইহুদীদের হাজার খানেক পরিবার রয়েছে, ইস্পাহানে প্রায় ছয় শত, কিন্তু কোমে নয় দশটির বেশি নয়। পারস্যে যে অনেক ইহুদী রয়েছে তা নয়, কিন্তু যারা ইস্পাহান, কাচান ও কোমে বাস করে তারা নিজেদের নিয়ে, বিশেষ করে জুদাহ গোত্র নিয়ে গর্ববোধ করে।
কাচানে প্রচুর পরিমাণে রেশম-তাঁতি রয়েছে যারা খুব দক্ষ কারিগর। তারা সোনা ও রূপার মিশ্রণে উৎকৃষ্টরূপে অলঙ্কৃত সাটিন তৈরি করে যা পারস্যের বাইরেও যায়। এখানে তারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। তারা তাম্রপাত্র তৈরি করে যার বেশির ভাগই অনেক দূর দূরান্তে বিক্রি হয়। দোকানঘর গুলি সৌন্দর্যে অন্যতম, ভাল খিলানযুক্ত। সরাইগুলো বড় ও সুবিধাজনক। তবে, সবগুলোর মধ্যে একটি খুবই জাঁকালো, যা বাদশাহের উদ্যানের পাশে, শহরের প্রবেশ পথে। উদ্যানের পাশে সরাইটিও তৈরি হয়েছিল মহামান্য (the first of that Name, who was at a vast charge) বাদশা শাহ আব্বাসের নির্দেশে। সরাইটি একশত পদক্ষেপের বেশি বর্গাকার। ইটের তৈরি উঁচু দোতলা ভবন, এতে যৌক্তিক বিশালাকার ছাব্বিশটি খিলানযুক্ত কক্ষ রয়েছে। এটি এত মনোরম ভবন ছিল যে, এটিকে তুচ্ছ বিবেচনা করা যেত না। এখন এটি পতনোন্মুখ। প্রাঙ্গণের মাঝখানে পানি সংগ্রহের জন্য একটি ফোয়ারা ছিল, যা নষ্ট হয়ে গেছে। পারস্য ও তুর্কের লোকেরা বদখেয়ালী, তারা পুরোনো ভবনকে সংস্কার করার চেয়ে নুতন বাড়ি বেশি তৈরি করে। এই কারণে, এ যাবৎ তারা শাহ আব্বাসের সরাইয়ের মত চার পাঁচটি সরাই তৈরি করেছে। এই প্রথাটা এতই উচ্চ বিস্তার লাভ করেছে যে, শিশুরা তাদের পিতা-মাতা যেখানে থাকতেন সেই পুরানো বাড়িগুলো মেরামত করার চেষ্টা থেকে এতদূর যে, তারা নিজেদের বসতির জন্য বাড়ি নির্মাণের সম্মানের লোভে তাদের পিতামাতার মৃত্যুর পর সে পুরোনো বাড়িতে তেমনটা বাস করে না।
আমরা কাচান ত্যাগ করার পূর্বে আপনাকে অবশ্য লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আপনি সেই শহর থেকে গুইলান যাওয়ার সময় পুঙ্খানুপুঙ্খ বার ঘণ্টা সমভূমি ভ্রমণ এড়াতে পারবেন না, যা সম্পূর্ণই খাঁটি লবণ। এই পথে একটি জলাধার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না এবং এর মধ্যে যে জল আছে তার চেয়ে খারাপ জল হতে পারে না।
কাচান ছেড়ে তিন লীগ অতিক্রম করতে হবে, তারপর পর্বতমালার মধ্যে প্রবেশ করবেন। এখানে ইটের তৈরি মনোরম সরাইয়ে আসবেন। সেখান থেকে একটি মনোরম উপত্যকায় নেমে আসবেন, যেখানে একটি নদীর তীর ধরে দীর্ঘ সময় ভ্রমণ করতে হবে। এটি খুব সংকীর্ণ একটি পথ। উপত্যকার শেষে একটি প্রকাণ্ড প্রাচীর দেখতে পাবেন, এটি আড়াআড়ি ভাবে উপত্যকাকে অতিক্রম করে দুটি পর্বতকে একসাথে যুক্ত করেছে। প্রাচীরটি দৈর্ঘ্যে একশত পদক্ষেপের বেশি, ত্রিশ ফুটের বেশি পুরু ও পঞ্চাশ ফুট উঁচু। এটি মহান বাদশাহ আব্বাসের কীর্তি। এর নকশা করা হয়েছিল যাতে পর্বত থেকে নেমে আসা জল এখানে আটকে রেখে প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য একটি জলাধার নির্মাণ করা যায়। প্রাচীরের পাদদেশে একটি জলকপাট রয়েছে যা জলের মধ্যে নামিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু, এটিকে টেনে তুলে কাচান সমভূমির আশপাশে সমস্ত জমিতে জল সেচন করা হয়। এই জলাধার থেকে করোউ পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টার যাত্রা।
করোউ অনেক বড় গ্রাম এবং অনেক মানুষের আবাস। উঁচু পর্বতমালা পরিবেষ্টিত মাটি ও আখরোট গাছের বিশাল বাগান সমৃদ্ধ। ঘরগুলোর ছাদ অনেক নীচু ও চকমকি পাথরের তৈরি; কিন্তু সেখানকার সরাইটি অনেক মনোরম ও সুবিধাজনক। এই গ্রামে একটি মাত্র রাস্তা, কিন্তু প্রায় অর্ধলীগ দীর্ঘ। কিন্তু শীতকালে এটির মধ্য দিয়ে বয়ে চলা বড় নদী ও পাথরের কারণে এটি খুব সমস্যা সঙ্কুল। পারস্যের অন্যান্য স্থানের মত এই গ্রামেও প্রচুর সংখ্যক শৃগাল রয়েছে; যেগুলো এক ধরণের খেঁকশিয়াল, যারা রাতের বেলা বীভৎস শব্দ করে; কেননা, যদি একটি চিৎকার করে তবে বাকিরাও জবাবে চিৎকার শুরু করে।
করোউ থেকে আপনাকে পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে তিন লীগ ভ্রমণ করতে হবে, অতঃপর ইস্পাহান পৌঁছতে মাত্র বার লীগ। অনবরত সমভূমি, একেবারে শহরের নিকট পর্যন্ত। বহুস্থানে মাটি খুবই উৎকৃষ্ট। প্রতি তিন লীগ শেষে সরাই পাবেন। প্রথমটির নাম আচাহা-আগাকামালা; দ্বিতীয়টি, যেটি করোউ ও ইস্পাহানের মাঝামাঝিতে, নাম মিচিয়াকোর। বড় গ্রামের অনুরূপ, এই স্থানে একটি নয় বরং অনেকগুলো সরাই রয়েছে। মিচিয়াকোর থেকে আগানুরো এলে একটি সরাই রয়েছে, খুব বাজে ভাবে নির্মিত। আগানুরা থেকে পুষ্ট ও উর্বর একটি এলাকা দিয়ে তিন লীগ ভ্রমণ করার পর আপনি ইস্পাহান পৌঁছে যাবেন।
- [1] পূর্বদেশগুলি বিশেষ করে তুরস্ক অঞ্চলে গৃহপ্রাঙ্গণযুক্ত সরাইখানা যেখানে কাফেলাগুলো রাত্রিযাপন করে।
- [2] চ্যাপেল (Chappel) হল খ্রিস্টানদের প্রার্থনা এবং উপাসনার স্থান যা সাধারণত তুলনামূলকভাবে ছোট। শব্দটির বেশ কয়েকটি অর্থ রয়েছে। প্রথমত, একটি গির্জার ভিতরে যে ছোট জায়গাগুলির নিজস্ব বেদী থাকে, তাকে প্রায়ই চ্যাপেল বলা হয়; “লেডি চ্যাপেল” এইগুলোর একটি সাধারণ উদাহরণ।