» প্রসঙ্গ: মনের-বনের পশু, জবাই ও কুরবান

লেখক :

শিক্ষিত-বাঙালী আর সব কিছু নিয়ে যা করে “মনের পশু” নিয়েও সে তাই শুরু করছে। শব্দের ব্যবহারে কাজী নজরুল ইসলাম খোদাপ্রদত্ত প্রতিভা। উনি শহীদী-ঈদ কবিতায় বেশ কিছু অর্থে “পশু” শব্দটা ব্যবহার করেছেন। সাহিত্যাদিতে সে সুযোগ রয়েছে বলেই তিনি তা করেছেন।

তবে কোষগ্রন্থ বলছে, “পশু” শব্দের প্রথম যে অর্থ তা হচ্ছে- “যে সব অবিশেষে দেখে” (হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ)।

মানুষ সাধারণত অবিশেষ দেখে না, সে বিশেষ দেখে। বা সবিশেষ দেখে। কিন্তু মানুষের মন অনেক সময় ভালমন্দজ্ঞান রহিত হয়ে যায় বা সে আর কোনো কিছু বা কাউকে বিশেষভাবে দেখতে পারে না, মানে সে পৃথক করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে। এরকম অবস্থায় মানুষের মনকেই “পশু” বলা হয়।

আবার মূঢ়জন বা ভাষাজ্ঞানহীন প্রাণীর (সে মানুষ, ছাগ বা যে কোনো প্রাণী হতে পারে) মনকেও পশু বলা হয়। কারণ তার বিচার-বিবেচনা আছে কি না তা বুঝা যায় না।

সাহিত্যাদিরসহীন জন বা সংসারাসক্ত জনের আত্মাকেও শব্দকোষগ্রন্থে পশু বলা হয়েছে।

আমাদের শিক্ষিত-বাঙালী “বনের পশু” কথাটা কোথা থেকে জোগাড় করছে বুঝতেছি না। “বনের পশু” বলে কিছু নাই। কারণ বনের মন বা আত্মা নাই। যদি ধরে নেই, শিক্ষিত-বাঙালী বন্যপ্রাণীর কথা বলতে চেয়েছেন, তবে বলতে হবে প্রায় প্রতিটি ধর্মেই বন্যপশু কুরবান/বলি/উৎসর্গ করা, খাওয়া নিষিদ্ধ৷ সুতরাং এ নিয়ে নতুন করে তাগাদা দেওয়ার কিছু নাই। আর এ কথা বলা বাহুল্য যে, নজরুল ইসলাম “বনের পশু” এমন শব্দবন্ধ সংশ্লিষ্ট কবিতায় ব্যবহার করেননি। কারণ, সম্ভবত এই যে উনি জানতেন, “বনের পশু” কথাটি অর্থহীন, অশুদ্ধ।

নজরুল লিখেছেন, “মনের পশুরে করো জবাই/পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।” খেয়াল করে দেখেন, উনি পশুপ্রেমী হয়ে বলেন নাই যে, “পশুদের বাঁচাও”! কারণ উনি জানতেন, মনের যে পশু তাকে জবাই দিলেও সে বাঁচে, মানুষের মন বিশেষ বা সবিশেষ দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে পশু হিসেবে নিত্য বাঁচে, চিরকাল বেঁচে থাকবে, তাই তাকে জবাই করার প্রশ্নটিও সমুন্নত রইবে। আর জবাই মাত্রই “কুরবান” না। তবে হ্যাঁ, জালিমের শাসন যতদিন বহাল আছে, ততোদিন পশু কুরবানি না দিয়ে নিজেকে, নিজের সন্তানকে “কুরবানি” দিতে কাজী নজরুল তাগাদা দিয়েছেন। নিজেকে বা নিজ সন্তানকে “জবাই” করতে উনি বলেননি।

ভাইলোক, “বাংলা আপনার মাতৃভাষা বটে কিন্তু এইটা মামাবাড়ির আবদার মেটানোর মতো ভাষা না”। ভাষাজ্ঞান রহিত প্রাণীকেও পশু বলা হয়, কিন্তু সেটি কুরবানি যোগ্য হতে পারে না। তেমনি মনের পশুও কুরবানি হবে না, তবে জবেহ হবে, নজরুল “মনের পশু” জবাই দিতে বলেছেন, কুরবান না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *