দয়া করে এই ছবিগুলি একটু নজর দিয়ে দেখুন… কি অসাধারণ মেধা, কি অসাধারণ দক্ষতা, কি অসাধারণ ঐতিহ্যের প্রতি মমত্ববোধ, কি সাধারণ শৈল্পিক দক্ষতার রেণু আর রেশ ছিটকে পড়ছে ছবিগুলো থেকে! এ গুলো বাংলার পটুয়া কন্যাদের শিল্প সৃষ্টি। না শিল্প বোদ্ধারা আপনারা কোনদিন এগুলিকে এক তিল পরিমানও শিল্পের মর্যাদা দেন নি। তাতে তার বয়েই গিয়েছে। সে অন্তত কয়েক হাজার বছরের শেকড়ের পরম্পরার নিজেকে জারিত রেখেছে আপনাদের দূর সাগরপারের মুগ্ধ দৃষ্টির উল্টো পথে দাঁড়িয়ে।
বাংলায় পটুয়াদের পরম্পরা অন্তত বুদ্ধ পূর্ব সময়ের – হয়ত আরও বহু পুরনো সে পরম্পরা। জাতকে পটুয়াদের উল্লেখ পাওয়া যায় – নাম মস্করী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘বেনের মেয়ে’ উপন্যাসে বিশদে মষ্করীদের কর্মকাণ্ড লিখেছেন। দীনেশ চন্দ্র সেন ‘বৃহতবঙ্গ’তে বলছেন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় যত মহাযান গুম্ফা রয়েছে তার দেওয়ালগুলোতে যে ছবি আঁকা রয়েছে তা সব আজকের পটুয়াদের পূর্বজদের রচনা। বৃহতবঙ্গে বিশদে বলেছেন। সে কথার প্রমান পাই কালিম্পঙের পেদং গুম্ফায় – বছর সাতেক আগে সেটি নবকলেবর ধারিত হচ্ছিল। তখন দেওয়ালে নতুন করে যে সব ছবি আঁকা হচ্ছিল, তার ভিত্তিভূমি তৈরির পদ্ধতি হল পটুয়ারা যেমন করে পট তৈরি করেন, সেই ভাবে।
ফিরি বাংলায় টেপা পুতুলের কথায়। নান্দনিক বাংলার ততোধিক নান্দনিক পুতুলগুলোর মধ্যে অন্যতম পটুয়া মায়েদের পুতুল। তাঁরা ন্যুনতম আঁচড়ে, অনিন্দ্য শিল্পবোধে, প্রকাশ করেন বস্তুর ভাব। বাঙ্গালীর সৌভাগ্য, বাংলায় যে কজন গ্রাম শিল্পী/উতপাদক কয়েক হাজার বছরের পরম্পরা আজও তাঁরা ধারণ করে রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে পটুয়া/মষ্করী মায়েরা অন্যতম।
পটুয়া কন্যারা, তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য উনুন নিকোবার পরে সেই বাড়তি মাটি ছেনে গড়ে তোলেন এক আশ্চর্যময় উজ্জ্বলতম সব শিল্পকর্ম। সেই ছোট ছোট সব পুতুলকে তাঁরা ফেলে দিতেন নেভা উনুনে। পরেরদিন সকালে টকটকে লাল রঙে হয়ে প্রায় ঝামা হয়ে উঠে আসত পুতুলগুলো, বাচ্চাদের খেলার জন্য। এ এক আশ্চর্য অসম্ভব কাব্যিক ভাগ্যবান বাংলার শিশুবেলা। এক আমাদের অন্যতম প্রধান জ্ঞানচর্চার ইতিহাস – যেখানে পুর্বজদের শিল্পভাবনা চারিয়ে যেত পরবর্তী প্রজন্মএর বোধে – খেলতে খেলতে। পরের দিকে এটি বাংলার পটুয়াদের নিজস্বতার ঘরানা হয়ে উঠেছে। তারাপদ সাঁতরা একে টেপা পুতুল বলেছেন।
এই টেপা পুতুল বাংলার মহিলাদের অন্যতম শিল্পকর্ম ছিল – বোধহয় আজও আছে। আমার মনে আছে ছোট বেলায় আমার বিধবা, ছোট করে চুল ছাঁটা, সাদা কাপড় পরা, নিরামিশ খাওয়া দিদিমা রাতে উনোন নিকোনোর পর উদ্বৃত্ত মাটি নিয়ে ছোট ছোট করে পুতুল গড়তেন। সঙ্গে ট্যাঁকে গুঁজে অবধারিত নিতেন আমায়। আমার মা-বাবা থাকতেন দূর দেশে। আমি থাকতার দিদিমার সঙ্গে গ্রামে। আমার নান্দনিক দিদিমা বাংলার পরম্পরার শিল্পবোধ চারিয়ে দিয়েছিলেন এই অকালকুষ্মাণ্ড আমার মধ্যে। সেই পরম্পরার বিন্দুমাত্র আমি পাই নি। কিন্তু আজও চোখে লেগে রয়েছে সেই শিল্পকর্ম। আমার প্রথমদিকে কাজ ছিল সেই কাদামাটিগুলি গোল্লা গোলা করে পাকিয়ে উনুনে ছুঁড়ে দেওয়া, সেই গোল্লাগুলি নিয়ে বন্ধজুরা খেলতামও আবার মালাও তৈরি হত। আমার ধারণা শুধু আমার দিদিমা নয়, কোটি কোটি গ্রামীন মহিলা তাঁদের উত্তরপ্রজন্মকে এই উপহার দিতেন।
আহা আহা আহা!
আজও গায়ে কাঁটা দেয়। কোন ঐতিহ্য আমরা ধারণ করে রয়েছি।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.