» আলমগীর বাদশার মৃত্যু রহস্য

গাল্পিক :

আলমগীর বাদশা মারা গিয়েছে।

অনেকদিন আগের কথা, তেতুঁল তলার পুকুরের বাঁধানো ঘাটের তালের গুড়ির নিচে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। গ্রামময় রাষ্ট্র হয়েছিল, দুষ্ট জীন তাকে মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছে।

এ কাহিনী এখন আর কারো মনে থাকার কথা নয়, পুত্র শোক ভুলে গিয়েছে আলমগীর বাদশার মা ফতি বেগম। মাঝে মাঝে তার মনে পড়ে আলমগীরের লাশ যখন পানি থেকে তুলে আনা হয়েছিল, তার গলার দুপাশে মোটা দুটি আঙুলের চাপ ছিল, গর্দানের দুপাশে ছিল আটটি নখের দাগ। তাকে হত্যা করা হয়েছে, এই কথা সকলেই বিশ্বাস করেছে, কোন মানুষ এমন নিষ্পাপ শিশুকে মেরে পানিতে ফেলে দিতে পারে এই কথা কেউ বিশ্বাস করলো না। বয়স্করা বলাবলি করতে লাগলেন, তেতুঁল গাছে দুষ্ট জীনেরা থাকে, এটা তাদেরই কাজ।

বাবা শহরে থাকেন, গ্রামের স্কুলে আমার পড়াশোনা হবে না বলে আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে এলেন। ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে আমাকে। থাকি বাবার সাথে। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। আলমগীর আর আমি একসাথে পড়তাম, সে ছিল আমার মাস ছয়েকের বড়। ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষার পরে সে মারা গিয়েছিল।

আমার মনে আছে, সে ভালো সাঁতার জানতো আর তার সাহসও ছিল বলিহারী। সাপের ভয়ে আমরা জোড় পুকুরের পানিতে পা ডুবাতাম না, অথচ সে নির্ভয়ে লাল শালুকের ফুল তুলে আনতো মাঝ পুকুর থেকে। তার গায়ে ধরে থাকতো বড় বড় জোঁক। সে হাতে থু থু নিয়ে অথবা প্যান্টের পকেট থেকে লবণ বের করে জোঁকের মুখে দিত, আর হাসিতে ফেটে পড়ে বলতো, শালারা আমার রক্ত খেয়ে পার পাবি না।

তখন বন্ধুত্ব বোঝার বয়স আমার হয়নি, কিন্তু আজ আমার মনে হয় আলমগীর মরেনি। সে আমার হৃদয়ে বেঁচে আছে।

বাবা বৃদ্ধ হয়ে অবসর নিয়েছেন। এখন তিনি গ্রামের নিয়মিত বাসিন্দা। পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন আর ঘরে ফিরে পেনশনের টাকায় কেনা বই পড়েন, এর মধ্যে জান্নাত লাভের সহীহ পথ টাইপের বইই বেশি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তাঁকে দেখা যায়।

আমি শহরে থাকি, গ্রামে আসি মা-বাবার সাথে সাক্ষাৎ করতে।

তেতুঁল তলা পুকুরের পাড়ে এখন আর তেতুঁল গাছ নেই, সেখানে সাউদী আরবের অর্থায়ণে সুরৌম্য এক মসজিদ হয়েছে। লোকজনের যাতায়াত বেড়েছে। তালের গুড়ি দিয়ে বাঁধানো ঘাটের স্থলে এখন পাকা শান বাঁধানো ঘাট। মসজিদের খানিক দূরে চা-মুদির দোকান খুলেছেন ফরিদ চাচা। পথের ধারে হওয়ায় কারণে অকারণে তার দোকানের সামনে দিয়ে যেতে হয়। তিনিও ডেকে নিয়ে চা সাধাসাধি করেন।

যতবার তার দোকানে গিয়েছি, প্রায় দেখেছি তিনি আলমগীর বাদশার মৃত্যুর ঘটনা বলে আহ! কত ভালো ছেলে ছিল বলে মন খারাপ করতেন। কখনো কখনো তার চোখের কোন আর্দ্র হয়ে উঠতো।

মাগরিবের নামাযের ওযু করতে গিয়ে আঙুল দেখিয়ে বলতেন, এই তো এখানেই আলমগীর বাদশার লাশ পাওয়া গিয়েছিল।

আলমগীর ফরিদ চাচার কেউ নন, সে মারা গেছে বছর ত্রিশ আগে, এতোদিন তার কথা মনে রাখার কোন কারণও ছিল না। কিন্তু ফরিদ চাচা তাকে ভুলেননি কেন এই প্রশ্ন আমার মনে আসতো কখনো সখনো। অবশ্য তাকে কখনো বলিনি।

ত্রিশ বছর পর আলমগীর বাদশা নানান প্রশ্নে বিদ্ধ করছে আমাকে, এসব প্রশ্নের আগামাথা নেই। সে যেন বলছে, জানিস, একটা অপমৃত্যু মামলা হতে পারতো, আমার মা অনেকদিন ধরে কাঁদতে পারতো, বাবা চুপ করে না গেলেই হতো।

গ্রীষ্মের শেষে গরমটা বিশ্রি রকমের বেশি হয়। দক্ষিণের জানালা খুলে শুয়ে আছি ছাদের ছোট ঘরটায়। বাবার লাগানো নারিকেল গাছটা জানালা পেরিয়ে হাত দুয়েক উপরে উঠেছে। নারিকেলের পাতায় চাঁদের আলো খেলা করে, আমার দেখে ভালো লাগে।

আমার চোখে ঘুম লেগেছে, কান জেগে আছে, কে যেন ডেকে বললো, বাহিরে মনোহারী চাঁদের আলো আর তুই রয়ে গেলি অন্ধকারে! হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। জানলায় তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছেন, বললেন, দেখতে এলাম জেগে আছিস কিনা?

বললাম, তুমি কি আমায় ডেকেছিলে, কিছু বলেছিলে?

মা বললেন, দেখলাম ঘুমিয়ে পড়েছিস তাই ডাকিনি!

— তাহলে কে বললো আমি অন্ধকারে পড়ে আছি, আমার ঘরে তো চাঁদের আলো খেলছে।

মা হেসে বললেন, বাহিরে আয়, মা বেটায় গল্প করি।

একথা সেকথার পর বললাম, মা, আলমগীর বাদশাকে মনে পড়ে তোমার।

মা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। সেদিন তুমি মাংস রান্না করেছিলে, তখন আমাদের এই রকম দোতলা বাড়ি ছিল না। ঘরে বাথরুম ছিল না, তুমি পুকুরে গোসল করতে যেতে। তুমি বলেছিলে, ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিস, আমার ফিরতে দেরী হবে। তুমি পুকুর ঘাটে গিয়েছিলে আরিফকে নিয়ে, তার শরীরে জলের গাদ পড়েছে, ঘষে গোসল করাতে হবে। আমি খেতে বসেছিলাম, তখন আলমগীর বাদশা দুটি কাকের ছানা নিয়ে আমাকে ডেকেছিল। আমি তাকে ঘরে বসতে বললে, সে বলেছিল, দেখে যা কী নিয়ে এসেছি।

আমি ভাতের থালা হাতে করেই বেরিয়ে এসে দেখি কুচকুচে দুটি কাকের ছানা তার হাতে। সে বললো, জলিল মিয়ার তাল গাছ থেকে পেড়ে এনেছি। খুব সুন্দর না। আমি তার সামনে বসে মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছি, সে ছানা দুটি নিয়ে তার পরিকল্পনা বলছিল। সে একটা বাঁশ নিয়ে আসবে তোমার কাছে, তুমি তাকে খাচা বানিয়ে দিবে।

রাতে তুমি জিজ্ঞেস করলো, আলমগীর কী নিয়ে এলোরে?

— দুটো কাকের ছানা। আগামীকাল বাঁশ নিয়ে আসবে, একটা খাঁচা বানিয়ে দিও।

— তাকে খেতে বলিস নি?

— না।

— তুই তো দিন দিন ছোট লোক হয়ে যাচ্ছিস।

— সে তো কাক নিয়ে খেলছিল। কাককে নাকি সে কথা শেখাবে!

রাতে আলমগীরের কাকের ছানা দুটি বিড়ালে খেয়েছিল। সে অনেক কেঁদেছিল। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, আবার যখন মাংস রাঁধবে তাকে ডেকে নিয়ে আসবো।

কাকের ছানাকে কথা শেখানো হয়নি আলমগীরের, মাংস রান্না করে দাওয়াত করে খাওয়াতে পারিনি তাকে। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি জানি, মা হয়তো কাঁদছেন, আমি তার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি।

ফরজের নামাযের পর মসজিদে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন ফরিদ চাচা, আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু বলবে?

হ্যাঁ।

তিনি কুরআন শরীফ তুলে রেখে বাহিরে আসলেন, মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলা নিষেধ। আমরা পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, আলমগীরের লাশ তো পানি থেকে আপনিই তুলেছিলেন?

তিনি বললেন, হ্যাঁ।

সে তো সাঁতার জানতো।

তাকে পাওয়া গেছে তালের গুড়ির নিচে, কাঁদা চাপা দেওয়া ছিল।

আপনি কি জানতেন, লাশ এখানেই ছিল?

আমার প্রশ্ন শুনে তিনি চমকে উঠলেন। পরে সামলে নিয়ে বললেন, না, আমি জানতাম না। আমি মাঠে ছিলাম। মাগরিবের আযানের আগে গোরু নিয়ে ফিরেছি। এসে শুনলাম, আলমগীর বাদশাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবলাম, সে কোথাও হয়তো গিয়েছে। ছেলে ধরায় নেওয়ার মতো বয়স তো তার ছিল না। তাই তেমন গুরুত্ব দেইনি। গোয়ালে গোরু বেঁধে আমি মাগরিবের ওযু করতে এই ঘাটে এলাম। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, তখন এই ঘাট পাকা ছিল না। তাল গাছের টুকরো ধাপে ধাপে সাজিয়ে ঘাট বাঁধানো হয়েছিল। তখনো দিনের আলো নিভে যায় নি, সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে।

আমি ওযু করতে বসে লক্ষ্য করলাম বড় একটা কচ্ছপ কী জানি কামড়ে টানাটানি করছে। আমি তামশা দেখতে লাগলাম। হঠাৎ মনে হলো মানুষের মতো। বুকের ভেতর কেমন করে উঠলো, আলমগীর নয় তো? ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে, কোলে করে তুলে আনলাম উপরে। তখন আলমগীরের ফুফাতো ভাই কাশেম কোথা হতে দৌঁড়ে এসে ভাইরে বলে আমার কাছ থেকে তাকে নিয়ে গিয়েছিল।

আমি ভাবছি, ছোট ছিলাম বলে আলমগীরের লাশ দেখতে দেয়নি আমাকে। ক্ষণেক চুপ করে থেকে বললাম, সে তো সাঁতার জানতো, পানিতে ডুবে তো তার মরার কথা নয়?

— সবাই বলে তেঁতুল গাছের দুষ্ট জীনে তাকে মেরেছে।

— আপনি কি এই কথা বিশ্বাস করেন?

তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ক্ষণেক পরে বললেন, চলো আমার দোকানে নাস্তা করবে আজ। মধু ছেলেটা ভালো পরোটা ভাজে।

আমার নাস্তা করতে ইচ্ছে করছিল না। তবু তার সাথে গেলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, ফরিদ চাচা আলমগীরের মৃত্যু রহস্য জানেন।

এই ফাঁকে বেশ কিছুদিন কেটেছে। আলমগীর বাদশার কথা আবারও ভুলে গেছি। মনে হলো, ত্রিশ বছর আগে যে চলে গেছে তাকে নিয়ে সময় নষ্ট করা বা অযথা হৈচৈ করা কোন কাজের কথা নয়।

কিন্তু ইচ্ছে করলেই সব ভুলে যাওয়া যায় না। অথবা ভুলে যাওয়া কথাটাও কখনো মনের মাঝে এমনভাবে জেগে উঠে তাকে আর মন থেকে সরানো যায় না।

আজ সকালে আমি ঢাকায় চলে যাবো বলে স্থির করেছিলাম। মা বললেন, আর দুটো দিন থেকে যা, তোর বড় ফুফু আসবে কাল দেখা করে যাস।

আমি বললাম, তাহলে ছোট ফুফুকেও ফোন করে দাও দুজনেই আসুক।

দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিতে হয়। মা বলেন, দুপুরের খাওয়ার পর একটু ঘুমালে নাকি শরীর ভালো থাকে। কিন্তু দিনে ঘুমানো আমার পছন্দ নয়। এই জন্য একটা বই নিয়ে শুয়ে শুয়ে পড়তে লাগলাম।

একটা মেয়ে এসেছে। মেয়েদের বয়স অনুমান করা আমার সাধ্য নয়, তাই এই নিয়ে ভাবিও না। তবে মেয়েটি রূপবতী। সে বললো, ভাইয়া আপনাকে একটু বিরক্ত করবো।

— বেশি জরুরী?

— না, তেমন নয়। বাবা অসুস্থ, আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।

— তোমার বাবার নাম কী?

— আমাকে চিনেন না, আমি আপনার ফরিদ চাচার মেয়ে।

আমি লজ্জা পেলাম। ফরিদ চাচার মেয়েকে না চেনার কথা তো নয়, চিনবোই বা কী করে, আমি তো গ্রামেই থাকি না।

মাগরিবের পরে ফরিদ চাচার সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি খুবই অসুস্থ, তারপরও উঠে বসলেন। বললেন, কখন মরে যাই তার ঠিক ঠিকানা নেই। কথাটা তোমাকে বলেই যাই। মনুষ্য বসতির ভেতর জীন থাকে না। হাদিস শরীফে আছে জীনেরা থাকে বিরান ভূমিতে। তারপরও মাঝে মধ্য দুএকটা এসে পড়ে জনবসতিতে।

ফরিদ চাচার মেয়ে চা দিয়ে গেলেন, আমরা দুজনে চা পান করছি। ফরিদ চাচা বলে চলেছেন, আলমগীরের লাশ আমিই গোসল দিয়েছি। তার শরীর হতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। এটা জীনের কাজ নয়, কোন মানুষই এমন কাজ করেছে।

আমি হতবাক হয়ে চাচার কথা শুনতে লাগলাম। তিনি বলছেন, আলমগীরের মত্যু রহস্য আমি জানি না। তবে আমার ধারনা ঘটনা তাদের নিজের লোকেই করেছে।

আলমগীরের বাবা গফুর অনেক সম্পত্তি নষ্ট করেছে, পিতৃ সম্পত্তির যা অবশিষ্ঠ ছিল বন্টন হলে তার ভাই আর বোনেই সব নিয়ে যেতো। আলমগীরের মৃত্যুর পর গফুরের বোন তার অংশ গফুরকে লিখে দিয়েছিল। বাবা, তুমি বুঝবে, ত্রিশ বছর আগে হলেও লাখ টাকার সম্পত্তি কেউ কাউকে এমনি লিখে দেয় না।

গফুর চাচার কথা শুনে আমি স্থির থাকতে পারলাম না, মাথা কেমন ঘুরতে লাগলো। আমি তার ঘর থেকে বের হয়ে চলে এলাম। তার প্রতি প্রচণ্ড রাগ হলো আমার, সব বুঝেও তিনি চুপ করে রইলেন কেন?

ঢাকায় ফেরার পর একদিন আমার নাম্বারে একটা কল এলো, লোকটা তার পরিচয় বলেনি। সে একটানা কথা বলে গেলো, আমাকে কিছু বলার সুযোগও দেয়নি। তার কথা হচ্ছে, অযথা ত্রিশ বছর আগের একটা ঘটনা নিয়ে মাথা গামানোর প্রয়োজন নেই। বেশি ঝামেলা করলে আমাকে আর গফুর চাচাকেই ফাঁসানো হবে।

আমার মোবাইলে কল রেকর্ডিং চালু ছিল। আমি নাম্বারটি ফেসবুকে সার্চ দিয়ে একটা প্রোফাইল খুঁজে পেলাম। লোকটার নাম কাশেম খান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *