“Climate change is like death, no one wants to talk about it.”
‘Exploitation’ শব্দটা আমাকে মাঝে মাঝে বড়ো অতিষ্ঠ করে তোলে। আমরা, সুযোগ পেলেই, প্রতিদিন, কীভাবে যে শোষণ করতে পারি, তা বলে বোঝানো দুষ্কর। এই শোষণ কি শুধুই মানুষের প্রতি মানুষের? না তো! মনুষ্যেতর জীবের প্রতি, এমনকি আমাদের পরিবেশের প্রতিও। শোষণ ‘মানুষ’ জীবটার দৈনন্দিন জীবনের একটা বড়ো পারিচালক মাধ্যম হয়ে পড়েছে। খুঁটিনাটিভাবে প্রতিটা মানুষের আচরণ দেখলে মনে হওয়া অসম্ভব নয় যে, Exploitation, বর্তমানে, শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মতোই, আমাদের জীবনে অপরিহার্য, বেঁচে থাকার জন্য।
এই Exploitation –এর সবচেয়ে বড়ো শিকার, পরিবেশ। ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ বড়ো বালাই। সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক কিছু আবেদন, নিবেদন, বাদ-প্রতিবাদ হয়ে চলেছে। আশানুরূপ লক্ষণ কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রয়াত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস তো মৃত্যুর কয়েক মাস আগে একটা ইন্টারভিউতে বলেই ফেলেছিলেন, আমাদের অন্য গ্রহে, অন্য কোথাও, বিশেষ করে মঙ্গলে, জনবসতি বিস্তার করার কথা ভাবনাচিন্তায় আনাটা আশু প্রয়োজন। ইলন মাস্ক তো একধাপ এগিয়ে বলেই ফেললেন, আমাদের উচিৎ, মঙ্গলে একগাড়ি, থুড়ি, একরকেট পরমাণু বোমা ফেলে দেওয়া উচিৎ। মঙ্গলীয় মহাপ্রলয়ে যদি পৃথিবীর মানুষের জন্য কোন মঙ্গল সাধিত হয়, যদি তারা এই উপায়ে সেখানে মানব-উপযুক্ত কলোনী গড়ে তুলতে পারে! আর রইল বাকি শিল্পীরা। লেখকেরা একের পর এক গল্প-উপন্যাস লিখেই চলেছেন সেই কবে থেকে। বলছেন, ভাবো ভাবো, ভাবাটা প্রাকটিশই নয়, অত্যাবশ্যকীয় করে তোলো। এবং এই পর্যায়ে একটি ছোট গল্পকে, একটি রূপকধর্মী ছোটগল্পকে বইয়ের আকারে নিয়ে এসেছেন অমিতাভ ঘোষ। আনন্দ পাবলিশার্স সানন্দে তার বঙ্গান্তর ঘটিয়েছে, কাজটি করেছেন সুকান্ত চৌধুরী। সুকান্তবাবু ‘বিচিত্রা’ নামক ওয়েবসাইট বানিয়ে যেমন চমকে দিয়েছেন, এই অনুবাদে ততটা চমকাতে পারেন নি, কারণ, এখানে তার খুব একটা বেশি কিছু করার ছিল না।
কিছুদিন আগে, প্যান্ডেমিকের সমসময়ে, একটি শব্দ অমিতাভ ঘোষের মনে স্থান পায় ঘটনাক্রমে – Anthropocene. গোদা ইংরাজীতে এর অর্থ হল, It is an unofficial unit of geologic time, used to describe the most recent period in Earth’s history when human activity started to have a significant impact on the planet’s climate and ecosystems. সরু বাংলায় অর্থ হল, মানুষ ঠিক যে সময়কাল থেকে প্রকৃতির সাথে ধ্যাষ্টামি শুরু করল। অর্থাৎ, ‘এনথ্রোপোসিন’ হল একটি প্রস্তাবিত ভূতাত্ত্বিক যুগ যা পৃথিবীর ভূতত্ত্ব, ল্যান্ডস্কেপ, লিমনোলজি এবং ইকোসিস্টেমের উপর উল্লেখযোগ্য মানবিক প্রভাবের সূচনা থেকে শুরু করে, যার মধ্যে নৃতাত্ত্বিক জলবায়ু পরিবর্তনসহ গৃহীত কিন্তু কেবলমাত্র এতেই সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীতে মানুষের ক্রিয়াকলাপের প্রভাবে প্রকৃতির পরিবর্তন দেখা যায়, উদাহরণস্বরূপঃ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, জলবায়ু পরিবর্তন, জৈব ভূগোল, ভূরূপবিদ্যা এবং স্ট্র্যাটিগ্রাফিতে পরিবর্তন (পাললিক রেকর্ড, জীবাশ্ম রেকর্ড, ট্রেস উপাদান)। মূলত, এই বিষয়বস্তুটিই অমিতাভ ঘোষের লেখায় রূপ পায় ‘The Living Mountain’ বা ‘প্রাণপর্বত’ নামে, যখন সারা বিশ্ব করোনার লকডাউনে মৃত্যুযুদ্ধে লড়ছে।
গল্পটি রূপক, Feeble Story। এক পর্বতের গা ঘেষে একটি জনজাতির উত্থান-পতনের গল্প। পাহাড়কে জয়, কিম্বা পাহাড়কে ধ্বংস, কিম্বা পাহাড়ের সংরক্ষণ (যদি পাহাড়কে পৃথিবীরূপে ধরা হয়) — ঠিক কোনটা আমাদের মানসিকতার সাথে যাচ্ছে, এই হল প্রশ্ন। এবং এই প্রশ্নে মানুষের ইতিহাসটা তিনটে পর্যায়ে ধরা পড়েছে। এক পর্যায়ে অধিবাসীরা লাঞ্ছিত হয় বহিরাগত উন্নত মানবজাতির কাছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা বিদ্রোহ করে নিজেদেরকে উন্নয়ন করতে থাকে, এবং সর্বশেষ পর্যায়ে দেখা যায়, প্রথম এবং দ্বিতীয় — উন্নত এবং অনুন্নত — দুই প্রজাতির মানুষই এক মারাত্মক ধ্বংসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
গোটা ইউরোপ এক সময়ে নিজেদেরকে উন্নত প্রজাতির প্রমাণ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকায় শাসনের নামে কী পরিমান শোষণ করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমস্ত রকমের বিশ্বাসকে, স্বাভাবিক জনজীবনকে, পরিবেশকে, এমনকি মানুষের মনুষ্যত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদেরকে অস্বাভাবিক রকমের অগ্রগতির পথিক প্রতিপন্ন করার পর, এখন, সেই শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার যে প্রহসন, তা দেখলে অবাকই হতে হয়। শোষিত সেই জাতগুলি বর্তমানে উন্নত প্রজাতি হওয়ার লোভ সম্বরণ করতে না পেরে যথেচ্ছভাবে পরিবেশ ধ্বংস এবং বিনাশের কারণ হচ্ছে, তা দেখলে শিউরেই উঠতে হয়। এখন সেই ইউরোপ আঙ্গুল তুলে তাদেরই কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর প্রহসন চালাচ্ছে। এই প্রহসনের মাঝে দুইপক্ষই ভুলে যাচ্ছে এক চিরায়ত প্রশ্নের কথা, তারা পরিবেশে অধীনে, না পরিবেশ তাদের অধীনে?
অমিতাভ ঘোষের বয়ানে সেকথাই উঠে এসেছে। সেই প্রশ্নই তার লেখার মধ্যে তিনি বহন করেছেন। সেই exploitation টাকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন।
তো যে কথা বলছিলাম, Exploitation, মানুষ কিভাবে এক্সপ্লয়েট করে তা আনন্দ জুয়েলার্সের, থুড়ি আনন্দ পাবলিশার্সের বইটা দেখলেই মালুম হয়। বইয়ের দাম ২৫০ টাকা। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪২। এর মধ্যে ছবি আছে সাড়ে আট পাতা জুড়ে। প্রথম আর শেষের কয়েকটি পাতা বাদ দিলে হয়তো, মেরেকেটে, পচিশ-ছাব্বিশ পাতায় বই শেষ! আর ফন্ট সাইজের কথা কি বলব, অন্ধ মানুষ পড়তে পারবে এরকম ফন্ট। পৃষ্ঠাপ্রতি ২১ লাইন আর লাইনপ্রতি গড়ে ১০টি শব্দ! এমন বাহারি বইয়ের হার্ডকভার মুল্য দুইশত পঞ্চাশ। মনে হয়, বইটা পড়ে, এই যে কাগজ বানাতে যে পরিমাণ গাছ কাটা হচ্ছে, তা রোধ করতে, এনারা দাম বাড়িয়ে বইটা যাতে তাড়াতাড়ি ডিজিটাল ভার্সান করে ফেলে কেউ, তার ব্যবস্থা করেছেন। মোট কথা, ‘এক্সপ্লয়টেশান’ বিষয় নিয়ে লেখা বইয়ের এমন পাঠক-এক্সপ্লয়টেশান এর আগে আমি দেখি নি। আগে জানলে, আনন্দের স্টোরে বসেই না হয় টুক্ করে পড়ে নিতাম। পড়তে পনেরো মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়।
উদাহরণস্বরূপ, বইটার ভিতরের পাতার একটি ছবি দিলাম।
কেনাকাটা আপনার ব্যক্তিগত…
================
প্রাণপর্বত
অমিতাভ ঘোষ
অনুবাদকঃ সুকান্ত চৌধুরী
আনন্দ পাবলিশার্স
মুদ্রিত মুল্যঃ ২৫০ টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা