» শিক্ষা না-কি বিদ্যা, কিসে মুক্তি মানুষের?

প্রাবন্ধিক :

শিক্ষা না-কি বিদ্যা, কিসে মুক্তি মানুষের?

বিদ্যার দেবী সরস্বতী- এই বাক্য অনেকেই জানেন। পশ্চিমে জ্ঞানের দেবী যে এথেনা- এ কথাও বিস্তর মানুষের জানা। বিদ্যার দেবী আছে, জ্ঞানের দেবী আছে কিন্তু শিক্ষার দেব-দেবী কিচ্ছু নাই। কেন নাই? কারণ শিক্ষা ব্যাপারটা অর্বাচীন। সাতশ বছর আগেও “এডুকেশন” শব্দটা গবাদী পশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অর্থে ব্যবহৃত হতো।

অনুমান করা হয়, বাংলা ভাষায় শিক্ষা কথাটা দক্ষতা তৈরির কায়কারবার হিসেবে চালু হয় রাজা দক্ষ নিজের যজ্ঞানুষ্ঠানে তার মুণ্ডু হারিয়ে ছাগমুণ্ডী হওয়ার পর থেকে। এই প্রজাপতি ছাগমুণ্ডী দক্ষই সমাজকে যার যার দক্ষতার ভিত্তিতে ভাগ করে শ্রম-আশ্রিত সমাজ গড়ায় এগিয়ে ছিলেন। তখনই জন্ম হয়েছিল শিক্ষা দান কার্য্যের। কিন্তু সৃজনশীলতার যারা অনুরাগী ছিলেন তারা সেই দক্ষতা নির্ভর সমাজে না থেকে পিছু নিয়েছিলেন- দেবাদিদেব শীবের। আর তাতেই রক্ষা পেয়েছে মনুষ্য সভ্যতা। শীব আজও তাই দেবাদিদেব- মহাদেব!

দক্ষযজ্ঞপণ্ডের কাহিনী প্রতীকী। যার সরল অর্থ: বহু কাল আগে একবার এই ভূখণ্ডের মানুষ বিদ্যা ও শিক্ষার প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে গেছিল। এই বিভক্তি ছিল- বৈপ্লবিক। শীবপন্থীদের পরাজয় ঘটেছিল – অর্থাৎ পরাজয় ঘটেছিল শীবতার- মানুষের স্বাধীন সত্তার, সৃজনশীলতার। রাজা দক্ষের অনুসারীরা জয়ী হয়ে গড়ে তুলেছিল শ্রম-বিভাজিত সমাজ। দক্ষতার কদর সেই থেকে। সেই থেকে শিক্ষিত-দীক্ষিত কিন্তু ছাগমুণ্ডী (ছাগলা-মাথা)দের দোর্দণ্ড প্রতাপ! সে সময়ই ছাগমুণ্ডি দক্ষ মানুষ হারিয়ে ফেলে শীবতাকে- অসীম সীমাকে স্পর্শ করে দেবতা হয়ে উঠার অপার সম্ভাবনাকে।

কিন্তু এই ভূখণ্ডের শীবতাপ্রিয় মানুষ তার ঐতিহাসিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে জানে, মানুষ কেবল ভাতে বাঁচে না। সে দেখেছে যে রাজা দক্ষের অনুসরণ মুক্তি দেয় না বরং সমগ্র সমাজকে মুণ্ডুহীন ছাগলের শৃঙ্খলিত (ডিসিপ্লিন্ড) সমাজে পরিণত করে। সেখানে স্বাচ্ছন্দ্য হয়তো থাকে কিন্তু সুখ হারিয়ে যায়। ভাত হয়তো জুটে কিন্তু প্রতিভা জন্ম নেয় না। প্রাণে প্রাণে আলাপ থেকে সে জানে- ধনার্জন না, মুক্তি তার আরাধ্য। আত্ম-উপলব্ধি আর আত্ম-উদ্বোধন তার পাথেয়। যার মোক্ষম পরিণাম- মোক্ষলাভ। সে থেকেই তার শিক্ষাকে পশ্চাতে রেখে বিদ্যার আরাধনা, জ্ঞানের সাধনা। তাই তারা আদিতে শিক্ষালয় গড়েনি, গড়েছে- বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়।

সেই আদি পথ ত্যাগ করে আমরা শিক্ষাকেই জীবনে পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছি কয়েক শতক ধরে। যেমনটি শিল্পবিপ্লবকালে মনে করতে শুরু করেছিল ইউরোপ। এই পথে শ্রমিক তৈরি সহজ হয়। বাদ-প্রতিবাদহীন, জীবনবোধ রিক্ত, ছাগমুণ্ড মানুষই তো এই পৃথিবী দোহন করা শিল্পবিপ্লবের আসল জ্বালানী! এই মানুষই তো আমরা চাইছি- সপ্তাহের পাঁচদিন রোবোটের মতো শ্রম করবে আর এক থেকে দুই দিন বাঁচার নামে ইন্দ্রিয়সেবা নেবে, ঘুরবে-বেড়াবে মাস্তি করবে! চিন্তার পীড়ন নাই, সৃষ্টির বেদনা নাই, শূন্যতার বোধ নাই- কেবল কাজ আর কাজে উৎসর্গ করবে জীবন!

২.

কিছু চির-অসন্তুষ্ট মানুষ বলে, শিক্ষার চাকচিক্যময় জীবনের জৌলুস চোখ ঝলসে দেয়, মোহান্ধ করে বটে; কিন্তু জীবনকে উপভোগ করার, পরিপার্শ্বকে উপলব্ধি করার, জীবনকে তরিয়ে তরিয়ে অনুধাবন করার সামর্থ্য কমিয়ে দেয়। এই অধুনা মানুষ বাঁধা পরে চাকুরি আর ক্রেডিট কার্ডের ফাঁদে। কোষ্ঠকাঠিণ্যের রুগীর মতো একটু একটু করে সে বাঁচে। সপ্তাহে সাতদিন, সর্বক্ষণ আর তার আর বাঁচা হয়ে উঠে না। সপ্তাহে দুই দিন বাঁচার জন্য কাজের পাঁচ পাঁচটি দিন তেতো ওষুধের মতো কুঁৎ করে গিলে ফেলাই তার জীবনসাধনা।

এই সব নিন্দামন্দ সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়েই শিক্ষা তার বাণ হেনে চলে। মানুষ আরও আরও শিক্ষিত হতে থাকে। চারিদিকে কেবল শিক্ষক শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে৷ মানুষ যত শৃঙ্খলিত বা ডিসিপ্লিন্ড হয় ততো উন্নতি হয় জীবন-মানের। যদিও শৃঙ্খলিত মানুষের জানা হয় না জীবনের মানে আদতে কী। ফলত বিদ্যা হারিয়ে যায়। বিদ্যার্থী হারিয়ে যায়। বিদ্বান মানুষের দিশা আর পাওয়া যায় না দেশে, সমাজে। সমাজ পরিণত হয় টুকরো টুকরো চকচকে কাঁচের সমাজে। যে চকমকে সমাজে প্রতিটি মানুষ দৌঁড়ুতে বা সাঁতার কাটতে বাধ্য হয়, আর তার শরীর ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত হতে থাকে চকচকে কাঁচের টুকরায়।

৩.

মানুষ এক অদ্ভুত প্রাণী যে তার উচ্চতার মাপের চেয়ে শত গুণ উঁচু ঘর বানায়, উড়নিকে সে শাড়িতে পরিণিত করে। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনের প্রতিই তার থাকে বিপুল পক্ষপাত। সে বানায়, বানায় বানায় কথা বলে। সে বানানো চলে মুখের ভাষায়, অক্ষরকে রূপান্তরিত করে আঁক বা বর্ণে, সংখ্যাকে গণিতে। আর এই আঁক, বর্ণ ও সংখ্যার ভাষা দিয়ে সে বানায় আর যা কিছু বিদ্যা আছে সব!

সে শূন্যতাকে বাঁশির সুরে বাঁধে, বিনিসুতায় মালা গাঁথে জীবনের। এই বানানোর সামর্থ্য দেয় তার ভাষা, তার জীবন-দর্শন।

ভাষা আর দর্শন দিয়ে বানানোর সুযোগ শিক্ষালয়ে জোটে না। অকাজের সাধনার সুযোগ সেখানে নাই বলে মানুষের চেষ্টা থাকে বিদ্যালয় নির্মাণের। সে স্বপ্ন দেখে বিদ্বানের সম্মান লাভের! শিক্ষার দক্ষতা নয়, তার আরাধ্য হয়ে ওঠে সৃষ্টিশীলতায় মুক্তি!

শিক্ষার দর্শন জীবন ধারণের জন্য কেজো মানুষ তৈরি করা আর বিদ্যার দর্শন জীবনকে ডিঙিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেওয়া৷ শিক্ষা মানতে শেখায়, বিদ্যা ডিঙাতে তাড়া দেয়। মানুষের দুইই চাই। এক পক্ষ হাসি-গান-কলতানে মুখোরিত করে প্রবাহ রক্ষা করবে জীবনের, অন্য পক্ষ হাসি-গান-কলতানের রহস্য ভেদ করবে, প্রবাহিত জীবন ভেঙে নির্মাণ করবে নতুন ধারা।

৪.

একটা শিশু জানে না, জানতে পারে না সে কোন পথের পথিক- শিক্ষার না কি বিদ্যার। জানে না সে গৃহী হবে না কি ঋষি! জানে না সে শিল্প-শ্রমিক হবে না শিল্পস্রষ্টা হবে। তাই তাকে দিতে হয় এমন এক পরিবেশ যেন সে খুঁজে নিতে পারে আপনার পথ। পশ্চিমের নকল করে তৈরি করা আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম সেই পথ খুঁজে নেওয়ার পরিবেশ উন্মুক্ত করতে তো পারেই নি বরং যা ছিল তাও রুদ্ধ করেছে। এই “শিক্ষাক্রম” আদতেই “শিক্ষাক্রম”, বিদ্যার সাথে তার কোনো সংস্রব নাই। শিক্ষাক্রম প্রণেতারা ভুলে গেছেন যে মানুষ কেবল ভাতে-চানাচুরে বাঁচে না। মানুষের কেবল শিক্ষালয় আর প্রশিক্ষণালয় হলেই চলে না, তার সত্যিকারের বিদ্যালয়ও দরকার। চূড়ান্ত বিচারে বিদ্যাই মানুষের ভূষণ। বিদ্যাহীন মানুষ কাঁচের রঙিন টুকরামাত্র- যে নিজে ভাঙে আর সবকে কাটে, ক্ষতবিক্ষত করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *