বাংলাদেশের বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শিকারপুরে ‘উগ্রতারা’ দেবীর একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে। সম্ভবত এটি বাংলাদেশের একমাত্র উগ্রতারা দেবীর মন্দির এবং এখানে প্রাপ্ত দেবীমূর্তিটি বাংলাদেশের একমাত্র উগ্রতারা মূর্তি যা দ্বাদশ শতকের পূর্বেকার সময়ের একটি নিদর্শন।
হিন্দুপুরাণে দেবী দুর্গার দশটি রূপকে দশমহাবিদ্যা বলা হয়। এঁরা হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। দ্বিতীয় মহাবিদ্যা তারার আটটি রূপ হল তারা, শ্রীমদেকজটা, উগ্রতারা, নীলসরস্বতী, মহোগ্রাতারা, বজ্রতারা, ভদ্রকালী, কামেশ্বরী অর্থাৎ তারাদেবীরই একটি বিশেষ রূপ হলেন ‘উগ্রতারা’।
মন্ত্রমহোদধিতন্ত্র অনুযায়ী দেবী উগ্রতারা অসীম জলের উপর স্থিত একটি শ্বেতপদ্মের উপর দণ্ডায়মান। দেবী চতুর্ভুজা, চারটি হাতে রয়েছে কৃপাণ, অসি, নীলপদ্ম ও মরার খুলি। দেবীর তিনটি রক্তবর্ণ চক্ষু আছে। সর্বাঙ্গে নীলাভ সর্প অলংকারের মত শোভিত। কেশ একটিমাত্র বেণীতে বদ্ধ। দেবী তাঁর দাঁত দিয়ে জিহ্বা চেপে রেখেছেন। কণ্ঠে মুণ্ডমালা, ভ্রূযুগল সাদা বর্ণের হাড় দ্বারা সজ্জিত এবং পদতলে শবদেহ। দেবীর শিরোপরে মহাদেব। বাংলাদেশের প্রত্নচর্চার অগ্রপথিক নলিনীকান্ত ভট্টশালী মনে করেন শিকারপুরের তারামূর্তিতে উগ্রতারার অধিকাংশ লক্ষণ বিদ্যমান। শিকারপুরের তারামূর্তিতে তারাদেবীর শিরোপরে পাঁচটি ক্ষুদ্রাকৃতির মূর্তি দেখা যায়। কেন্দ্রে শিব, দুই পাশে কার্তিক, গণেশ ও ব্রহ্মা। অবশিষ্ট জন সম্ভবত বিষ্ণু।
দুর্ভাগ্যবশত প্রাচীন এই মূর্তিটি হারিয়ে গেছে। বর্তমানে মন্দিরে অনুরূপ একটি নূতন মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। হারানো মূর্তিটির একটি ছবি রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক প্রকাশিত “Iconography of Buddhist and Brahmanical Sculptures in the Dacca Museum” গ্রন্থে। বইটিতে শিকারপুরের মূর্তিটিকে ‘Unique image’ অর্থাৎ অনন্য মূর্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমার জানা নেই বাংলাদেশে আর কোন সংগ্রহশালায়/জাদুঘরে/মন্দিরে উগ্রতারা দেবীর মূর্তি আছে কি না, কারও জানা থাকলে জানাবেন দয়া করে। কেননা, বিষ্ণু শিব বা দুর্গামূর্তির মত উগ্রতারার প্রস্তরীভূত বিগ্রহ সুলভ নয়। উগ্রতারা গৃহপূজ্য দেবী নন, তাঁর সাধনা গুরুমুখী, গুহ্য ও গুপ্ত।
কয়েকটি গ্রন্থমতে দক্ষিণবঙ্গে দেবী সতীর নাসিকা পতিত হয় এবং সুগন্ধা নদীর তীরে সেই স্থানটি একান্নপীঠের অন্যতম সুগন্ধা শক্তিপীঠ। প্রচলিত লোকমতানুসারে শিকারপুরের উগ্রতারা মন্দিরই সতীর সুগন্ধাপীঠ। তবে এখানে সতীর প্রস্তরীভূত অঙ্গ কোথায় আছে তা কেউ জানে না। আবার বর্তমান সুগন্ধা নদীর অবস্থানও শিকারপুর থেকে দূরে। বর্তমান শিকারপুর সন্ধ্যা নদীরে তীরে অবস্থিত। কিছু উৎসে দেখা যায় প্রাচীন সুগন্ধা নদী এখন আর নেই, সুগন্ধার পরিত্যক্ত খাত বা সুগন্ধার সংক্ষিপ্ত নামই সন্ধ্যা। একটি মতে, সুগন্ধার উত্তরসূরী নদী কালিজিরা। কালিজিরার সঙ্গে কীর্তনখোলা যুক্ত হওয়ার পর মিলিত প্রবাহটি ‘সুগন্ধা’ নামে পরিচিত যা বর্তমানে ঝালকাঠি জেলায় পড়েছে।
উগ্রতারা দেবীর দর্শন করতে চাইলে ঢাকা থেকে বরিশালগামী বাসে উঠে ইচলাদী বাসস্ট্যান্ড নামতে হবে। সেখান থেকে অটো বা রিক্সায় করে ‘তারাবাড়ি’।