এভরি সিঙ্গল ‘জ্ঞান’ যা সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে আমদানি, তাকে আমি সন্দেহের চোখে দেখি। তার কারণ এই নয় যে সেগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ। সেগুলো শুনলে মনে হবে, তাই তো, এ রকমই তো হওয়া উচিত। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ভেতরটা ফাঁপা। আমি যে সেগুলো সন্দেহের চোখে দেখি, তার কারণ শুধুমাত্র এই, যে তাদের ফল – কনসিকোয়েন্স – আমাদের সমাজে শুভ হয়নি।
মনে করুন, এই জ্ঞান-টাঃ বিদ্যালয়ে ছাত্রদের গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, তাদের বকা-ঝকা করাও যাবে না।
আমরা গ্রামের ইস্কুলে পড়েছি, সেখানে বেশ কিছু শিক্ষক – তাঁদের মধ্যে আমার পিতৃদেবও ছিলেন – বিভিন্ন কারণে ছাত্রদের উত্তম-মধ্যম দিতেন। কোনো ছাত্রের বাড়িতে তার মা-বাবা যদি জানতেন যে ছেলে স্কুলে শিক্ষকের হাতে মার খেয়েছে, তবে সে কারণে মা-বাবার হাতে আরও কয়েকটা কিল-চড় তার প্রাপ্য হ’ত। স্কুল থেকে পাশ করে, বা না-করেও, সেই মারধর-খাওয়া ছাত্ররা সে-সব কিছুই মনে রাখেনি। তাদের অধিকাংশের মনেই স্কুলের স্মৃতি হিসাবে শুধু এইটুকুই জেগে আছেঃ স্যারেরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু আমি শিখতে পারিনি। এখন শিক্ষকরা ভয়ে ভয়ে স্কুলে যান। ছাত্রদের বা তাদের অভিভাবকদের কিছু বলার উপায় নেই। তারা এসে মাঝে মাঝে শিক্ষকদের শাসিয়ে যায়। ছাত্রদের হাতেই শিক্ষকরা মারধর খাচ্ছে আজকাল। এখন আমরা শিখছি, শিক্ষাদান আর পাঁচটা চাকরির মতোই আর একটা চাকরি; বেতন পায় বলেই পড়ায়, ওতে আর কী মাহাত্ম্য আছে?
তারপর ধরুন এই ‘লতুন’ জ্ঞানঃ প্রশ্ন করো, প্রশ্ন করো, কোনো কিছুকেই মেনে নিও না, প্রশ্ন না করলে তুমি শিখবে কী করে?
‘লতুন’ – ওয়েল, নতুন – শব্দটা সিঙ্গল ইনভার্টেড কমার মধ্যে রাখার কারণ হচ্ছে, অনেকের ধারণা, এটা বেকনিয়ান ফিলোজফি। তারা যদি শ্রীমদ্ভগদ্গীতা নামক চটি পুস্তকটার একটু ধৈর্য ধরে পাতা উল্টাতেন, তবে অনুধাবন করতেন যে ওটা আসলে সংলাপনির্ভর একটা নাটক, যাতে শ্রীমান অর্জুন একের পর এক প্রশ্ন করছে সখা শ্রীকৃষ্ণকে, করেই চলেছে যতক্ষণ না তার অন্তরাত্মা তৃপ্ত হচ্ছে, যতক্ষণ না সে সেই উত্তরে সন্তুষ্ট হচ্ছে। সেই প্রশ্নোত্তরের সমষ্টি ওই সপ্তশতী গীতা। সুতরাং প্রশ্ন করা ছাড়া কোনোকালেই ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু এই যে ‘লতুন’ জ্ঞান, এর প্রকৃত প্রস্তাব আসলে অন্য। এ হচ্ছে, শিক্ষককে অসম্মান করতে শেখো। প্রথমেই ভেবে নাও যে শিক্ষকরা নির্বোধ, কিছু জানে না। অথবা যা জানে বা যা শেখায়, সেটা ভুল। তাকে টাইট দিতে শেখো। এর ফলে ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্’ ব্যাপারটা মায়ের ভোগে চলে গেছে, ‘শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানম্’ চলে গেছে বাজে কাগজের ঝুড়িতে। দেশ ভরে উঠছে অন্তঃসারশূন্য সবজান্তায়।
ইস্কুল ছাড়া যেমন ডিগ্রি হয় না, ডিগ্রি ছাড়া যেমন চাকরি হয় না, চাকরি না পেলে যেমন জীবন অন্ধকার – এই যাঁতাকলে পড়ে আমরা ভুলে গেছি, আমাদের দেশেরই শ্রীযুক্ত রবি ঠাকুর, শ্রীনিবাস রামানুজন, চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরামন, বাবা আলাউদ্দিন খাঁ প্রমুখ যে শাস্ত্রে পারঙ্গম হওয়ার জন্য প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন, তার কোনোটাই তাঁরা ইস্কুলে-কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক-অধ্যাপকদের কাছে শেখেননি। শিখেছেন নিজের চেষ্টায়, একা। গুরুশিষ্যপরম্পরা এখনও আমাদের দেশে বেশ কিছু যে মানের সংগীতজ্ঞ, নৃত্যকলাবিশারদ ইত্যাদি তৈরি করতে পারছে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তার গুণমানের ধারেকাছে কিছু পারছে?
সুতরাং ‘স্কুলে যে যায় না, সে অশিক্ষিত’ এই জ্ঞান কি সন্দেহের অতীত থাকা উচিত?
শুধু শিক্ষা নয়, সংসারের প্রতি ক্ষেত্রে নতুন নতুন জ্ঞান এসে ধাক্কা দিচ্ছে আমাদের দরজায় আর এক শ্রেণির মানুষ সেই আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উদ্বাহু নৃত্য করছেন – আহা, কী শুনিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।
কিন্তু তার ফল কী হচ্ছে, সে কথাটা কে ভাববে?