» নয়, নয়, নয় এ মধুর খেলা

নয় শব্দটা নঞর্থক হলেও গণিতের হিসাবে ওটাই সবচেয়ে বড় ডিজিট বা একাঙ্ক সংখ্যা। কী বলা যায় একে, লৌহিক? ও হো, যারা আমার এই পাতি ঠাট্টাটা বুঝতে পারলেন না, তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, লৌহিক হচ্ছে আয়রনি। বাজে পান হল? লোহা একটা শক্তপোক্ত কঠিন ধাতু, তাকে না গলিয়ে পান করা তো সম্ভব না। কিন্তু লোহাকে গলাতে দেখেছেন কেউ? আয়রন ও স্টিল ফ্যাক্টরিতে লোহা গলন্ত অবস্থাতেই বানানো হয়, কিন্তু সেখানে গিয়ে আর কে দেখতে গেছে গলানো লোহা? গরম করলে কঠিন তরলে পরিণত হয়, সেটা সবাই জানে, কিন্তু যতটা গরম আমরা সাধারণভাবে দেখে থাকি, তাতে লোহা গরম করলে তা কালো ধাতু থেকে লাল রঙের এক গনগনে আলো বিচ্ছুরণকারী জিনিসে বদলে যায়। স্যাঁকরার ঠুকঠাক, কামারের এক ঘা – কামার বা কর্মকার সেই ঘা মারে ওই গনগনে লাল লোহায়, পিটিয়ে বানায় কাজের জিনিসপত্র।

নয়-এর কথা বলতে গিয়ে কোত্থেকে কামার এসে গেল! পান না ছাই, একেই বলে ধান ভানতে শিবের গীত। তবে হ্যাঁ, নয় সংখ্যাটার সাথে কামারের যোগ একেবারে যে নেই, তা নয়। নবশাখ বলে একটা কথা আছে হিন্দুদের জাতপাত-অধ্যুষিত সিস্টেমে, সেই ন’টা শাখা হল তিলি, তাঁতী, মালাকার, নাপিত, বারুই, সদ্‌গোপ, ময়রা, কুমোর এবং হ্যাঁ, কামার। যথাক্রমে তেল, কাপড়, ফুল, চুল, পান, দুধ, মিষ্টি, মৃৎপাত্র আর ধাতব বস্তু নিয়ে এদের কারবার।

এ তো সবে শুরু। নয়ের আরো অনেক গুণ। আমরা যে একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ পড়েছি, তাতে নয়ে নবগ্রহ। বিজ্ঞানের বইতে ছিল সেই ন’টা গ্রহ হল সূর্যের থেকে দূরত্ব অনুযায়ী যথাক্রমে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো। এখন প্লুটো সে গুরুত্ব হারিয়েছে। কিন্তু শাস্ত্রমতে এই ন’টা গ্রহ হল সপ্তাহের সাতটা দিনের নামে, অর্থাৎ রবি (মানে সূর্য), সোম (মানে চাঁদ), মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি আর তারসাথে রাহু আর কেতু। শেষদুটো সূর্য আর চাঁদকে মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে খেয়ে ফেলে, তাই ওদের ‘গেরোন’ লাগে!

এসব পড়তে ভীষণ বোরিং লাগছে? রসকষহীন বলে? ওয়েল, রসের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, কাব্যে রসের সংখ্যাও সেই ন’টা। এরা হল আদি বা শৃঙ্গার রস, হাস্যরস, করুণরস, রৌদ্ররস, বীররস, ভয়ানকরস, বীভৎসরস, অদ্ভুতরস ও শান্তরস। এটা জেনে যারা ভাবছেন, ও মা, তাই নাকি, এটা তো জানতুম না, কাব্য না পড়েও তাদের মধ্যে যে রসের সঞ্চার হচ্ছে, সেটাকে অদ্ভুতরস বললে কেউ আপত্তি করবে?

ও হ্যাঁ, নবরত্নের কথা আমি আর কী বলব! বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় শ্রেষ্ঠ রত্নটি ছিলেন কবি কালিদাস। আর যে আটটি সভাপণ্ডিত ছিলেন, তাঁরা হলেন বররুচি, অমরসিংহ, বরাহমিহির, বেতালভট্ট, ঘটকর্পর, ধন্বন্তরি, ক্ষপণক ও শঙ্কু। এই শঙ্কুর নামের আগে প্রফেসর বানিয়ে তাকে নিয়ে গল্প ফেঁদেছিলেন কিনা সত্যজিৎ, সে কথা উনি লিপিবদ্ধ করে যান নি।

তবে এই যে ন’টা মনুষ্যরত্ন, তাতেই নবরত্ন কথাটা সীমাবদ্ধ নয়। ন’টা রত্ন সত্যিই আছে। তাদের নাম হল মুক্তো, মানিক (এই রে, এটা আবার সত্যজিতের ডাকনাম), বৈদূর্য, গোমেদ, বজ্র, বিদ্রুম, পদ্মরাগ, মরকত এবং নীলকান্ত। বৈদূর্য কথাটার সাথে মহাভারতের বিদুর-এর যোগ আছে, কিন্তু একটা রত্নের সাথে গোমাংসের (গো-মেদ) কী সম্পর্ক? সেই যে মর্কট শিয়ালটা নীলের গামলায় পড়ে গিয়ে নীলবর্ণ হয়ে গেল, তা থেকেই কি মরকত আর নীলকান্ত?

মা দুর্গাকে নবদুর্গারূপে অনেক জায়গাতেই পুজো করা হয়। সেই ন’টা রূপ হল পার্বতী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী ও সিদ্ধিদা। কুষ্মাণ্ডা কথাটার মধ্যে কুমড়ো আর ডিম লুকিয়ে আছে, চালকুমড়ো না মিষ্টিকুমড়ো কে জানে!

দুর্গাপুজোর সময় গণেশের বউ শ্রীমতী কলাও পূজিতা হন। তাঁর আর এক নাম নবপত্রিকা। প্যাণ্ডেলে শুধু পাতা ও ধড়ওয়ালা কাটা কলাগাছ চোখে পড়ে, আসলে থাকা উচিত কলা, কচু, ধান, হলুদ, ডালিম, বেল, অশোক, জয়ন্তী ও মানকচু – এদের সবগুলোর পাতা দিয়ে তৈরী নারীমূর্তি। কচু ফচু বাংলাদেশের যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে, জয়ন্তীটা যে কী গাছ, জানি না। আপনারা জানেন?

নয় নিয়ে সাতটা জিনিসের ন’টা করে সেট বলা হল। আট নম্বর হল নবদ্বার। আমাদের শরীরে ন’টা দরজা বা ছিদ্রপথ, সামলে রাখুন। এর মধ্যে দুটো চোখ, দুটো কান, দুটো নাসারন্ধ্র, বাকি তিনটে মুখ, পায়ু ও উপস্থ বা জননছিদ্র।

নয় নিয়ে নয়নম্বর সেট – এখানেই দাঁড়ি টানব, বাংলা বা হিন্দী সিরিয়ালের মত টেনে লম্বা করব না – হল নবলক্ষণ। এরা হল ব্রাহ্মণ বা কুলীনের গুণ। এই লিস্টিতে আছে আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, বৃত্তি, তপ ও দান। আপনাদের যাদের নামের শেষে –পাধ্যায় বা –র্জী আছে, মিলিয়ে নিন এর ক’টা গুণ আপনার মধ্যে বর্তমান। শর্ট পড়লে প্র্যাকটিশ করুন। চেষ্টা করলে কী না হয়!

নয় নং একাশিটা (পরে অবশ্য জেনেছি ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি’) জিনিসের নাম বললাম। মুখস্থ করে রাখুন। কখন কী কাজে লেগে যায়! তখন কিন্তু বলবেন না, যে বলিনি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *