বিজ্ঞানের ইতিহাস এক চমকপ্রদ বিষয়। বিজ্ঞান পাঠের সঙ্গে সঙ্গে তার ইতিহাস পাঠ আবশ্যিক হওয়া উচিত।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের ছাত্রাবস্থায় এই ধারণা দেওয়া হয় যে বিজ্ঞান একটা ভয়ঙ্কর ধরনের গোলমেলে জিনিস, কেবলমাত্র মেধাবী ও তীব্র বুদ্ধিমান ছাত্রদের জন্যেই বিজ্ঞান। ফলে বিজ্ঞান নিয়ে সকলের মধ্যেই একটা ভীতি জন্মে যায়, এমনকি মেধাবী ও তীব্র বুদ্ধিমান ছাত্রও ভয়ে ভয়ে বিজ্ঞান পড়ে।
অথচ বিজ্ঞানের ইতিহাস বেশ অন্য রকম। ইতিহাস বলে যাঁরাই বিজ্ঞানকে ফান বা মজা হিসাবে দেখেছেন, তাঁরাই নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছেন। যাঁরা ভীষণ সিরিয়াসলি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, তাঁদের অবদান বড়জোর মধ্যমশ্রেণির।
আচার্য জগদীশচন্দ্র বিদেশে পড়াশুনা করে (লর্ড র্যালের মত নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ছিলেন তাঁর শিক্ষক) দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক তো হলেন, কিন্তু যেই শুনলেন তাঁকে টু-থার্ড বেতন দেওয়া হবে কালা আদমি বলে, অমনি তা নিতে অস্বীকার করে পড়াতে লাগলেন। বিশ্বাস করুন, চাকরি জীবনের প্রথম দশ বচ্ছর তিনি গবেষণার ধারেকাছে যাননি। এডিসন ফোনোগ্রাম বানিয়েছে, তিনি তার একপিস সংগ্রহ করে বন্ধুবান্ধবদের ভয়েস রেকর্ড করে তাদের মজা দিতেন। ক্রুকস টিউব বা ক্যাথোড রে বানানোর টিউব জোগাড় করে ছাত্রদের ও অন্যান্যদের দেখাতেন। একটা ভালো ক্যামেরা জোগাড় করে বিভিন্ন জিনিসের ছবি তুলে বেড়াতেন। ছাত্রদের ক্লাশ নেওয়া ছাড়া ওটাই ছিল তাঁর প্রথম দশ বছরের কাজ। এর মধ্যে ফিজিক্সের রিসার্চ-টিসার্চ কিচ্ছু নেই।
তারপর হঠাৎ একদিন মনে হল, ধুর, এসব ভাল্লাগছে না, একটু রিসার্চ করি। অমনি কদিনের চেষ্টাতেই আবিষ্কার করে ফেললেন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে বেতারে সিগন্যাল পাঠানোর কারিকুরি। কানাঘুষোয় জানা যায়, এর পেছনে স্ত্রী অবলা বসুর ধাতানিও ছিল – “কী তুমি বুদ্ধিমান মানুষ, গোরা লোকেরা কত কিছু আবিষ্কার করে, তুমি একটা কিছু তো করতে পারো” গোছের।
প্রফুল্লচন্দ্র বিয়ে করেননি, তাঁকে ধাতানি দেওয়ার কেউ ছিল না। তবে তিনি নিজেই নিজেকে পুশ করতেন, তাই খুলে ফেললেন বেঙ্গল কেমিক্যালস। এডিনবরায় থাকতে শুনেছিলেন র্যামজে বলে লোকটা নাইট্রোজেনের অক্সাইড-টক্সাইড বানাচ্ছে। উনি মারকিউরাস নাইট্রাইট বানিয়ে ফেললেন। র্যামজের ভাগ্য ভালো, লর্ড র্যালের দয়ায় উনি ক্লু পেয়ে গেলেন নোবল গ্যাসের। ভেবে দেখুন, লর্ড র্যালের ছাত্র জগদীশচন্দ্র তখন ওখানে থাকলে হয়ত নোবেল গ্যাস উনিই আবিষ্কার করতেন। অথবা প্রফুল্লচন্দ্র।
এই যে পারস্পরিক তথ্যের ও আইডিয়ার আদানপ্রদান, এর ফলেই সে সময় ইওরোপীয় ও পরে আমেরিকায় বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতি হয়েছে। আর ঠিক এর অভাবেই আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। এবং বিজ্ঞান জিনিসটা ভয়ে ভয়ে পড়ি।
অথচ আসলে এটা তো একটা মজার জিনিস। ছবি আঁকা বা নাচ-গান এর চেয়ে অনেক কঠিন।