» এম এস জি

কিছুদিন আগে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (এম-এস-জি / আজিনোমোটো) নিয়ে কিঞ্চিৎ আলাপ-আলোচনা হচ্ছিল। বিশেষ করে সি-আর-এস তথা চাইনিজ রেস্তোরাঁ সিন্ড্রোম এবং এই বস্তুটার যোগাযোগ নিয়ে। এই পোস্ট এই বস্তুটার সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকটার আলোচনা নয়, বরং খানিকটা এর ইতিহাস নিয়ে। কবে থেকে চিনেরা এই বস্তুটাকে তাদের খাবার প্রস্তুতির অঙ্গ করে নিয়েছে, এই হচ্ছে প্রশ্ন।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, ভারত একটা বিশাল দেশ এবং এর খাদ্যাভ্যাস যেমন বিভিন্ন জায়গায় স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন, চিন সাইজে ভারতের তিনগুণ বলে সেখানেও এর অন্যথা হওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের দেশে আমরা যেগুলোকে চাইনিজ ফুড বলি, তার অধিকাংশই ইন্ডিয়ানাইজড চাইনিজ ফুড। ভারতীয় নাক ও জিভের যোগ্য করে তুলতে চিনেদের খাবারের ও তাদের রন্ধন প্রক্রিয়ার অনেক পরিমার্জন করা হয়। সুতরাং আমরা যে ভেজ হাক্কা নুডল বা গোবি মাঞ্চুরিয়ান খেয়ে ভাবি, আহ্‌, কী চাইনিজ খেলাম দাদা, চিন-থেকে-আসা কাউকে ওই খাবার দিলে সে জিজ্ঞেস করবে, এর মধ্যে কোনটা চাইনিজ? গোবি মাঞ্চুরিয়ান নামে কোনো খাবার সম্ভবত ভারতের বাইরে নেই!

কিন্তু এমনকি তার চাইতেও বড় ব্যাপার হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে খরা ও বন্যায় পর্যুদস্ত চিনেদের দেশে তাদের নিজেদের খাদ্যাভ্যাস সময়ের সঙ্গে বহু পরিবর্তিত হয়েছে। এখনকার পৃথিবী দিয়ে অতীতের অভ্যাস ব্যাখ্যা করা কেবল মুশকিলই নয়, অসম্ভব।

এবার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট আসলে চিনাদের সাধারণ রন্ধন প্রক্রিয়ায় ছিল না এমনকি একশো বছর আগেও। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ আর ১৯২৮ সালে চিনে গেছিলেন, এই বস্তুটি তিনি সেখানে খাবারে সম্ভবত পাননি।

এম-এস-জি আবিষ্কারের কৃতিত্ব একজন জাপানি রসায়নবিদের। তাঁর নাম কিকুনে ইকেদা। জার্মান রসায়নবিদ ভিলহেল্ম অসওয়াল্ডের ছাত্র তিনি তখন টোকিও ইম্পিরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। একদিন সন্ধেয় খেতে বসে তিনি টোফু স্যুপে চুমুক মেরে ইকেবৌদিকে বললেন, স্যুপটা দিব্যি হয়েছে তো, গিন্নি। এতে কি মাছের স্টক দিয়েছিলে? খেতে বেশ দিব্যি আমিষ-আমিষ লাগছে।

সেটা ১৯০৮ সাল। মানে বঙ্গভঙ্গের পর রাখি-টাখি হয়ে গেছে মাত্রই বছর তিনেক, বিপ্লবীরা গোপনে ইংরেজ ঘুঘুদের মেরে তাড়াতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে, ধরা পড়ে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছে সদ্য। ইকেবৌদি স্বামীর প্রশংসায় বিগলিত হয়েও বললেন, কই না তো, মাছের স্টক তো দিইনি। এতে দিয়েছি কম্বু, ওই যে দাশি বানাই যা দিয়ে, ওটাই। কম্বু, ইংরাজিতে কেল্প হচ্ছে একজাতের সামুদ্রিক শৈবালজাতীয় উদ্ভিদ (সী-উইড ‘ল্যামিনারিয়া জ্যাপোনিকা’), যা শুকিয়ে খাবারে দেয় জাপানিরা।

চুয়াল্লিশ বছর বয়স্ক রসায়নবিদ ইকেদা বললেন, একটা বাটিতে একটু স্যুপ ঢেলে রাখো তো। আগামীকাল ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় সঙ্গে দিও।

পরদিন সেই স্যুপের সঙ্গে খানিকটা কেল্পও পকেটে ভরে তাঁর গবেষণাগারে হাজির হলেন তিনি। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই এই দুটো বস্তু থেকে তিনি উদ্ধার করলেন একই বস্তু, যা জৈব রসায়নে এক অতি পরিচিত বস্তু – গ্লুটামিক অ্যাসিড।

একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী, বাঙালি হ’লে তো বটেই, এই অবস্থায় পড়লে কী করতেন? ছাত্রদের বলতেন একটা পেপার লিখতে। বড় জোর এক আধটা কনফারেন্সে এই নিয়ে ভাষণ দিতেন। তারপর বুড়ো হয়ে গেলে নাতি-নাতনিদের গল্প করতেন। কিকুনে ইকেদা তেমন লোক নন। তিনি দেখলেন গ্লুটামিক অ্যাসিড জিনিসটা ফেলে রাখলে তার ওপর ছাতা ধরে, নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু একটু ক্ষার দিয়ে ওটাকে খানিকটা প্রশমিত করে দিলে সেটা দেখতে হয় পরিষ্কার সাদা ধবধবে লবণের মতো আর তাতে ছাতা-টাতা পড়ে না। জিভে দিলে নতুন একটা স্বাদ খেলে যায়। তিনি একে বললেন য়ুমামি অর্থাৎ pleasant savory taste।

এখানেই থেমে রইলেন না তিনি। এই লবণ অর্থাৎ মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট কীভাবে অনেক বেশি পরিমাণে তৈরি করা সম্ভব – প্রথমে কেল্প থেকে, তারপর গমের আটা থেকে, তারপর সয়াবিন থেকে – তার পদ্ধতি বের করে ফেললেন। মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট নামটা বড্ড বেশি কেমিক্যাল কেমিক্যাল, রাঁধুনিদের কাছে এই নাম চলবে না। তিনি এর নাম দিলেন আজিনোমোটো, জাপানি ভাষায় যার অর্থ ‘এসেন্স অভ ফ্লেভার’। চটপট এর পেটেন্ট নিয়ে তিনি এই নামেই এক কোম্পানি খুলে ফেললেন।

তারপর তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেধে গেল। জাপানিরা চিনের ওপর খবরদারি করতই। চিনে তাদের বিশাল বাজার, আর সেই ব্যবসা যাতে চিনেরা কোনোভাবেই দখল করতে না পারে, সেটা দেখতে হবে না? কাজেই সময়ের সঙ্গে চিনে হেঁসেলে ঢুকে পড়ল জাপানি আজিনোমোটো। তৃতীয় দশকের মাঝামাঝি এই জিনিস বিক্রি করে শুধু চিন থেকেই আজিনোমোটো কোম্পানি বছরে এক মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে ফেলল।

ব্যাপারটা নজরে পড়ল চিনের রাসায়নিক ব্যবসায় উদ্যোগী য়ু ইয়ুঞ্চুর। ইয়ুঞ্চু সাংহাইয়ের কাছে এক গ্রামের গরিব ঘরের ছেলে, বেশিদূর লেখাপড়া শেখেনি। ১৯০৫ সালে চিনে পরীক্ষা প্রথা বাতিল হয়ে যাওয়ায় সে চলে যায় কিয়াংনানে। সেখানে গোলাবারুদের কারখানায় ট্রেনিং নিতে ঢুকে সে শিখল বিদেশী ভাষা আর কিঞ্চিৎ রসায়ন। চার বছরের কোর্স করে সে হয়ে গেল কেমিক্যাল টেকনিশিয়ান। কিয়াংনান আর হ্যানিয়াং গোলাবারুদের কারখানায় কিছুদিন টেকনিশিয়ান পোস্টে চাকরি করল সে। দ্বিতীয় চাকরিটা যখন করছে হ্যানিয়াঙে, সে তখন বারুদ বিভাগের প্রধান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে আর সে কারণেই দেশে দেশলাই তৈরির কাঁচামালের তীব্র অভাব, সে সব তো আসে ইওরোপ থেকে। ১৯১৮ সালে পকেটের পাঁচ হাজার ইউয়ান জমানো টাকা বিনিয়োগ করে সে তৈরি করল দেশলাই তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পটাশিয়াম ক্লোরেট তৈরির প্রথম চিনা কারখানা। প্রচুর মুনাফা এল এটা থেকে। চাকরি থেকে পদত্যাগ করে সাংহাইতে হাজির হল সে ভাগ্য নির্মাণ করতে। দেশলাই তৈরিতে শুধু পটাশিয়াম ক্লোরেটই লাগে না, লাগে অন্যান্য জিনিসও। সেই সব জিনিসের কারখানা তৈরি করে জাঁকিয়ে বসল সেখানে।

সাংহাইও তখন গ্রাম, কিন্তু নদীর মোহানায় বলে সেখানকার বন্দর দিয়ে আমদানি হয় বিদেশী বস্তুসামগ্রীর। জাপানি আজিনোমোটো বাজার মাত করছে দেখে কিনচেং ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ হাজার ইউয়ান ধার করে সে স্থাপন করল তিয়েঞ্চু এম-এস-জি কারখানা। জাপানিদের পদ্ধতি সে এর মধ্যে শিখে নিয়েছে, সেটা দিয়েই শুধু এই কারখানা চালাচ্ছে না, এর একটা চিনা পেটেন্টেরও আবেদন করেছে সে। ফলে আদালতে নালিশ গেল জাপানি আজিনামোতো থেকে। তাদের পদ্ধতির চিনা পেটেন্ট অন্য একজনের নামে কী করে হতে পারে?

কিন্তু দেশটা চিন, বিদেশী জিনিস অনুকরণ করেই সে উঠে যাবে বিদেশীদের মাথায়, তাদের আদালতে আবার কীসের বিচার? তার ওপর বিচার চাইছে এক জাপানি কোম্পানি, যে জাপান চিনের শত্রু!

আজিনোমোটো সুবিচার পেল না।

মাত্র তিন বছরে চিনের আমদানির চেয়ে দেশে এমএসজি বেশি উৎপাদন হ’তে লাগল। যেহেতু এর পদ্ধতি খুব সহজও ছিল না, তাই দেশের অন্যরা কেউ তখনও নকল করতে পারেনি। এর গ্লুটামিক অ্যাসিড তৈরি করা হ’ত গমের আটার গ্লুটেন থেকে। চিনে তো রুটি-ফুটি কেউ খায় না, চিন পুরো চালবাজ অর্থাৎ চালের দেশ। গমের আটা কাজে লাগে বস্ত্রশিল্পে, তা থেকে তৈরি হয় স্টার্চ যা সুতির কাপড়ে মাড় দিতে লাগে। চাল যেহেতু প্রধান খাদ্য, তাই চালের স্টার্চ ওরা ব্যবহার করতে পারত না। আটা থেকে স্টার্চ বের করতে হলে আটাকে বিশাল বিশাল কড়াইতে প্রচুর জল দিয়ে ধুতে হয়, লম্বা লম্বা বাঁশ দিয়ে সেটাকে ক্রমাগত নাড়াতে হয় আর পা দিয়ে চটকাতে হয়। ধুয়ে স্টার্চ বেরিয়ে গেলে পড়ে থাকে যে চটচটে বস্তুটা, সেটাই অশুদ্ধ গ্লুটেন। এই অশুদ্ধ গ্লুটেন হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডে ফুটিয়ে তৈরি করা হয় গ্লুটামিক অ্যাসিড, তাকে সোডা দিয়ে প্রশমিত করে নিলেই এম-এস-জি।

অশুদ্ধ গ্লুটেন পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল বস্ত্রশিল্পের কারখানাগুলো থেকে। সেগুলোর উৎপাদন তো আর বছর বছর বাড়ত না। হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডও আমদানি করা হ’ত। ইয়ুঞ্চু তার এমএসজির মুনাফা বিনিয়োগ করে দু বছরেই হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডেরও কারখানা বানিয়ে ফেলল। গ্লুটেনের খোঁজ করতে লাগল মদের কারখানাগুলোতে।

পরে এই পদ্ধতি পরিত্যাগ করে গ্লুকোজ থেকে গ্লুটামিক অ্যাসিড তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। দুধের ল্যাকটোজ যেমন ল্যাকটোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিতে পরিণত হয় ল্যাকটিক অ্যাসিডে (যা দইতে থাকে), তেমনি ভুট্টা, আখ বা কাসাভা থেকে পাওয়া স্টার্চ থেকে উৎপন্ন গ্লুকোজকে গ্লুটামিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিতে গেঁজিয়ে পরিণত করা হয় গ্লুটামিক অ্যাসিডে।

৩ Comments

  1. Just hopped onto 888pcom. They have live casino, which is pretty cool. Worth checking out if you like that immersive experience. Here is the link: 888pcom

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *