বসন্ত কুমার বাবুর বাড়ি। বি কে দাস রোড,ফরাশগঞ্জ।

» পদব্রজে ঢাকা দর্শন : তৃতীয় পর্ব

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে বুড়িগঙ্গা নদী। কত কি ঘটে গেল এই বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে। এই নদী এখন চলমান এক মরা নদী যার পানি রঙ ধারণ করেছে কালো থেকেও কালো। এই নদীতে এখন বাস করে রাক্ষুসে মাছ শাকার। তবুও বাণিজ্যিক সম্ভাবনায় খুব এগিয়ে আছে এই নদী। শ্যামবাজার ও ফরাশগঞ্জ এর মধ্যে অন্যতম। এখানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। শ্যামবাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে সবজি, মসলা, তরকারি, ফল ইত্যাদি পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সব কিছু বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে শ্যামবাজারে আসে। নদীর উত্তর তীরে গড়ে ওঠা ফরাসি বণিকদের স্মৃতিবিজড়িত এলাকাটির নাম ফরাশগঞ্জ।

আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি ফরাশগঞ্জের বি কে দাশ রোডের বড়বাড়ির সামনে। বাড়ির বেহাল দশা দেখেই চরম হতাশা প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল আমার। বাড়ির ছাদ থেকে আরেকটি সুন্দর রঙ করা বাড়ি চোখে পড়ল। বড় বাড়ির কোলঘেঁষে এইবাড়িটি নির্মিত। চোখধাঁধানো স্থাপত্য শৈলীতে নির্মাণ করা হয়েছিল এই বাড়িটি, একবার দেখেই যে কেউ এর প্রেমে পড়তে বাধ্য। সামনে দোতলায় বিশাল এক বারান্দা। সেই বারান্দায় ঠাঁই পেয়েছে বিভিন্ন কারুকার্য। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলাম কিন্তু তালাবদ্ধ তাই আর প্রবেশ করতে পারলাম না। কে ছিলেন এই বসন্ত কুমার দাশ?

বসন্ত কুমার দাস ছিলেন বরিশালের অধিবাসী। এই যে বড়বাড়ির কথা উল্লেখ করলাম সেই বড়বাড়ির প্রসন্ন কুমার দাষ তার ভাই। বি কে দাশ অর্থাৎ বসন্ত কুমার দাশ আর তাঁর ভাই প্রসন্ন কুমার দাশ। প্রসন্ন কুমার ছিলেন বরিশাল বড়ঘর এস্টেটের জমিদার।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর কথা। ঢাকায় একটি বাড়ি করলেন থাকার জন্য। সেই বাড়িটিই এই বড়বাড়ি। কি নাই এই বাড়িতে সবই ছিল এই বাড়িতে কিন্তু আজ কিছুই নাই শুধু ঐতিহাসিক তকমা গায়ে লাগিয়ে একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক এই বড় বাড়ির পাশেই অবস্থতি বি কে দাশের বাড়িটি।

১৯২০ সালের শুরুর দিকে বসন্ত কুমার ঢাকার একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। স্থানীয় লোকজন তার সম্মানে ফরাসগঞ্জের রাস্তাটি তার নামে রাখে। এ রাস্তাটি মূলত একটি আবাসিক এলাকা। ঢাকার অভিজাত শ্রেণির লোকজন এখানে বসবাস করতেন। রাস্তাটির দুপাশে অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা বিদ্যমান। বাড়িটি এতটাই সৌখিন সৌন্দর্য্যে মণ্ডিত। দেখলেই এর প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য। মাঝেমধ্যে ভাবি পুরান ঢাকায় এমন কত শত স্থাপনা ছিল যা আজ বিলীন হয়ে গেছে।

বাড়িটা দেখে বি কে দাস রোড ধরে আবারও হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর সামনে এগোতেই আরো দুটি বাড়ি চোখে পড়ল। একটি দ্বিতল আরেকটি তিনতলা কি দারুণ কারুকার্য সেসব বাড়ি জুড়ে। বাড়িগুলোর বারান্দায় মূল আকর্ষণ। বিশাল বিশাল একেকটা বারান্দা যা দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। এক কথায় মন মাতানো সে সব বারান্দা। এসব বারান্দার যদি ভাষা থাকত তারা হয়ত তা প্রকাশ করতে পারত।

এরপর আবারো হাটা শুরু করলাম। গিয়ে থামলাম বিবিকা রওজার সামনে। ইমামবাড়া অর্থ হলো ইমামের বাড়ি, হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসেন (রা.) স্মরণে নির্মিত ভবন। রাজধানীর সবচেয়ে পুরনো ইমামবাড়া ঢাকার ফরাশগঞ্জের ‘বিবিকা রওজা’। যা নির্মিত হয় ১৬০০ সালে। যেটি পুরান ঢাকার ১৬৪২ সালে সুলতান সুজার শাসনামলে মীর মুরাদ হোসনি দালান প্রতিষ্ঠার আগেই নির্মিত। যদিও পুরানো সে অবয়ব এখন আর নাই, আধুনিকতার ছোয়ায় পুরানো স্থাপত্য শৈলী ঢাকা পরে গেছে অনেক আগেই। এখন ইতিহাস পাঠই একমাত্র এটাকে উপলব্ধি করায়।

বিবিকা রওজা দেখে আবারো সামনে হাটা শুরু করলাম। আমি মূলত বি কে দাশ রোড ধরে শ্যামবাজারের দিকে যাচ্ছি। বিবিকা রওজা দেখার পরই আরও কয়েকটি পুরাতন বাড়ি চোখে পড়ল। এসব বাড়ি গুলোর আনুমানিক বয়স একশত থেকে দেড়শত বছরের কাছাকাছি। এসব বাড়িগুলো এখন বিভিন্ন দোকান এবং দোকানের গুদাম ঘর হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। আমার যা ধারণা এসব রাস্তা ধরে পুরোটাই এমন পুরাতন বাড়িঘরে তার রূপ প্রকাশ করত কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ তা বিলীন হয়ে গিয়েছে। সেখানে ঠাঁই পেয়েছে বিশাল বিশাল অট্রালিকা।

আবারও হাঁটা শুরু করলাম। এবার গিয়ে বি কে দাশ রোডের শ্যামবাজার অংশে ঢুকলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল মঙ্গলালয় হাউজ। মঙ্গলালয় বাড়িটি ৬৫ বি কে দাস রোডে অবস্থিত। ১৯১৫ সালে জমিদার আশুতোষ দাস এটি নির্মাণ করেন। এটি ‘পুতুল বাড়ি’ নামেও পরিচিত। আশুতোষ দাসের পৌত্র দিলীপ কুমার দাস এটি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন। বাড়িটির কিছু অংশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। শ্যামবাজার তার পুরানো জৌলুস হারিয়েছি আরও বহু আগে। এখন আর আগের ব্যবসায়িক জৌলুস নেই তার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *