কাব্যি করে ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ লাগতেই পারে, কিন্তু একটা মানুষ ক্ষুধায় নিজের নৈতিকতা বিসর্জন দিতে পারে কি?
এ নিয়ে ভুরি ভুরি লেখা আছে। কিন্তু সাধারণ মানব মনস্তত্ত্বে এর খোঁজ এমন একজন নোবেলপ্রাপ্ত লেখক করেছেন, যার লেখার মধ্যে দিয়ে এক বিষন্ন খোঁজে যেতে যেতে আমিও এই বিতর্ক থেকে সরে আসতে পারছিলাম না।
উপন্যাস ন্যুট হ্যামসুনের ‘ক্ষুধা’ তথা ‘Hunger’.
উপন্যাসটিকে আধুনিক ধারার উপন্যাসগুলির মধ্যে একটি প্রধান সাহিত্যকর্ম বলে ধরা হয়। এটি পরবর্তীকালে জেমস জয়েস কিম্বা কাফকা থেকে কাম্যু এবং কেলম্যান পর্যন্ত সাহিত্যিকদের গল্প উপন্যাসকে প্রভাবিত করেছে। মনোজগতের এক বিষন্নতা, আমার পড়তে পড়তে, সত্যিই কোথাও কাফকাকে মনে পড়ে যাচ্ছিল।
যে উপন্যাসের লেখক নোবেল পুরস্কার পান তার লেখার বাঁধুনি কিম্বা সৃষ্টিধারা নিয়ে আলোচনা করা আমার কাছে খানিকটা বাড়াবাড়িই লাগে। বিশেষত, ইদানীং, অনেক বাঙালী পাঠক, লেখক, এমনকি ইন্টালেকচুয়াল গোষ্ঠী মনে করেন, নোবেল, বুকার, পুলিৎজার ইত্যাদি পুরস্কারের সাথে কেবল এবং কেবলমাত্র রাজনীতি মিশে আছে, কিম্বা, এরকম একটা পুরস্কার সাহিত্যের মানদণ্ড হতে পারে না; জানি না, তাদের কাছে ‘আঙ্গুরফল টক’ বলে মনে হয়, না কি, ঈর্ষা, যেমনটা হতে দেখলাম বাংলাদেশের কিছু ক্রিকেটপ্রেমীদের ক্ষেত্রে; তারা অস্ট্রেলিয়াকে সাপোর্ট করার একটাই কারণ দেখতে পেল, কারণ, তাদের মনে হয়েছিল, ভারত তাদের সাথে ক্রিকেটে অন্যায় করছে, কিম্বা, তারা সুযোগ সুবিধা নিয়ে এই বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেছে অপরাজিত থেকে। যাই হোক, সে অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু মানসিকতাটা খানিকটা সংকীর্ণ বলে আমার বোধ হয় এবং এটা পূর্বাপর উদাহরণের একটা বড়ো কারণ।
আমাদের সাহিত্য, বর্তমানে আঞ্চলিক হয়েই রয়েছে, সার্বজনিক কিম্বা বিশ্বজনীন হয়ে উঠতে পারছে না। কিন্তু তবুও, ওই মানসিকতার মধ্যে বাস্তবিকতা খানিকটা থাকলেও, সারা বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুর্লভ লেখাগুলোর অনেক কিছুই আমাদেরকে এমন একটা প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না। তা আর আঞ্চলিক থাকে না। কিম্বা আঞ্চলিক পুস্তকের মধ্যে থেকে আমাদেরকে বের করে কোথাও এমন কিছু চিরায়ত সমস্যার মধ্যে ফেলে দেয়, যা কোন গন্ডী নিরপেক্ষ।
প্রশ্নটি হল, আমাদের ‘মানবতাবাদ’-এর অগ্রগতি কোন পথে?
এই উপন্যাসের মধ্যেও সেই খোঁজ একটা সময় আমাকে বড়ো ক্লান্ত করে তুলেছিল। উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট চরিত্রটি একজন লেখক। এবং সেই লেখক যখন অস্লো শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, সম্পূর্ণ কপর্দকহীন হয়ে, সে জানে না, সে কি করবে। এক টুকরো রুটির জন্যে সে চুরি-ডাকাতি করবে, না কি একপেট বীভৎস ক্ষুধা নিয়ে মৃত্যুর দিকে এগোবে, কিন্তু, তবুও, অমানবিক হবে না।
এই দ্বন্দ্বের মধ্যে আমি কখনও পড়ি নি। আমার দুবেলা ভাত জোটে। ভাতের সাথে খুব ভাল ভাল খাবারও। আমার বাড়ীতে এমন কোনদিন হয় নি যে, সকালের আমার বাবা-মা জানেন না, বিকেলে আমাদের কি খাওয়াবেন। কিম্বা আমি সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হই নি। ফলে এই বিতর্কে আমার স্থান সে অর্থে নেই।
কিন্তু তবুও, ভাবনাটা আমার মাথার ভেতর থেকে যায় না। আজ প্যালস্তাইনে কয়েক কোটি মানুষ খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। রেশনের জন্যে সেখানে মানুষে মানুষে লড়াই। কিম্বা ইউক্রেনের বাস্তুহারা মানুষের চোখ আকাশের দিকে, পথে প্রান্তরে ধুলোঢাকা গাড়ীর দিকে। কখন একবেলার রেশন এসে পৌছবে। শুনেছি, বাহাত্তরের বাস্তুহারারা দণ্ডকারণ্যে কিম্বা যশোর রোডের ধারে ধারে এমনিই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। রোহিঙ্গারা এখনও দাঁড়িয়ে থাকে।
এর মধ্যে থেকে কিছু মানুষ অসামাজিক হয়, কিছু মানুষ মাথা তুলে দাঁড়ায়। এই দুইয়েরই একই শক্তি, কেবল অভিমুখ ভিন্ন। যে শক্তিতে একজন মানুষ বন্দুক তুলে নেয়, যে শক্তিতে একজন মহিলা রাস্তায় সেজেগুজে এসে দাঁড়ায়, সেই এক শক্তিতেই একজন মানুষ যথাসময়ে তিনতলা বাড়ি হাঁকায়, কিম্বা অনেকের জন্যে গলা তোলে অধিকার আদায়ের দাবীতে। এক শক্তি, তার রূপ বহু।
এই বহু রূপের খোঁজ এই উপন্যাস জুড়ে। একজন মানুষের মধ্যেই কখনও বিশ্বাসঘাতকতার বোধ জাগে; একই মানুষের মধ্যে নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রী করে ভিখারীকে দিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা জাগে; একই মানুষের মধ্যে এই ভিন্ন শেড, এক শহরের জন অরণ্যের মধ্যে জেগে থাকে।
আর এর মধ্যেই প্রশ্নটা নিয়ে জেগে থাকেন নরওয়েজিয়ান লেখক ন্যুট হ্যামসুন।
ক্ষুধা: ন্যুট হ্যামসুন
অনুবাদ: সৌরিন নাগ