আজ দোল পূর্ণিমা, সারাদিন চুপ করে ঘরে বসে আছে ভবেন, ওর মনে কোনও আনন্দ নেই, গত বছর এই দিনে পূর্ণিমাকে যখন রং দিতে গেছিল তখন পূর্ণিমা মুখের উপর বলেছিল পেটে এক ফোঁটা বিদ্যা নেই, কোন সাহসে এসেছ আমাকে রং দিতে? ভবেন উত্তর দিতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময়েই পূর্ণিমার কাকা এসে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ভবেনকে বের করে দিল।
ভবেন মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে ঘরে ফিরে এল, মনে মনে বলল, আমি তো তোমাকে কতবার বলতে চেয়েছিলাম যে আমি পড়াশোনা জানি না, তুমিই তো আমাকে বলতে দাওনি। জারজ সন্তানকে কে শেখাবে লেখাপড়া? ছোটবেলায় দু’বেলা খেতেই পাইনি, তার আবার পড়াশোনা!
নিজে ইলেকট্রিকের কাজ শিখে আজ এতবড় ব্যবসা দাঁড় করিয়েছি, যখন আমি আমার সব কথা বলতে গেছি তখনই আমাকে বলেছ অত কথা বলতে নেই, আয়ু কমে যায়, আর আজ এমন কি হোল আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে।
এইসব ভাবতে ভাবতে বারান্দায় এসে বসল ভবেন, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, মনের দুঃখে মাউথ অর্গানটা হাতে নিয়ে বাজাতে লাগলো জমীর সিনেমার বিখ্যাত গান— “তুম ভি চল হাম ভি চলে, চলতি রহে জিন্দেগী”— দুঃখের সুরে। পূর্ণিমার জ্যোৎস্না রাতে দুঃখের সুরে মাউথ অর্গানের আওয়াজ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
আওয়াজটা শুনে কেকা জিজ্ঞাসা করল সুমনকে, কে বাজাচ্ছে এটা? সুমন বলল ভবেনদা, ভবেনদা মাঝে মাঝে গভীর রাতে এইটা বাজায়।
কেকা আজকে গঙ্গারামপুর এসেছে মাসির বাড়িতে দোল খেলবে বলে। আনমনা হয়ে যায় কেকা, আস্তে আস্তে বারান্দার কোণে এসে দাঁড়ায়, বাইরে শীত, ভবেন মন দিয়ে বাজাচ্ছে— ‘পিছে দেখে না, কভী মুরকে রাহো মে’ … গান শেষ হলে কেকা ঘরে চলে যায়।
পরদিন সকালবেলায় ভবেন আসে কেকাদের বাড়িতে, কাকা, কাকিমাদের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করতে। কাকিমা, কাকিমা বলে ডাকতে ডাকতে ঢুকতে যেতেই ধাক্কা লাগল কেকার সাথে। ভবেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল উঠোনে, কপালের বাদিকে একটু ছড়ে গেল।
কাকিমা বললেন ওই ভাবে কেউ হুড়মুড় করে ঢোকে?
— কি করব কাকিমা? এ জীবনে তো মা বাবার পায়ে কোনদিন আবীর দিতে পারলাম না, তাই আপনাকেই মা, কাকিমা সব মনে করেই আবীর দিতে আসি, এই বলে কেঁদে ফেলল।
কাকিমা বললেন, তার জন্য তুই দায়ী নয়, দায়ী তারা, যারা জন্ম দিয়েও সন্তানকে পরিচয় দিতে পারে না। তাকে অনাথ করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়।
কেকা ডেটল এনে বলল, এইটা একটু লাগিয়ে নিন।
ভবেন বলল, না না ওসব লাগবে না। কেকা জোর করে লাগিয়ে দিল।
ভবেন আর কেকার কথা শুরু হোল, আস্তে আস্তে দুজন দুজনের অনেক কাছে চলে এলো এই কদিনে, একদিন ভবেন বলল, আমার টাকা পয়সার অভাব নেই কিন্তু আমার মা বাবার পরিচয় নেই, আর শিক্ষা নেই, এইসব জেনেও তুমি আমাকে ভালবাস— এটা ভেবেই আমি লজ্জা পাই।
কেকা বলে ভালবাসার জন্য এইসব কিছুই লাগে না, এগুলো তাদের লাগে যারা সমাজে নিজেদের স্টেটাস, আভিজাত্য নিয়ে বড়াই করে। তুমি পিতৃপরিচয়হীন তার জন্য তো তুমি দায়ী নও, তুমি লেখাপড়া শিখতে পারনি তার জন্যও তুমি দায়ী নও, কিন্তু এই সমাজে আমি এমন অনেককে চিনি যাদের পিতৃপরিচয় আছে, শিক্ষিত তবুও তারা মনের দিক দিয়ে এক একটা অমানুষ।
এইসব মানুষকে দিয়ে সমাজের কোন মঙ্গল সাধন হবে? তাই আমি তোমার পিতৃপরিচয় জানতে চাই না, আর লেখাপড়া সেটা আমি তোমাকে নিজে শেখাব। আমি ইংরেজিতে মাস্টার্স।
কেকা বাড়িতে গিয়ে সব খুলে বলল ওর বাবা মাকে, ওনারা একদম রাজি হলেন না। বাধ্য হয়ে কেকা নিজেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করল ভবেনকে। দোকানে গিয়ে বিভিন্ন বই কিনে এনে নিজেই পড়াতে শুরু করল ভবেনকে।
দেখতে দেখতে ভবেন লেখাপড়ায় ভাল ছাত্র হয়ে উঠল। কেকা রাত দিন ভবেনকে নিয়েই পড়ে থাকে, আগামী বছর ভবেন মাধ্যমিক দেবে প্রাইভেটে, চিন্তায় কেকার নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠে গেছে। ভাল করে পরীক্ষা দিল ভবেন।
আজ ভবেনের রেজাল্ট বের হবে, কেকা ভবেনকে সঙ্গে করে জানতে গেল ভবেন পাশ করেছে কিনা? জানতে পারল ভবেন 1st division পেয়ে পাশ করেছে।
আস্তে আস্তে ভবেন বি এ পাশ করল। ভবেন কেকাকে বলল, আমি যদি একটা বই লিখি কেমন হবে? কেকা বলল, খুব ভাল হবে। ভবেন লেখা শুরু করল “হাত ধরতে চাই” নাম দিয়ে। বই লেখা শেষ হলে ভবেন বইটা প্রকাশ করার উদ্যোগ নিল, ওর এক বন্ধুর সাথে প্রকাশকের যোগাযোগ আছে, তার কাছে ওকে নিয়ে গেল। প্রকাশক বললেন, ঠিক আছে ছাপব, তবে খরচ দিতে হবে।
বই ছাপা হয়ে বেরুতেই বাজারে প্রচুর নাম করল, হু হু করে বই বিক্রি হতে লাগল। একদিন এক টি ভি চ্যানেল থেকে ওর সাক্ষাৎকার নেবার জন্য ফোন করল। ফোন ধরে ভবেন বললো হ্যাঁ আমি সাক্ষাৎকার দেব।
সাক্ষাৎকার দিতে যাবার সময় রাস্তায় পূর্ণিমা ভবেনকে ডেকে বলল, আমি সরি।
ভবেন বলল, কেন?
আমি তোমাকে অনেক অপমান করেছিলাম তাই সরি বলছি।
ভবেন হেসে বলল, ওটাই আমার আশীর্বাদ হয়েছে, তোমার ওই অপমান আমার বুকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই আগুনের ফসল এই লেখা, আর কোনদিন আমার সামনে আসবে না তুমি।
টিভির সাক্ষাৎকারে ভবেন সব কথা জানাল, সে যে জারজ সন্তান তাও বলল, লেখাপড়া যে তার বৌ শিখিয়েছে সেটাও বলল। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনল। টিভির সঞ্চালক বললেন, আপনাকে এই জায়গায় যিনি নিয়ে এসেছেন তাকে আমরা সম্বর্ধনা দেব।
এদিকে কেকার ফোনে বারবার একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসছে, কেকা ধরছে না, ও একমনে ভবেনের সাক্ষাৎকার দেখছে। এইসময় মোবাইলে ভিডিও কল এলো রমেশের, কেকা রমেশকে দেখেই চমকে উঠল। রমেশ বলল, মাফ করে দাও কেকা।
ঘৃণায়, লজ্জায় ক্ষীপ্র বাঘিনীর মতো বলল, সেদিন পণের টাকার জন্য বিয়ে ভেঙে দিয়ে আজ বলছ ক্ষমা করো। লজ্জা করছে না? আমি একজন সৎ মানুষকে বিয়ে করেছি, আমি তার জন্য গর্বিত, সে আমার অহঙ্কার। আর কোনদিন আমাকে ফোন করবে না— এই বলে ফোন কেটে দিল।