– প্রত্যয় মানে কী? – সকালবেলা বইখাতা নিয়ে হাজির বুতান আর মান্তু। আজ ওদের স্কুল ছুটি।
– প্রত্যয় শব্দের মানে হল বিশ্বাস। তবে তোরা বোধ হয় ব্যাকরণের প্রত্যয় সম্বন্ধে জানতে চাইছিস। ধর, তোদের একটা চৌকো কাগজ দিলাম। তোরা ওই কাগজে কোনাকুনি একটা কাঠি লাগিয়ে আর একটা কাঠি কিছুটা গোল করে ওই কাগজের এপাশ থেকে ওপাশে লাগিয়ে নিলি। তাহলে কী হবে?
– ঘুড়ি। – মান্তুর চটজলদি জবাব।
– ঠিক। তার মানে আগে ছিল কাগজ আর কাঠি লাগানোর পর হয়ে গেল কাগজের ঘুড়ি। আবার এরপর একটা কাগজের লম্বা লেজ যদি লাগিয়ে নিস তাহলে হয় যাবে লেজওয়ালা কাগজের ঘুড়ি। প্রত্যয়ও ঠিক তেমনি। এক বা একাধিক বর্ণকে কোন শব্দ বা ধাতুর শেষে লাগিয়ে দিলেই আমরা অন্য একটা নতুন শব্দ বা ধাতু পেয়ে যাব। আর এই এক বা একাধিক বর্ণকে ব্যাকরণে প্রত্যয় বলে।
– বুঝেছি। যেমন ধর, ‘লোক’ শব্দের পর যদি ‘টি’ বসাই তাহলে এই ‘টি’ হল প্রত্যয়। – বুতান বলে।
– না। নতুন শব্দ হল কোথায়? ‘টি’ যোগ করে একজন বিশেষ লোককে বোঝানো হল। তোদের তো আগে বলেছিলাম যে এগুলো হল নির্দেশক। আচ্ছা, দোকান শব্দের মানে তো বিপণি অর্থাৎ যেখানে জিনিসপত্র কেনা বেচা হয়। এর সঙ্গে ‘দার’ যোগ করে দে। হয়ে গেল ‘দোকানদার’। অর্থাৎ দোকানের মালিক বা যে দোকানে বিক্রি করছে। ‘দার’ শব্দটা যোগ করাতে কিন্তু মানেটাই গেল বদলে। ‘দার’ এখানে প্রত্যয়। যদিও ‘দার’ শব্দের একটা অন্য মানে আছে। তা হল পত্নী। তবে এখানে কিন্তু সে অর্থে ‘দার’ শব্দ আসেনি। আসলে প্রত্যয়ের আলাদা অর্থ যেমন হয় না, তা আলাদা করে ব্যবহারও করা যায় না।
– বুঝেছি। প্রত্যয় হল বিভক্তি। আলাদা করে তা ব্যবহার করা যাবে না। – এবার মান্তু।
– না, প্রত্যয় আর বিভক্তির মধ্যে এটুকুই মিল। দুটোরই আলাদা ব্যবহার নেই আর দুটোই শব্দের পরে বসে। কিন্তু প্রত্যয় যা পারে বিভক্তি তা পারে না। প্রত্যয় নতুন শব্দ তৈরি করে আর বিভক্তি ওই শব্দটাকে বাক্যে ঢোকার অনুমতি দেয়। তাই শুধু প্রত্যয় লাগিয়ে নতুন শব্দ তৈরি করা যেতেই পারে কিন্তু বিভক্তি লাগালে তবেই তা তোরা বাক্যে ব্যবহার করতে পারবি। অর্থাৎ প্রত্যয়ের পরেও তোরা বিভক্তি লাগাতে পারবি। আবার একটা প্রত্যয়ের পর আবার একটা বা একাধিক প্রত্যয় লাগানো যাবে। কিন্তু বিভক্তি লাগাবার পর আর প্রত্যয় যোগ করা যাবে না।
– উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দাও না, দাদু।
– লোক শব্দের পর ‘ষ্ণিক’ প্রত্যয় লাগানো হল। লোক+ষ্ণিক = লৌকিক। তোরা তো জানিস ‘লোক’ মানে মানুষ আর তা হল একটা বিশেষ্য পদ। এরপর ‘ষ্ণিক’ প্রত্যয় লাগিয়ে একটা বিশেষণ পদ আমরা পেয়ে গেলাম, ‘লৌকিক’। যার মানে মানুষ সম্বন্ধীয়। এর সঙ্গে আবার যেই ‘তা’ যোগ করলি আবার একটা নতুন শব্দ পেয়ে গেলাম। ‘লৌকিকতা’। এই শব্দটা কিন্তু আবার বিশেষ্য পদ হয়ে গেল। ওই যে অনেক সময় তোরা দেখেছিস বিয়ের কার্ডে লেখা থাকে “লৌকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদ চাই” এখানে লৌকিকতা শব্দের পর একটা বিভক্তি লাগানো হয়েছে।
– দাদু, তুমি তো বললে ‘লোক+ষ্ণিক’, তাহলে ‘লোকষ্ণিক’ না হয়ে ‘লৌকিক’ হল কী করে? – বুতান ব্যাখ্যা চায়।
– প্রত্যয় যোগ করলে কখনও কখনও আদি স্বরের বৃদ্ধি হয় তা তোদের আগে বলেছি। তাই ও বৃদ্ধি পেয়ে হয়ে গেল ঔ। আর ধাতু বা শব্দে প্রত্যয় যোগ করলে অনেক সময়ই প্রত্যয়ের কিছু অংশ লোপ পায় আর বাকি অংশ শব্দ বা ধাতুর সঙ্গে যোগ হয়ে যায়। প্রত্যয়ের যে অংশটুকু লোপ পায় তাকে ‘ইৎ’ বলে। ফলে আমরা পেলাম লোক+ষ্ণিক = লৌকিক।
– তার মানে মাঝের যে ‘ষ্ণ’ বাদ গেল সেটাই ইৎ। – বুতানের জিজ্ঞাসা।
– ঠিক তাই।
– সে তো বুঝলাম। তাহলে ‘কুরু’ শব্দ থেকে ‘কৌরব’ হয় কী করে? এখানে ‘ষ্ণিক’ প্রত্যয় নেই নিশ্চয়ই। – মান্তুর আগ্রহও কিন্তু কম নয়।
– না। তুই ঠিক বলেছিস। এখানে ‘অ’ প্রত্যয় লাগানো হয়েছে। কুরু+অ = কৌরব। এবার হয়তো জিজ্ঞেস করবি কুরু থেকে ‘কৌরু’ না হয়ে কৌরব হল কেন? এ হল স্বরের গুণ। প্রথম স্বর যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি পরের স্বরের গুণ প্রকাশ পেয়েছে। মনে রাখিস ই বা ঈ থাকলে এ-কার (অথবা ‘অয়’) হয়, আর উ বা ঊ থাকলে ও-কার (অথবা ‘অব’) হয়। তাই ‘কুরু’ শব্দের গোড়ার উ বৃদ্ধি পেয়ে হয়ে গেল ‘ঔ’ আর শেষের ‘উ’-এর গুণ প্রকাশ পেয়ে হয়ে গেছে ‘অব’।
– তাহলে সুষ্ঠ থেকে সৌষ্ঠব হল কেন? – এবার বুতানের প্রশ্ন।
– আসলে সুষ্ঠ শব্দটাই ভুল। সঠিক শব্দটা হল ‘সুষ্ঠু’ আর তাই সুষ্ঠু+অ = সৌষ্ঠব। ওই শেষের উ হয়ে গেছে ‘অব’।
– এবারে প্রত্যয় কত রকমের হয় তা বলি। প্রত্যয় তিন রকমের হয়। কৃ-প্রত্যয়, তদ্ধিত-প্রত্যয় আর ধাত্ববয়ব প্রত্যয়। ধাতুর পরে প্রত্যয় লাগিয়ে একটা নতুন শব্দ পাওয়া গেলে সেই প্রত্যয়কে বলে কৃ-প্রত্যয়। একটা উদাহরণ দিই। চল্ ধাতুর সঙ্গে ‘অন্ত’ প্রত্যয় যোগ করলে আমরা চলন্ত শব্দটা পাব। তাহলে এখানে ‘অন্ত’ হল কৃ-প্রত্যয়। আবার ধর (ধাতু) গম্ + তব্য = গন্তব্য অথবা (ধাতু) গম্ + ক্তি = গতি। তাহলে দেখ গম্ ধাতু থেকে কৃ-প্রত্যয় লাগিয়ে আমরা গন্তব্য আর গতি এই দুটো নতুন শব্দ পেয়ে গেলাম।
আর যদি শব্দের পর কোন প্রত্যয় লাগিয়ে নতুন শব্দ তৈরি করা যায় তাহলে সেই প্রত্যয়কে আমরা তদ্ধিত-প্রত্যয় বলব। যেমন, রাধা+ষ্ণেয় = রাধেয়, আড়ত+দার = আড়ততার। এই ‘ষ্ণেয়’ বা ‘দার’ হল তদ্ধিত-প্রত্যয়।
আর ধাত্ববয়ব প্রত্যয় হল সেগুলো যা আমরা কোন ধাতু বা শব্দের পরে লাগিয়ে নতুন একটা ধাতু পেয়ে যাব। যেমন, কর্ (ধাতু) +আ = করা, বিষ (শব্দ) +আ = বিষা। যাহারা তোমার ‘বিষাইছে’ বায়ু – এখানে লক্ষ কর আমরা ‘বিষ’ শব্দের সঙ্গে একটা প্রত্যয় লাগিয়ে একটা নতুন ধাতু তৈরি করে নিয়েছি। তাই এখানে ‘আ’ প্রত্যয়টা ধাত্ববয়ব প্রত্যয়। মনে রাখিস প্রত্যয় যেমন সংস্কৃত প্রত্যয় আছে তেমনি আবার অনেক বাংলা প্রত্যয়ও আছে। সে এক বিরাট তালিকা। তবে মূল ব্যাপারটা যদি বুঝতে পারিস তাহলেই যে কোন প্রত্যয় তোরা দেখলেই ধরে ফেলতে পারবি।