রাষ্ট্র সংস্কারের বয়ান কার্যত একটি ফাউ আলাপ।
এখানে রাষ্ট্র সংস্কার বলতে বোঝানো হচ্ছে কিছু আইনের রদবদল, রহিত ও সন্নিবেশ; বিদ্যমান সংবিধানে সংশোধনী। প্রশাসনিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বে থাকা স্বৈরাচার সরকারের তাঁবেদারদের উচ্ছেদ বা অপসারণ। তাতে যে ফল পাওয়া যাবে তা সাময়িক এবং চলমান অস্থির সময়ের দুর্বিনীত আবেগের অবসান। দীর্ঘমেয়াদি বৈষম্য নিরসনে সেটি কার্যকর হওয়ার আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নবিলাস। রাষ্ট্র পরিচালনায় বিধিবিধান একটি ঠুনকো বিষয়, চাইলেই স্বল্প মূল্যে এটি পরিবর্তন করে নেওয়া সরকারের জন্য মামুলি বিষয়।
বিগত সরকারের আমলে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের মজমা বসিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের জিকির তোলা হয়েছিল। সেটির প্রেক্ষিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যেমন বিশেষ আইন তৈরি করা হয়েছিল, কাছাকাছি সময়ে হাত খুলে লুটপাটের জন্য বিদ্যুৎ খাতের ওপর ইনডেমনিটিও দেওয়া হয়েছিল। শাহবাগ থেকে তথাকথিত সংস্কারের হাইপ যা করতে পেরেছিল, তা হলো জাতির মধ্যে মোটা দাগে বিভাজন। এর সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার হেন অপকর্ম নেই যা করেনি। এখন যদি নতুন করে আবার আরেক ধরনের মেরুকরণ হয় তাহলে লাভটা কী?
পলিথিন মানবসম্পদ এবং সভ্যতার জন্য এক অভিশাপ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়েছিল। সেই আইন বাতিল হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু পলিথিন ব্যাগ এখনো যে কোনো স্বৈরশাসকের চেয়েও সদম্ভে তার রাজত্ব সুসংহত করে রেখেছে। তাহলে আইন করে লাভটা কী? যে সকল আইনে শাসকের গদি মজবুত হয় সেগুলো খুঁজে খুঁজে প্রয়োগ করা হয়, বাকিগুলোর দিকে কেউ ফিরেও চায় না। একজন ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না, একই ব্যক্তি সরকার এবং দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবে না টাইপের চটকদার আলোচনা শুরু হয়েছে। হুঁ, এমন বিধান করা যেতেই পারে। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভ্লাদিমির পুতিন বা রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের মতো কেউ ক্ষমতায় এলে এক তুড়িতে সেসব বিধান ওয়েস্ট বিনে পাঠিয়ে দিতেও সময় লাগবে না।
তাহলে কি এভাবেই চলতে থাকবে, সংস্কার কি হবে না, পরিবর্তন আসবে না? কোন তত্ত্ব প্রয়োগ করলে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে? আমাদের শুধু নয়, হাতে গোনা দুয়েকটি ছাড়া বিশ্বের সব দেশেই ইজম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। কোন ইজমে দেশ সাজালে আমরা নির্বিঘ্নে এগোতে পারব? উত্তর, কোনো ইজমে নয়। যারা বিভিন্ন মতবাদ, আদর্শের কথা বলে রাজনীতি করেন, ক্ষমতায় আরোহণ করে সেই মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চান – এগুলো যে অকার্যকর সম্ভবত তারা নিজেরাও তা উপলব্ধি করেন না। ইতোপূর্বে ইজমভিত্তিক অনেক রাষ্ট্রকে অকার্যকর হতে দেখেছি। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে ইজম নয়, পলিসি প্রয়োজন। গ্রেট ব্রিটেনের মতো রাষ্ট্র সংবিধান ছাড়াই চলছে যুগের পর যুগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো ইজম ছাড়াই নাগরিক সুবিধার সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। ইউরোপের দেশগুলোতে সরকার পরিবর্তন হলেও সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাপনে বড় কোন হেরফের হয় না।
উমুকে এইট পাশ, তমুক ইংরেজি পারে না, উনার চোদ্দোটা ডক্টরেট, ইনারা তুখোড় অ্যাকাডেমিশিয়ান, রাজনীতিতে এগুলি ফালতু আলাপ। রাষ্ট্র পরিচালনায় এসবের কোনো কার্যকারিতা নেই। কল্যাণ রাষ্ট্র গড়তে হলে এর অন্যতম উপাদান জনগণের সংস্কারের দিকে নজর দিতে হবে। জনগণের মন ও মননে নৈতিক পরিবর্তন আনতে না পারলে সব ধরনের সংস্কার কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। অনেকে বলতে পারেন, জনগণ জেগে উঠেছে। আমি সেটি মনে করি না। বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান, এটি দীর্ঘদিনের দলন-পেষণে থাকা উত্তপ্ত লাভার অগ্নুৎপাত, ইলাস্টিসিটি ফেইলিউর। আমরা নিশ্চয় চাই না, দশ-পনের-পঁচিশ বছর পর পর একটা করে গণবিস্ফোরণ হোক আর হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যাক, সম্পদ বিনষ্ট হোক?
কোনো ব্যবস্থাই নিশ্ছিদ্র নয়, সমাজে অপরাধ প্রবণ মানুষের সংখ্যাও কম না। তবে রাজনৈতিক দলগুলো, বিভিন্ন সংস্থা, সমিতি যদি কার্যকর উদ্যোগ নেয়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব। মুশকিল হলো, যাদের এই সংস্কারের কান্ডারি করা হবে, লোক দ্যাখানো ছাড়া গুণগত কোনো পরিবর্তন তারা নিজেরাও চাইবে না। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের মানুষ দিনশেষে নিজ স্বার্থের আঠারো আনার হিসাব মেলাতে চায়; তাই এখানে সংস্কার/মেরামত নিয়ে আলাপের খই ফুটলেও জমাট বাঁধে না কখনো।